রান্নার জগতে স্মরণীয় নারীরা

প্রতীকী ছবি
ছবি: ক্লাউস নিয়েলসেন, পেকজেলস ডট কম

ঘরোয়া রান্নাবান্নার দায়িত্ব সব দেশেই প্রধানত বাড়ির মা, স্ত্রী, বোন ও মেয়েরাই সামলে আসছে যুগ যুগ ধরে। অথচ খাদ্যসংস্কৃতি, রান্না, পাকপ্রণালি ইত্যাদি নিয়ে বাড়ির বাইরে কাজ করা এবং রন্ধনশিল্পে নিজ হেঁশেলের বাইরে একটি আলাদা পরিচয় তৈরি করার পথটি কিন্তু নারীর পক্ষে কোনো দিনই সহজ ছিল না। প্রতিটি দেশে, সমাজেই এমন অসাধারণ সব জ্ঞানী, অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ নারী রন্ধন বিশেষজ্ঞ আছেন, যাঁদের জ্ঞানের সাগরে বাঁধ দিয়ে সমাজ তাঁদের ঘরের চার দেয়ালেই আটকে রেখেছে, অথবা ঘরে-বাইরে আটপৌরে জীবনযাপনের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছে। তবে নারী জাগরণের এই উজ্জীবনের দিনে, আজকের নারী দিবসে স্মরণ করা যাক খাদ্যসংস্কৃতিতে অসামান্য অবদান রাখা সেই নারী পথিকৃৎদের, যাঁদের অনুসরণ করে, যাঁদের জীবনের গল্প থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে লাখো কোটি নারী তাদের নিজ আলোয় উদ্ভাসিত হতে পারবে আপন প্রতিভায়।

বুয়ি ইয়াং চাও

২৫ তম বিবাহবার্ষিকীতে পরিবারের সঙ্গে বুয়ি ইয়াং চাও
ছবি: উইকিপিডিয়া

১৮৮৯ সালে জন্ম নেওয়া বুয়ি ইয়াং চাওয়ের (১৮৮৯–১৯৮১) কাছে বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক চাইনিজ খাবার পুরোপুরি ঋণী। এই যে স্টার ফ্রাই, চাওমিন, পট স্টিকার, ডিম সাম—এই শব্দগুলোকে পৃথিবীর সামনে ইয়াংই প্রথমে সাজিয়ে–গুছিয়ে লিখে পরিবেশন করেন। তাঁর দিন বদলানো বই ‘হাউ টু কুক অ্যান্ড ইট ইন চাইনিজ’ বিশ্বদরবারে চাইনিজ খাদ্যসংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে পাকাপোক্তভাবে। জীবনের শুরুতে চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়া শুরু করলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায় থাকাকালে ঐতিহ্যবাহী চাইনিজ খাবারের সহজ, অনুসরণযোগ্য রেসিপি লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে তিনি খুবই আগ্রহী হয়ে পড়েন। তাঁর এই বই সারা দুনিয়ায় চাইনিজ খাবারের প্রসিদ্ধি ও জনপ্রিয়তা লাভ করার পেছনে বিশাল ভূমিকা রেখেছে।

জুলিয়া চাইল্ড

জুলিয়া চাইল্ড, ১৯৯৪
ছবি: উইকিপিডিয়া

শুধু ফ্রেঞ্চ রান্নাকে আমেরিকা তথা সারা বিশ্বের কাছে সুচারুরূপে তুলে ধরাই নয়, রেসিপিগুলোকে সহজ ভাষায় বৈজ্ঞানিক উপায়ে ছকে বাঁধার জন্যও জুলিয়া চাইল্ড (আগস্ট ১৫, ১৯১২– আগস্ট ১৩, ২০০৪) সুবিখ্যাত। ১৯১২ সালে জন্ম নিয়ে এই রন্ধনশিল্পী ও শিক্ষক সেই ষাটের দশকেই টেলিভিশনে ডিমের অমলেট বানিয়ে সবার কাছে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর রান্নার অনুষ্ঠান বহু বছর ধরে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এবং এমি পুরস্কার পর্যন্ত জিতে নিয়েছিল। এর মধ্যে তিনি ‘দ্য ফ্রেঞ্চ শেফ’সহ বহু বইও লিখে ফেলেন। তাঁর সাবলীল ও উৎফুল্ল উপস্থাপনা, তাঁর রান্নার অনুষ্ঠানকে যে জনপ্রিয়তা দিয়েছিল, তা আজকের দিনেও নজিরবিহীন। বহু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি তাঁর লেখা বই ও টিভি অনুষ্ঠানের জন্য।

এডনা লিউইস

এডনা লিউইস
ছবি: ন্যাশনাল ওম্রানস হিস্টরি মিউজিয়াম

আজকালকার দিনে মামুলি ব্যাপার হলেও সেই ১৯১৬ সালে জন্ম নেওয়া আফ্রিকান-আমেরিকান এডনা লিউইসের (এপ্রিল ১৩, ১৯১৬ - ফেব্রুয়ারী ১৩, ২০০৬) জন্য আমেরিকার রন্ধনশিল্পজগতে একজন অগ্রণী নারী হয়ে ওঠার পথটি অত্যন্ত কঠিন ছিল। খোদ নিউইয়র্কে তিনি সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাসদের সমাজ, তাদের খাদ্যাভ্যাস, তাদের রন্ধনশৈলী—এ সবকিছুকে গর্ব ভরে উপস্থাপন করেছেন খাবারের প্লেটে নগরের এলিট শ্রেণির কাছে। তাঁর হাত ধরেই আমেরিকার প্রকৃত গ্রামীণ খাদ্যসংস্কৃতি নতুনভাবে জেগে ওঠে তাঁর বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক ক্যাফে নিকলসনের রসুইখানায়। ১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে সংস্কৃতিমনা মানুষ ও শিল্পীসমাজে তাঁর রন্ধনরীতি এক বিপ্লবের পথ দেখায়। অসংখ্য পুরস্কারপ্রাপ্ত এডনা লিউইস রান্না ও খাবারদাবার–সংক্রান্ত বই লিখেছেন বেশ কটি। সমাজসংস্কারক হিসেবেও তাঁর সুনাম ছিল আকাশচুম্বী।

সিদ্দিকা কবির

সিদ্দিকা কবির
ছবি: উইকিপিডিয়া

আমাদের বাংলাদেশেও এমন একজন নারী রন্ধন বিশেষজ্ঞ ছিলেন, যিনি সারা বিশ্বে বাংলাদেশি রান্নাকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রফেসর সিদ্দিকা কবিরের (৭ মে, ১৯৩১– ৩১ জানুয়ারি, ২০১২) লেখা ‘রান্না খাদ্য পুষ্টি’ বইটি ছাড়া নতুন রাঁধুনিরা রান্নাঘরে পা দেওয়ার কথা ভাবতেও পারতেন না। ১৯৩১ সালে জন্ম নেওয়া এই ক্ষণজন্মা অত্যন্ত মেধাবী নারী গণিতশাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করার পরে আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পুষ্টিবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশের খাবারের রেসিপিগুলো অত্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক রেসিপিতে বেঁধে উপস্থাপন করেছেন সাধারণ মানুষের কাছে।

সিদ্দিকা কবির আশির দশক থেকে টেলিভিশনের পর্দায়ও রান্না শেখাতেন অত্যন্ত সহজ ও সপ্রতিভভাবে। তাঁর ‘রান্না খাদ্য পুষ্টি’ বইটি আজও সবার কাছে সমান জনপ্রিয়। টেলিভিশনে তাঁর রান্নার অনুষ্ঠানটিও অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল সর্বসাধারণের কাছে। তিনি রেসিপির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের পুষ্টিগুণের ব্যাপারেও আমাদের শিখিয়েছেন সযত্নে। আজ এই নারী দিবসে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাঁর কর্মময় জীবনের মাধ্যমে দেশের অসংখ্য নারীকে অপরিসীম প্রেরণা দেওয়ার জন্য।

মাধুর জাফরি

মাধুর জাফরি
ছবি: উইকিপিডিয়া

বিবিসি চ্যানেলে এই অসম্ভব রকমের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী যখন ঝরঝরে ইংরেজিতে ভারতীয় উপমহাদেশের খাদ্যসংস্কৃতি আর রন্ধনশিল্প বিষয়ে নানা খুঁটিনাটি তুলে ধরেন, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনা ছাড়া আর উপায় থাকে না। খাদ্য ও রন্ধনসাহিত্যে অসামান্য অবদান রাখা এই ভারতীয় নারী পেয়েছেন অত্যন্ত সম্মানজনক জেমস বিয়ার্ড ফাউন্ডেশন পুরস্কারসহ আরও বহু সম্মাননা। ১৯৩৩ সালে জন্ম নেওয়া মাধুর জাফরি ভারতীয় রান্নাকে এক অন্য রকম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।

তারলা দালাল

তারলা দালাল
ছবি: উইকিপিডিয়া

ভারতের ভেতরেই ভারতীয় রান্নাকে সার্বিকভাবে সবার জন্য সহজে অনুসরণযোগ্য রেসিপিতে বেঁধে আবার সাবলীল ও হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতির মাধ্যমে সবার কাছে পরিবেশন করার ক্ষেত্রে তারলা দালালের (৩ জুন ১৯৩৬–৬ নভেম্বর, ২০১৩) নাম সবার আগে আসে। ১৯৩৬ সালে জন্ম নেওয়া এই অসাধারণ রন্ধনশিল্পী ও খাদ্যসাহিত্যিক পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন ২০১৩ সালে। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনকালে তিনি শতাধিক বই লিখেছেন, যা লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে ও হচ্ছে। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম রান্নার বই ‘দ্য প্লেজারস অব ভেজিটারিয়ান কুকিং’ অসংখ্য মানুষের মন জয় করেছে। পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত এই রন্ধন বিশেষজ্ঞ নারী আমাদের সবার কাছে স্মরণীয়।

নাইজেলা লসন

নাইজেলা লসন
ছবি: টুইটার

ঘরোয়া রাঁধুনিদের যদি সত্যিকার অর্থে কেউ রন্ধনশিল্পের মধ্যে আনন্দ খুঁজে নেওয়ার মূলমন্ত্র দিয়ে থাকেন, তিনি হচ্ছেন ব্রিটিশ রন্ধন বিশেষজ্ঞ নাইজেলা লসন। একেবারে নিজের ঘরের কোণে নির্মল ও খাঁটি আনন্দের সঙ্গে নিজের মনের মতো খাদ্যখানা রেঁধে চলেন তিনি। তাঁর সম্মোহনী বর্ণনাভঙ্গি, রান্না শেষে অত্যন্ত উপভোগ করে তা খাওয়া, নিজেকে ও নিজের ইচ্ছাগুলো ডানা মেলতে দেওয়া—এসবই তাঁকে সবার মধ্যে করেছে অনন্য। ১৯৬০ সালে জন্ম নেওয়া এই টেলিভিশন রন্ধন তারকা কিন্তু খাদ্যবিষয়ক লেখকও বটে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করা নাইজেলা লসন লিখেছেন বহু রান্নার বই এবং সে জন্য বহু পুরস্কারও পেয়েছেন। তবে তাঁর অনন্য পর্দা উপস্থিতি এবং খাবারকে উদ্‌যাপন ও মুক্তভাবে উপভোগ করার মানসিকতার জন্যই তিনি সারা বিশ্বে এত জনপ্রিয়।

রি ড্রামন্ড

রি ড্রামন্ড
ছবি: টুইটার

১৯৬৯ সালে জন্ম নেওয়া এই নারী খাদ্যবিষয়ক ব্লগিংয়ের ক্ষেত্রে একেবারে পথিকৃৎ বলা চলে। তাঁর ‘দ্য পাইওনিয়ার ওমেন’ নামের ব্লগসাইটটি পারিবারিক জীবনযাপন, খাদ্যসংস্কৃতি, ভালো লাগা, মন্দ লাগার উপাখ্যান হিসেবে এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে ২০১০ সালে তিনি ফোর্বসের ১০ প্রভাবশালী ওয়েব তারকার তালিকাভুক্ত হন। তাঁর ব্লগিংয়ের বদৌলতে তিনি লেখিকা হিসেবে প্রভূত খ্যাতি পেয়েছেন। লিখেছেন বহু বই, পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। টেলিভিশনেও তাঁর উপস্থিতি অত্যন্ত উজ্জ্বল।

খাদ্যসংস্কৃতি হাজার হাজার বছর ধরে এগিয়ে চলেছে নারী ও পুরুষ উভয়ের হাত ধরে। শস্য উৎপাদনের মতো শ্রমঘন কাজে পুরুষের গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, তেমনি রান্নার ক্ষেত্রে নারীদের অধিকার একচেটিয়া। রান্না ও খাবারের বিবর্তন, উপকরণের আত্মীকরণ—এ সবকিছু নারীদের হাতে বর্ধিত হয়েছে, বিকশিত হয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম রান্নার বিষয়টি মূলত থেকে গেছে নারীদের হাতে। কখনো কখনো পুরুষেরাও হয়েছে তার সহযাত্রী। খাবারের যে ঐতিহ্য তৈরি হয়, একেকটি জনপদে তার মূলে আছে নারীদের নিরলস শ্রম ও সৃষ্টিশীলতা। রান্নার এ ভুবন নারীদের একান্তই নিজস্ব।