সিএইচটি এক্সপ্রেস: রাজধানীতে পাহাড়ি খাবারের স্বাদ

সব খাবারের পেছনেই কি একটি গল্প থাকে? অর্পণ চাকমা মনে করেন, থাকে। আর অর্পণ এসব গল্প করতে ভালোবাসেন, যে গল্প তিনি শুনেছিলেন দাদা-দিদি বা বাড়ির অন্য গুরুজনদের কাছে। তাঁরা সবাই দূর পাহাড়ের মানুষ। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনপদ তাঁদের আবাসস্থল। যেখানকার প্রকৃতি, পরিবেশ আর সংস্কৃতি ভিন্ন, দেশের সমতলভূমি থেকে। ভিন্নতর তাঁদের খাবারদাবারও। শুধু গল্প বলা নয়, পাহাড়ের এসব ভিন্ন খাবারের স্বাদ রাজধানীর মানুষকে তুলে দিতে চান সিএইচটি এক্সপ্রেস নামের রেস্তোরাঁটির অন্যতম স্বত্বাধিকারী অর্পণ। তিনি বলছিলেন, ‘একটি খাবার একটি সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। এটা আমাদের ব্যবসা অবশ্যই। কিন্তু এর মাধ্যমে পাহাড়ের প্রথাগত সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চাই।’

মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পিঠা ‘ছেছমাহ্ মুহ্’ পাওয়া যাবে সিএইচটি এক্সপ্রেসে
ছবি: সংগৃহীত

এই লক্ষ্য সামনে রেখে তিন বছর আগে এ রেস্তোরাঁর যাত্রা শুরু মিরপুরের কাজীপাড়ায়। মাঝে করোনা মহামারি সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। কিন্তু আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে পাহাড়ি খাবারের এই রেস্তোরাঁ।

সিএইচটি এক্সপ্রেসের নাম আর অবস্থান জানা গেল। এবার চলুন এর ভেতরে যাই। আপনি যদি ফার্মগেট এলাকা থেকে যান, তবে মিরপুরের কাজীপাড়ায় পদচারী-সেতু পার হতে হবে। এরপর খানিকটা এগিয়ে রাস্তার ডান দিকের গলিতে গেলেই সিএইচটি এক্সপ্রেসের দেখা মিলবে। কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে গেলে পরিবেশটা পাল্টে যাবে। দুপাশের দেয়ালে আঁকা পাহাড়ের বিভিন্ন জাতিসত্তার বর্ণমালা। পাহাড়ি মানুষের নানা মুখের ছবি। কোথাও ঝোলানো পাহাড়ি কারুশিল্পের নিদর্শন। দেয়ালে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আছে চেয়ার-টেবিলও।

সিএইচটি এক্সপ্রেসের অন্দর সজ্জায় আছে পাহাড়ের ছোঁয়া
ছবি: সংগৃহীত

নামধাম, অবস্থানের এসব পরিচয়ে সিএইচটি এক্সপ্রেসের পুরোটা জানা হয় না। রেস্তোরাঁটি আর পাঁচটি রেস্তোরাঁ থেকে বেশ পৃথক। যেমন সিএইচটি এক্সপ্রেসের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য, পাহাড়ের হারিয়ে যাওয়া খাবারের সন্ধান, যেসব খাবার তৈরি হয় এক্কেবারে পাহাড়ে হওয়া প্রাকৃতিক নানা উপাদান দিয়ে।

এমন একটি পাহাড়ি পদ হাঙারা চাক বাত্তে। পাহাড়ি কাঁকড়া দিয়ে তৈরি খাবার। এটি তৈরি করতে কাঁকড়ার মাংসের অংশ বাদে বাকি অংশগুলো বাটা হয়। তারপর কাপড়ে নিংড়ে রসটা নিয়ে আবারও রসটা দিয়েই কাঁকড়ার মাংসটা রান্না হয়।

সিএইচটি এক্সপ্রেসের আরেক স্বত্বাধিকারী রেখা তালুকদার বলছিলেন, ‘এসব আইটেম এখন খুব কম ঘরেই হয়। কিন্তু আমরা এসব করতে চাই।’

সমতলের খাবার থেকে পাহাড়ের খাবারের ভিন্নতার অন্যতম কারণ হলো, পাহাড়ের প্রথাগত প্রাচীন জুমচাষ পদ্ধতি। আগের চেয়ে অনেক কমে গেলেও এ চাষের চল আছে এখনো। চাষের সময় সাধারণত জুমিয়া পরিবারের জুম খেতে পরিবারসমেত চলে যাওয়াই রীতি। এই বিরান অঞ্চলে খাবার রান্না করতে মসলা মিলবে কোথায়? তাই তো বনজঙ্গলে মেলা নানা লতা-গুল্মই ছিল ভরসা। যেগুলো ছিল মসলার পরিপূরক। পাহাড়ি মানুষ বংশপরম্পরায় খাবারের সেই রীতি বজায় রেখেছে। আর এসব খাবার পাহাড়ি নানা সবজি, ব্যঞ্জন দিয়ে পরিবেশিত হয় সিএইচটি এক্সপ্রেসে।

পাহাড়ি খাবারের আয়োজন
ছবি: লেখক

ধরুন সাধারণ মুরগির মাংসের কথা। এর সঙ্গে জুমের মরিচ, সাবারাং পাতা বা ধান সাবারাং মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে মুখে জল আনা পদ। এই শীতে ‘মাছ সিক্কে’ বা পোড়া মাছের সন্ধান পাবেন এখানে। কিন্তু সেখানে নেই উৎকট মসলার মিশ্রণ।

পাহাড়ি প্রবাদ আছে, ২২ পদ না হলে পাজন হয় না। এর চেয়েও বেশি পদে পাহাড়ি নানা তরকারির মিশ্রণ আপনাকে মোহিত করবে।

বাঁশের মধ্যে মাছ বা মাংস দিয়ে, তাতে মসলা মিশিয়ে পাহাড়ের পরিচিত খাবারের সন্ধান এখানে তো মিলবেই। এখানকার বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এসবে পাবেন পাহাড়ি নানা সবজির, হার্বস আর মসলার মিশ্রণ।

সিএইচটি এক্সপ্রেসের তিন স্বত্বাধিকারীর সবাই চাকমা জাতিসত্তার হলেও এখানে পাহাড়ের অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর খাবার মেলে। আর সেসব খুব জনপ্রিয়ও। রেস্তোরাঁয় দেখা হলো বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অসীম চাকমা আর তাঁর বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শেখ মো. আবিরের সঙ্গে। দুজনেরই খুব পছন্দ হয়েছে মারমাদের মুন্ডি, যাকে সহজে বলা যায় নুডলসের স্যুপ। আবির বললেন, ‘এখানে চটজলদি খাবারও খুব মুখরোচক। আর মনে হয় সব খুব ফ্রেশ।’

বাঁশকোরলে তৈরি খাবার ‘বাচ্চুরি মালা’ পাওয়া যাবে সিএইচটি এক্সপ্রেসে
ছবি: সংগৃহীত

হ্যাঁ, দুপুর বা রাতে পেট ভরে না খেয়ে বিকেল বা সন্ধ্যার স্ন্যাকস খেতে চাইলেও তার ব্যবস্থা আছে। বিন্নির পিঠা, মোমো, লাকসু ইত্যাদি নানা পদ পাওয়া যাবে এখানে।
আর এসব খাবারের মধ্যে কিছু ফিউশনও আনার চেষ্টা আছে এ রেস্তোরাঁর। যেমন বিন্নির পিঠার মধ্যে নিজেদের বানানো ক্রিম পরিবেশিত হচ্ছে। কলকাতায় খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ে পড়া অর্পণ এসব করতে ভালোবাসেন। কারণ, তাঁর কথা, ‘ফিউশন করতে নিজেদের বৈশিষ্ট্য বাদ দিই না। এতে ভিন্নতা আনতে চাই, বেশি স্বাস্থ্যকর করতে চাই।’
অর্পণ যে ‘স্বাস্থ্যকর’ কথাটি বললেন, ঠিক এ কারণের জন্যই এ রেস্তোরাঁয় আসেন বলে জানান রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নুর আহমেদ। বললেন, ‘পুরো পরিবার নিয়ে মাঝেমধ্যে আসি। এখানে খুব বিলাসিতা নেই। কিন্তু এখানকার খাবারগুলো একেবারে সতেজ। আমার ধারণা, এখানে পাহাড়ের নির্ভেজাল খাবারই পাই আমরা।’

সিএইচটি এক্সপ্রেসে ফিউশন খাবারেও আছে অভিনবত্ব। তাদের উদ্ভাবিত পানীয় ‘ডাবডুব’।
ছবি: সংগৃহীত

সিএইচটি এক্সপ্রেসের আরেক বৈশিষ্ট্যের কথা বললেন নুর আহমেদ। আর তা হলো এর সাশ্রয়ী মূল্য। রেস্তোরাঁয় আসা নানা পেশার মানুষের কাছে এই কথাটি শোনা গেল।
নানা খাবার, আয়োজনের কথা শোনা গেল। এবার একটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কথা দিয়ে শেষ করা যাক। এর সঙ্গে জড়িত নৈতিকতা, যা মেনে চলে সিএইচটি এক্সপ্রেস কর্তৃপক্ষ। এখানে পাহাড়ের মিলবে না পাহাড়ের বিলুপ্তপ্রায় কোনো প্রাণীর মাংস। রেখা তালুকদারের কথা, ‘পাহাড়ের বিলুপ্তপ্রায় দ্রব্য দিয়ে ভোজনবিলাস নয়, আমরা সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করতে চাই। ক্ষয় নয়।’