হোজ্জার গাধা ও দুটি রেসিপি

নাসিরুদ্দিন হোজ্জার গাধার আর কাজ করতে ইচ্ছা করছিল না। তাই সবকিছুতেই গড়িমসি করতে শুরু করেছিল সে ব্যাটা। হোজ্জা বুঝলেন। বেশ সেজেগুজে দাওয়াতে যাবেন বলে চেপে বসলেন সেই গাধার পিঠেই। কিন্তু গাধার কাজ করতে ইচ্ছে করে না। সে দুলকি চালে হাঁটে। পথেই ছিল সবজির খেত। নাসিরুদ্দিন নেমে দুটো সবজি তুলে ইয়া বড় এক লাঠির ডগায় বেঁধে, গাধার পিঠে চড়ে সবজিগুলো ধরলেন ঠিক গাধার চোখের সামনে। কিন্তু রাখলেন জিবের থেকে একটু দূরে, যাতে গাধা ব্যাটা টেনে নিতে না পারে। এবার গাধার গতি গেল বেড়ে।

গাধার পিঠে নাসিরুদ্দিন হোজ্জা, মুখারা, উজবেকিস্তান
ছবি: উইকিপিডিয়া

আপনাদের কষ্ট দেব না। বলেই দিই, সে সবজির নাম ছিল মুলা। বাঙালি আছে দুই ধরনের। এদের এক দল মুলা পছন্দ করে বা মজা করেই মুলার তরিতরকারি খেয়ে থাকে। অন্য দল মুলার নামই শুনতে পারে না। এই কট্টর দুই দলের মধ্যে মাঝামাঝি আছে আর একটি দল, যারা কিছু না থাকলে খায়, থাকলে মুলা খায় না। কিন্তু মুলা যে খুব অখাদ্য কোনো খাবার, তা নয়। এর আছে অনেক গুণ। গুণই যদি না থাকবে তাহলে শত শত বছর ধরে মানুষ কি আর এটি খায়?

এর অনেক ধরনের উপকারিতা আছে। সেগুলো একটু গুগল করে নিলেই পাওয়া যায়। তারপরও এখানে কিছু বলে রাখি। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, মুলা রক্তে অক্সিজেন বাড়ায়, যকৃৎ সুরক্ষা করে, হৃদযন্ত্রের সুরক্ষায় মুলার অবদান আছে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। রক্তনালি শক্তিশালী করে, অম্ল, স্থূলতা, গ্যাস্ট্রিক, মাথাব্যথা, বমিভাব দূর করে মুলা। লাল মুলায় ভিটামিন ই, এ, সি, বি৬ ও কে আছে। এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টেও ভরপুর। এতে আছে ফাইবার, জিঙ্ক, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, কপার, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও ম্যাংগানিজ। এসব উপাদান আমাদের শরীরকে কর্মঠ রাখতে সাহায্য করে। এটি ত্বকের জন্য ভালো। প্রতিদিন মুলার জুস খেলে ত্বক সতেজ থাকে। মুলায় থাকা ভিটামিন সি, জিঙ্ক ও ফসফরাস এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। ত্বকের শুষ্কতা, ব্রণ বা দাগ দূর করতে পারে। মুলার পেস্ট তৈরি করে মুখে মাখলে ত্বক সজীব থাকে। এ ছাড়া চুলের খুশকি দূর করতে, চুল পড়া বন্ধ করতে, চুলের গোড়া শক্ত করতে পারে মুলা। এটি শরীর আর্দ্র রাখে।

সাদা মুলা

কাজেই দেখা যাচ্ছে, মুলা জিনিসটি ফেলনা নয়। ঠিক কতভাবে আপনি মুলা খেতে পারেন? জানি সে হিসাব করেননি। কেউ করেও না। তবে পৃথিবীতে চীন, জাপান, কোরিয়া মুলার তৈরি খাবারের দিক দিয়ে বিখ্যাত। বাঙালিও যে মুলা খায় না, তা নয়। তবে ওই যে আগেই বলেছি, এ বিষয়ে বাঙালি দুই ভাগে বিভক্ত।

আমাদের দেশে অনেকভাবেই মুলা খাওয়া হয়। ভেজে এবং তারকারি করেই বেশি খাওয়া হয়। তবে এটি আচার হিসেবেও অসাধারণ। আর সকালবেলা শর্ষের তেলমাখা মুড়ি দিয়ে কাঁচা মুলা খেয়ে দেখবেন, তার স্বাদ একেবারে আলাদা। মুলা ছোট ছোট টুকরা করে কড়া রোদে শুকিয়েও রাখা যায় বছরভর খাওয়ার জন্য।

বিভিন্ন রকমের শুঁটকি দিয়ে রান্না করা যায় মুলা
ছবি: প্রথম আলো

বিভিন্ন শুঁটকি দিয়ে, বিশেষ করে মলা অথবা কাঁচকি কিংবা লইট্যা শুঁটকি দিয়ে দুর্দান্ত স্বাদের তরকারি রান্না করা যায়। আর আলু-মুলা-বেগুন একত্র করে রান্না করা যায় সবজির ঘন্ট। তবে জানিয়ে রাখি, মুলার প্রধান মসলা কিন্তু পাঁচফোড়ন অথবা জিরা। এ দুটোর যে কোনো একটা দিলে আর কোনো মসলা না দিলেও চলে। আর আছে ধনেপাতা। মুলা দিয়ে রান্না করা যেকোনো তরকারিতে পরিমাণমতো ধনেপাতা দিয়ে দিলে মুলার যে গন্ধ, সেটা পাওয়া যায় না।

অনেক কথা শুনলেন। এবার দুটি রেসিপি জানিয়ে দিই আপনাদের।

লইট্যা শুঁটকি দিয়ে মুলা-শোল মাছের সালুন

উপকরণ:
লইট্যা শুঁটকি আধা কাপের মতো, পেঁয়াজবাটা ১ টেবিল চামচ, তবে চাইলে পেঁয়াজ কাটাও দিতে পারেন দুটো, শোল মাছ ৪/৫ টুকরা, মুলা মাঝারি আকৃতির ২/৩ টা স্লাইস করে কাটা, রসুনবাটা দেড় টেবিল চামচ, চাইলে বড় ১টা কুচি করে দিতে পারেন, কাঁচা মরিচ চেরা ৬/৭টি, হলুদগুঁড়া দেড় চা-চামচ, মরিচগুঁড়া দেড় চা-চামচ (ঝাল কম খেলে কম দিতে হবে)।

লইট্যা শুঁটকি দিয়ে মুলা-শোল মাছের সালুন
রেসিপি ও ছবি: শামীমা মজুমদার

ফোড়নের জন্য

গোটা জিরা আধা চা-চামচ, আদাবাটা আধা চা-চামচ, ধনেগুঁড়া ১ চা-চামচ, লবণ স্বাদ অনুযায়ী, শর্ষের তেল পরিমাণমতো।

প্রণালি

লইট্যা শুঁটকি দিয়ে মুলা-শোল মাছের সালুন
রেসিপি ও ছবি: শামীমা মজুমদার

শুঁটকি ভালো করে কষিয়ে নিন। তারপর শুঁটকির মধ্যে মাছগুলো দিয়ে একসঙ্গে আরও একটু কষিয়ে নিতে হবে। কষানো হয়ে গেলে মাছ ও শুঁটকি আলাদা পাত্রে নামিয়ে রাখুন। আর ওই পাত্রে একই মসলায় স্লাইস করে রাখা মুলাগুলো দিয়ে কষিয়ে নিন। মুলা কষানো হয়ে গেলে মাছ ও শুঁটকি দিয়ে ঝোল করার জন্য নিজের মতো করে পানি দিয়ে দিন। এরপর ঢাকনা দিয়ে ১৫ মিনিটের মতো চুলার আঁচ একটু বাড়িয়ে ঝোল ঘন হয়ে এলে ধনেপাতা কুচি দিয়ে নামিয়ে নিন।

মুলার চাটনি

উপকরণ:

মুলা মিহি কুচি আধা কাপ, কারি পাতা ১ টেবিল চামচ, জলপাই তেল ২ টেবিল চামচ, আস্ত শর্ষে আধা চা-চামচ, আস্ত জিরা সিকি চা-চামচেরও কম, আস্ত ধনে সিকি চা-চামচের কম, শুকনা মরিচ ১০ থেকে ১২টি, লবণ ১ চা-চামচ (স্বাদমতো) ও তেঁতুলের ক্বাথ ২ টেবিল চামচ।

মুলার চাটনি। রেসিপি: আফরোজা নাজনীন
ছবি: প্রথম আলো

প্রণালি

মাঝারি আঁচে তেল গরম করে শর্ষে, জিরা, ধনে ও শুকনা মরিচ ফোড়ন দিন। মিনিট দু-এক ভেজে এতে কারিপাতা মিশিয়ে নিন। নামিয়ে বেটে ফেলুন। অল্প তেলে মুলাকুচি ভেজে নিয়ে লবণ ও তেঁতুল মেশান। নামিয়ে বেটে নিন। এর মধ্যে পরিমাণমতো মরিচবাটা মিশিয়ে গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন।