বাংলাদেশের ডুবোটেক কি আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে পারবে
গুগল, ফেসবুক, রেডিট কিংবা স্ন্যাপচ্যাটের মতো বিখ্যাত উদ্যোগগুলোর মধ্যে একটা মিল আছে, বলুন তো কী? সব কটিরই জন্ম হয়েছিল ক্যাম্পাসে। ক্লাসের প্রজেক্ট কিংবা গবেষণা প্রকল্পের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছিল এমন সব আইডিয়া, যা এখন সারা দুনিয়ায় ‘রাজত্ব’ করছে।
ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবন পরে পুরোদস্তুর স্টার্টআপ বা ব্যবসা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে, বাংলাদেশে এমন নজির কম। তাই ‘ডুবোটেক’-কে ব্যতিক্রম বলা যায়। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির গুটিকয় শিক্ষার্থীর হাত ধরে ‘ব্র্যাকইউ ডুবুরি’ নামের একটি প্রকল্পের মধ্য দিয়ে শুরুটা হয়েছিল। ক্যাম্পাসের গণ্ডি পেরিয়ে সেটি এখন স্টার্টআপ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। স্বয়ংক্রিয় রোবট দিয়ে নদী বা সমুদ্রতলে নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন তাঁরা। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গড়া এই দল দেশের বড় বড় জাহাজ কোম্পানিকে সেবা দিতে শুরু করেছে। বড় বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
শুরুটা হয়েছিল যেভাবে
২০১৭ সালের কথা। রোবোটিকসে আগ্রহী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়জন শিক্ষার্থী একটা বিজ্ঞান প্রকল্প নিয়ে ভাবছিলেন। রোবট বানিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়াই ছিল প্রাথমিক পরিকল্পনা। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সকার বট (রোবট গাড়ি দিয়ে ফুটবল খেলা বা গোল দেওয়া), লাইন ফলোয়িং বট (একটি নির্দিষ্ট লাইন অনুসরণ করে রোবটের চলা) বানানোর চল ছিল বেশি। কিন্তু এই দলের সদস্যরা ভাবছিলেন, একটু ভিন্ন কী করা যায়?
ডুবোটেকের চেয়ারম্যান ও প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা সায়ন্তন রায় বলেন, ‘বাংলাদেশ নদী ও সাগরের দেশ। তাই পানি নিয়ে কাজ করার কথা আমাদের ভাবনায় ছিল। প্রথমে পানির মান নির্ণয় করতে চেয়েছি। একটু খোঁজখবর নিয়ে দেখি, অনেক দেশেই তখন পানির নিচের বিভিন্ন কাজে রোবট অবদান রাখছে। উদ্ধার অভিযান থেকে শুরু করে সম্পদের খোঁজ ও সংরক্ষণ, অনেক কিছুই করার আছে। বুঝলাম, এ নিয়ে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে।’
কয়েকটি প্রতিযোগিতায় ভালো ফলের সুবাদে কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এসব শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করে। বন্দর ও সাগরে গবেষণাকাজের প্রস্তাব দেয়। তবে নৌদুর্ঘটনায় উদ্ধার অভিযানের সমস্যাগুলো দলটিকে বেশি উদ্বুদ্ধ করে। কারণ, প্রথাগত উপায়ে ডুবুরি দিয়ে নৌকাডুবি, লঞ্চডুবির উদ্ধারকাজে অনেক বেগ পেতে হতো।
ব্র্যাকইউ ডুবুরিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্পে থেমে না থেকে বড় পরিসরে একটা কোম্পানি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ার চিন্তা করতে থাকেন। ২০২৩–এর শেষের দিকে রোবোসাবে (পানির তলে স্বয়ংক্রিয় রোবটের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা) দ্বিতীয় হন তাঁরা। সফটওয়্যারকেন্দ্রিক প্রযুক্তির জন্য মেলে সেরা উদ্ভাবক দলের স্বীকৃতি।
এরপর সেন্ট মার্টিন, কাপ্তাইয়ে পরীক্ষামূলকভাবে ডুবোটেকের রোবট কাজ করতে শুরু করে। সরাসরি অর্ডার নেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় কোম্পানির যাত্রা।
বর্তমানে পানির নিচের উদ্ধার অভিযান, জাহাজের নিচের অংশের কাঠামো ও জাহাজের অবস্থা পরিদর্শন (ইন্সপেকশন), পানির নিচে সামুদ্রিক ও জীবতাত্ত্বিক সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজ চলমান। সমুদ্রে প্লাস্টিকের পরিমাণ নির্ধারণ, প্রবাল বা মাছের জীবনযাত্রায় জাহাজ বা কোনো প্রযুক্তি প্রভাব ফেলছে কি না, এসব নিয়ে কাজ করা দলগুলোকেও সাহায্য করে ডুবোটেক।
সায়ন্তন রায় বলেন, ‘যেহেতু এটা ডিপ টেক ও আমরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তিপণ্য নিয়ে কাজ করি, তাই তুলনামূলকভাবে প্রতিযোগিতা কম। এই খাতে বিশ্বের বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা কাজ করছি।’
হিলশা, টুনা ও অক্টোপাস
গত বছর মার্চে ‘শার্ক ট্যাংক’ নামের একটি রিয়েলিটি শো থেকে বড় বিনিয়োগ পায় ডুবোটেক। নিজেদের অর্থ দিয়ে কোম্পানি দাঁড় করালেও এই বিনিয়োগ কোম্পানির কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করে।
বর্তমানে ডুবোটেক তিনটি হার্ডওয়্যার পণ্য তৈরি করে। পণ্যের নামগুলোও সমুদ্রকেন্দ্রিক। ‘হিলশা’ হলো পানির নিচের স্বয়ংক্রিয় যান, এটি মূলত গবেষণা ও উন্নয়নকাজে ব্যবহৃত হয়। ‘টুনা’ ও ‘অক্টোপাস’ হলো দূরনিয়ন্ত্রিত যান (রিমোটলি অপারেটেড ভেহিক্যাল বা আরওভি)। সোজা বাংলায়, দূর থেকে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ছবি তোলা ও সামুদ্রিক প্রাণবিষয়ক গবেষণা কাজ করে ‘টুনা’। ‘অক্টোপাস’ ব্যবহৃত হয় জাহাজ পরিদর্শনের কাজে।
ডুবো ওএস ও ইন্সপেক্টর নামের দুটি সফটওয়্যার দিয়ে এসব রোবট পরিচালনা করা হয়।
ডুবোটেকের কার্যক্রম নিয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাইম হোসেন বলেন, ‘আমাদের রোবট ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের মেরিটাইম শিল্পের ভোক্তাদের সেবা দিয়েছে। একটি বড় কোম্পানির সঙ্গেও অংশীদারত্ব হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১২ হাজার ডলার রাজস্ব এসেছে। এতটুকু বলা যায়, গত বছরের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আমাদের সব লক্ষ্যই পূরণ হয়েছে। সামনে ‘টুনা’ রোবটের মডেল বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করতে চায় ডুবোটেক।’
আরও অর্জন
সম্প্রতি গ্লোবাল স্টুডেন্ট এন্ট্রাপ্রেনিউর অ্যাওয়ার্ডসের (জিএসইএ) বাংলাদেশ পর্বে জয়ী হয়েছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ও ডুবোটেক লিমিটেডের সহপ্রতিষ্ঠাতা সৌমিক হাসান। পড়ালেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবন ও উদ্যোগে উৎসাহ দিতে প্রতিবছর এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ অর্গানাইজেশন। জিএসইএয়ের নবম আসরের গ্র্যান্ড ফিনাল অনুষ্ঠিত হয় গত ২২ জানুয়ারি। বিজয়ী সৌমিক এই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার কোয়ার্টার ফাইনালে লড়বেন আগামী ১০ মার্চ। মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় হবে ফাইনাল।
সৌমিক হাসান বলেন, ‘কীভাবে স্টার্টআপ গড়েছি, কোম্পানির কাঠামো কেমন, কীভাবে আমরা এগোচ্ছি, শিক্ষার্থী অবস্থায় কীভাবে এ রকম কোম্পানির খোলা যায়, এই গল্পগুলো বৈশ্বিকভাবে উপস্থাপন করার মঞ্চই জিএসইএ। সেই ভাবনা থেকেই অংশ নেওয়া।’
বৈশ্বিক অনেক দেশের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ তৈরি করতেও এসব মঞ্চ সাহায্য করতে পারে বলে মনে করেন সৌমিক। বললেন, ‘ভারত ও শ্রীলঙ্কারও বন্দর আছে। তাই এ দুটি দেশে আমাদের বড় বাজার আছে। একসঙ্গে কাজ করেই ওই বাজারে ঢোকা সম্ভব। স্থানীয় প্রযুক্তিকে বাইরে নেওয়াই আমাদের এখনকার পরিকল্পনা।’
পরামর্শক যা বলছেন
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. খলিলুর রহমান। ব্র্যাকইউ ডুবুরি ও ডুবোটেক, দুটোর যাত্রাতেই পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। বললেন, ‘প্রথমত, বিদেশে কিন্তু এই চর্চাটাই হয়। উচ্চশিক্ষায় এসে শিক্ষার্থীরা নতুন কিছু তৈরি করে। ধীরে ধীরে সেটা পণ্য হিসেবে শিল্প খাতে যুক্ত হয়। দ্বিতীয়ত, শিল্প খাতকে সাহায্য করে শিক্ষার্থীরা। ধরুন, একটা প্রুফ অব কনসেপ্ট তৈরি করা দরকার। নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে তারা পারছে না। তখন কোম্পানি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আসে। নিজেদের সরঞ্জাম, কাঠামো বা অন্য রিসোর্স দিয়ে সেই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এটা হলো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ল্যাবের কাজের প্রক্রিয়া।’
অধ্যাপক খলিল মনে করেন, ডুবোটেক যে খাত নিয়ে কাজ করছে, সে খাতে বিশাল বাজার অপেক্ষা করছে। তিনি বললেন, ‘বিদেশের বিভিন্ন দেশে আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক দিন ধরেই নানা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে। অনেকে প্রশ্ন করে, এত বড় দল নিয়ে বিদেশে গিয়ে নাসা বা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য রোবট বানিয়ে লাভ কী? এই হলো সেই লাভ। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিয়ে এসে আমরা যে রকম কোম্পানি তৈরি করেছি, এমন কোম্পানি বিশ্বে খুব বেশি নেই। যদি ওই প্রতিযোগিতাগুলোয় না যেতাম, এসব প্রযুক্তি কখনোই আমরা আনতে পারতাম না।’
আপাতত দেশে কাজ করলেও ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে চায় তরুণ দলটি। রোবট তৈরি ও রোবটের মাধ্যমে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা তো আছেই, এখন শুধু মানোন্নয়ন করে এগিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য।