আয় ঘুম আয় রে

মডেল হয়েছেন বাবা আরিফুর রহমান ও ছেলে আ​িভন
মডেল হয়েছেন বাবা আরিফুর রহমান ও ছেলে আ​িভন

বারান্দা পার হয়ে সিঁড়ির নিচে ছিল একটা চেয়ার। বাবা খুব শখ করে চেয়ারটা কিনেছিল। কাঠের ফ্রেমে আটকানো লম্বা চেয়ার, যাতে শুয়ে থাকা যেত। নীল-সাদার মিশেলে কাপড়টা ছিল চেয়ারের। শুক্রবার বাবা সাদা গেঞ্জি, কমলা রঙের বাটিকের লুঙ্গি পরে শুয়ে থাকত সেটায়। চারপাশে বাতাস, আলো আর বাবার মুখে গুনগুন গান। আর বাবার বড্ড আদরের মেয়ে তিনটা থাকত আশপাশে, বিশেষ করে, ছোট পিচ্চি থাকত বুকের ওপর শুয়ে। পিচ্চির বয়স কত হবে আর, প্রায় এক বছর নয় মাস। পিচ্চির সবকিছুই বাবাকেন্দ্রিক। খায় বাবার সঙ্গে, ঘুমায় বাবার সঙ্গে, ঘুরেফিরে ওই বাবার সঙ্গেই সব। খুব প্রিয় বাবার কোলে বসে টইটই করে ঘুরে বেড়ানো, আরও প্রিয় বাবার ঘাড়ে মাথা দিয়ে বাবার গলায় ‘আয় ঘুম আয় রে...’ গান শুনতে শুনতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া। বড় বোন দুজন থাকলেও খেলাধুলা বরাবরের মতোই বাবার সঙ্গে, মায়ের খাবারদাবারের সময় ছাড়া আর তেমন কখনো খুব দরকার হয় না।
সেই এক বছর নয় মাসের পিচ্চি মেয়েটা হঠাৎ করেই একদিন দেখল, বাবা তো কথা বলছে না, গান করছে না, খালি ঘুমাচ্ছে আর ঘুমাচ্ছে...নাহ কোনো শব্দ নাই! কী জানি কী বুঝল পিচ্চি তো আর বাবার কাছে যায় না, হাত ধরে বড় বোন নিয়ে যেতে চায় কিন্তু না পিচ্চি যাবেই না। উত্তরে আধো আধো কণ্ঠে বলে, বাবা ঘুম...বাবা ঘুম! তারপরও মা জোর করায় সে বাবাকে আদর করে দিল। পরক্ষণেই আবার ছুটে এসে কার আড়ালে জানি লুকিয়ে গেল। মনে রাজ্যের প্রশ্ন আর চোখ খালি ঘুমিয়ে থাকা বাবার দিকে! একবার তো হাতটা ধরতে খুব ইচ্ছে করল। ওই কি হাতটা নাড়াল বাবা? নাহ! বাবা আর উঠল না...।
সেই বাবার মেয়ে বড় হচ্ছে, মায়ের আর বোনদের দুনিয়া এখন এই পিচ্চি, পিচ্চিটারও সব এঁরাই। কত কিছু হয়তো বলতে গিয়েও ঢোঁক গিলে ফেলে, কিছু হয়তো খুব করে বলে কিন্তু জোর করে না! বায়না করে না! পিচ্চির ঝাপসা মনে পড়ে কিছু ছবি, তা-ও খুব অস্পষ্ট। এর মধ্যে একটা হচ্ছে, ভরা জ্যোস্নায় ছাদে, নইলে কখনো বারান্দায় একচোট গান হয়ে যেত। সে থাকত বাবার কোলে বসে, বাবা বড় বোনকে গান শেখাত ‘ভালো আছি, ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’। কিন্তু এখন আর গান হয় না, হলেও ঘরে একা একা বসে বোন গান করে, আর হঠাৎ কেন জানি থেমেও যায়! ‘কী হলো, থামলে কেন?’ জিজ্ঞেস করলে বলে, চোখে কী জানি চলে গেছে! পিচ্চি রোজই বাবার ছবিটা দেখে, ভাবে তাইলে এ রকম দেখতে বাবা! অবাক হওয়ার কথাই পিচ্চির, কিচ্ছু মনে নেই! নাহ কিচ্ছু মনে নেই, শুধু মনে থাকে বোনের নইলে মায়ের বলা একটা কথা, ‘বাবা আছে তো, ওই যে আকাশে সবচেয়ে জ্বলজ্বল করছে যে তারা সেইটা তোর বাবা।’ এখনো খুব তারাভরা রাতে পিচ্চি মেয়েটা জ্বলজ্বল করা তারাটা খোঁজে...আর শত শত না-বলা কথার ঝাঁপি খুলে কত কী যে বলে...নিশ্চুপ আকাশ কালের সাক্ষী হয়ে রয়!
মিথিলা চক্রবর্তী