এই মায়েরা বাবাও বটে

প্রতিবছর মা দিবস আসে, বাবা দিবস আসে। ফাইজা ইসলামের মা বছরের এই দুই বিশেষ দিনেই উপহার পান। কেননা, তাঁর সন্তানদের কাছে তিনিই মা, তিনিই বাবা। এ গল্প নগরীর সংগ্রামী এক মায়ের। তিনি শারমিন সুলতানা। এদিকে ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানার উত্তরপাড়া (স্থানীয় নাম বেদেপাড়া) গ্রামের মা আলেয়া খাতুনেরও পরিবেশ–পরিস্থিতি আলাদা হলেও যুদ্ধটা অনেকটা যেন অবিকল। শোনা যাক মা আর বাবার দ্বৈত ভূমিকা পালন করা এই মায়েদের কথা।

১.  
২০০৩ সালের মে মাসের এক সুন্দর বিকেল। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া সাদিয়া সুলতানা খেলছিলেন পাড়ার অন্যদের সঙ্গে, বাড়ির উঠোনে। হঠাৎ তাঁদের কাপড়ের দোকানের একজন কর্মচারী তড়িঘড়ি করে বাড়িতে এসে খবর দিল, তাঁর বাবা অ্যাকসিডেন্ট করেছেন। মোটরসাইকেলকে ধাক্কা মেরেছে ট্রাক। কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি। মা মেয়েকে নিয়ে গেলেন কুষ্টিয়া। সেখানে তাঁর বোনের বাসায় মেয়েকে রেখে স্বামীকে নিয়ে গেলেন ঢাকা। তাঁকে ভর্তি করানো হলো রাজধানীর পিজি (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালে।

সাদিয়া পরদিন কুষ্টিয়া থেকে বাড়ি ফিরে এল। বাবা, মা, বড় ভাই—সবাই ঢাকায়। সে আর তাঁর ছোট ভাই বাড়িতে। ছোট্ট সাদিয়া ভাবল, বাবা সুস্থ হয়ে ফিরবে। তাই সে বাড়ির সামনে একটা বাগান করায় মন দিল। সাদিয়া সেই স্মৃতি আওড়ে বললেন, ‘আমার খুব স্পষ্ট মনে নেই। শুধু মনে আছে, আমি আব্বুর জন্য একটা বাগান করছিলাম। বাঁশের কঞ্চি কেটে এনে বেড়া দিলাম। আর এক সপ্তাহ পর আব্বুর লাশ ঢুকল সেই বাগানের ভেতর দিয়ে।’ শুরু হলো তিন সন্তান নিয়ে আলেয়া খাতুনের যুদ্ধ।

মায়ের সঙ্গে সাদিয়া
ছবি: সংগৃহীত

শুরুতে অনেকেই বলেছিল, ‘আমরা আছি তো, কোনো চিন্তা নেই।’ কিন্তু এক সপ্তাহের ভেতর দেখা গেল, তাঁরা কেউ নেই। ঘরে রইল আলেয়া খাতুন, তাঁর তিন সন্তান—সাদিয়া, ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া ছোট ছেলে ইমরান আর ক্লাস নাইনে পড়ুয়া বড় ছেলে লিমন। বাড়িতে ছিলেন শাশুড়ি। বাবাহীন এই ১৮ বছরে সাদিয়ার চাচা, মামা, খালারা ছিল তাঁর মায়ের সংগ্রামের সহযাত্রী। তবু সংকটের অভাব ছিল না।

আলেয়া খাতুনের বিয়ের এক যুগ পরে জন্ম নেয় বড় ছেলে লিমন। তাঁকে খুব আদর–যত্নে মানুষ করেছেন। সে সবচেয়ে ভালো পোশাক পরেছে, অফসেট পেপারে জেল পেন দিয়ে লেখা শিখেছে। স্বামী মারা যাওয়ার পরেও আলেয়া খাতুন তাঁর বড় ছেলেকে কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দেননি। যেভাবে এত দিন চলে এসেছে, সেভাবেই চলতে লাগল। লিমন এসএসসির পর যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ভর্তি হলো। তারপর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে। এখন সেই লিমন দুই পুত্রের বাবা, বিসিএস দিয়ে সরকারি ডাক্তার হয়েছেন, পিজিতে এমএস করছেন।

সাদিয়া একটু বড় হতেই আসতে থাকল বিয়ের প্রস্তাব। সবাই তার অভিভাবকত্ব নিতে চায়। গ্রামের ও আশপাশের গ্রামের ‘জমিওয়ালা’ বয়স্করা ‘বাবা মরা’ সাদিয়াকে বিয়ে করে উদ্ধার করতে চায়। সেসব শক্ত হাতে সামলেছেন আলেয়া খাতুন। একপর্যায়ে মেয়েকে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার জন্য পাঠিয়ে দিলেন শহরে, বোনের কাছে। সেখান থেকে সাদিয়া ভর্তি হলো রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থনীতি নিয়ে পড়তে পড়তেই সে কাজ পায় লন্ডনভিত্তিক একটা আন্তর্জাতিক এনজিওতে। এখন সমানতালে চলছে পড়াশোনা আর চাকরি। সঙ্গে শখের একটা ব্যবসাও চালাচ্ছেন।
ছোট ছেলে ইমরান প্রায় পুরোটা সময় মায়ের সঙ্গেই ছিল। এ জন্য সে ভর্তি হয় কুষ্টিয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাড়ি থেকে পড়াশোনা শেষ করে সম্প্রতি তিনি গাজীপুরে চাকরি করছেন।

তিন সন্তানের সঙ্গে আলেয়া খাতুন
ছবি: সংগৃহীত

আজ সন্তানেরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। শাশুড়ি মারা গেছে দুই বছর হলো। এখন তিনি বিশাল এক গেরস্ত বাড়িতে একা। শক্ত দুই হাতে কত কিছু সামলেছেন এক জীবনে। স্বামী মারা যাওয়ায় পর জানা গেল, ব্যবসায় অনেক দেনা রেখে গেছেন। সেগুলো কেবল তাঁর স্বামী নুরুল ইসলামই জানতেন। ব্যবসার সব দেনা চুকিয়ে দোকান চালানোর ভার দিলেন এক ভাগনেকে। দুই বছর লোকসানের পর দোকান ভাড়ায় দিয়ে দিলেন। যে মানুষ সংসারের রাজরানি হয়ে থেকেছেন, কোনো দিন জানেননি টাকা এসেছে কোত্থেকে, সেই তিনি নিলেন পরিবারের সব দায়িত্ব। শুরু করলেন সেলাই মেশিনের কাজ। গরু পালতেন। পুকুরে মাছ চাষ করেছেন। মুরগির খামার করেছেন। শাকসবজি চাষ করেছেন। ফলের মৌসুমে গাছের ফল বিক্রি করেছেন। নারকেল, সুপারি বিক্রি করেছেন। আর ঘরের কাজ তো ছিলই। সম্প্রতি রোকেয়া দিবসে এই মা হাতে তুলেছেন শৈলকুপা পৌরসভা থেকে রত্নগর্ভা মায়ের পুরস্কার।

আলেয়া খাতুনকে ফোন করে তাঁর জীবনসংগ্রাম নিয়ে জানতে চাইলে বললেন, ‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি, এখনো যা করার করছি। ওরা সবাই বড় হইছে। প্রতিষ্ঠিত। আমার কারও কাছ থেকে কিছু চাওয়ার নেই। কেবল ওরা সুখে থাকুক। এ–ই আমার একমাত্র চাওয়া। একা আছি। প্রথম কদিন একটা মহিলা রাখছিলাম। শুধু শুধু টাকা খরচ। তাই বাদ দিয়ে দিয়েছি। হাঁটুতে ব্যথা। ডাক্তার বলে কমোডে বসতে। কমোডে বসা আমার পছন্দ না। ইদানীং রাতে ঘুম হয় না। সেলাই মেশিন চালাই। গরু, মুরগি আছে। প্রতিদিনের রান্না আছে। দিন চলে যায়। ওরা (সন্তানেরা) ভালো আছে, এই আমার ভালো থাকা। আলাদা করে আর কী ভালো থাকব। ’

২০০৭ সালের জুলাইয়ে ঢাকা শহরের এক দোতলা বারান্দা থেকে অপেক্ষা করছিল এক জোড়া উৎসুক চোখ। সেই চোখ ফাইজা ইসলামের। তিন ভাই–বোনের মধ্যে সে সবার বড়। একটা গাড়ির জন্য ছিল তার সেই অপেক্ষা। ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া ফাইজা ইসলাম তার ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে বসে ছিল। সেই গাড়িতে করে হাসপাতালে যাওয়ার কথা তাদের। বাবা অসুস্থ। মা সেখানেই। তারা তিন ভাই–বোনও যাবে দেখতে। এ জন্যই গাড়ি নিতে আসবে।

কিন্তু গাড়ি আর আসে না। হঠাৎ সাইরেন বাজিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স এল। অ্যাম্বুলেন্স থেকে বেরিয়ে এলেন ফাইজার মা। সন্তানদের তিনি কথা দিয়েছিলেন, ওদের বাবাকে নিয়ে ঘরে ফিরবেন। সেই কথা তিনি রাখতে পারেননি। তাই অনবরত চিৎকার করে বলে যাচ্ছেন, ‘আমি আমার বাচ্চাদের কী বলব? ওদের বাবাকে আমি বাঁচাতে পারলাম না।’ সব দেখেশুনে কিছুই বুঝতে পারছে না ফাইজা। হঠাৎ সে মূর্ছা গেল। তারপর সেই সময়ের স্মৃতি খুব একটা মনে নেই তার।

মা শারমিন সুলতানার সঙ্গে ফাইজা
ছবি: সংগৃহীত

ফাইজারা দুই বোন, এক ভাই। ছোট বোন তাহিয়ার বয়স তখন ৭, ভাই আদদান তখন ১১ মাসের শিশু। ফাইজার মা শারমিন সুলতানা দুই মেয়ে আর ছেলেকে নিয়ে ঢাকা ছাড়লেন। তাঁর মায়ের বাড়ি কুষ্টিয়া। আত্মীয়স্বজনের অনেকেই সেখানে। তাই তাঁদের ঠিকানাও হলো সেখানে। একটা বাসা ভাড়া নিলেন। নতুন বাসায় ফাইজার আত্মীয়স্বজন অনেকেই ছিল। ঘরবাড়ি গুছিয়ে নিয়ে ওই দিন শারমিন সুলতানা গোসল করে বের হলেন। আত্মীয়দের একজন রঙিন পোশাক নিয়ে সাদা শাড়ি ধরিয়ে দিল পরার জন্য। ওই দিনের কথা মনে করে ফাইজা বললেন, ‘আম্মা সাদা রঙের শাড়ি পরে বের হলো। আমার মনে হলো, এই আম্মিকে আমি চিনি না। আমার আম্মিকে অন্য মানুষ লাগছিল।’ বাচ্চাদের নতুন শহরে নতুন স্কুলে ভর্তি করালেন শারমিন। শুরু হলো তাঁর এক অন্য জীবনসংগ্রাম।

মায়ের সঙ্গে ওরা তিন ভাই বোন
ছবি: সংগৃহীত

শারমিনের শ্বশুর মারা গেছেন অনেক আগে। তাঁর মায়ের বিয়ের আগে। তার বাবা যখন এইসএসসির ছাত্র। এক ছেলে আর দুই মেয়েকে তিনি একা হাতে বড় করেছিলেন, প্রতিষ্ঠিত করে সবার বিয়ে দিয়েছিলেন। একমাত্র ছেলের মৃত্যুর শোক তিনি সইতে পারেননি। ছেলে মারা যাওয়ার ৯ মাস পর তিনিও মারা যান। মৃত্যুর আগে ছেলের বউয়ের হাত ধরে তিনি বলেছিলেন, ‘বউমা, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অনেক ঝড় আসবে। তুমি শক্ত হাতে সব সামলাবা। আমার নাতি–নাতনিদের নিয়ে কারও দুয়ারে সাহায্য চাবা না। ওরা ঠিক মানুষ হবে।’ এই কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে মেনেছেন শারমিন। তাঁরা সন্তানদের নিয়ে তিনি কখনো কারও দরজায় হাত পাতেননি। নিজের অধিকার বুঝে নিতে লড়াই করেছেন। একটাতে ব্যর্থ হয়ে আরেকটায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। থামেননি।

মা শারমিন সুলতানার সঙ্গে ফাইজা
ছবি: সংগৃহীত

ফাইজা এখন লেখাপড়া শেষ করে চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার গড়েছে। গড়েছে নিজের প্রতিষ্ঠান। বাচ্চাদের আঁকা শেখার জন্য ঘরেই স্কুল বানিয়েছে। এ জন্য ছায়াও দিয়েছেন তাঁর মা। ফাইজা বললেন, ‘আমি সবকিছু থেকে আশ্রয় খুঁজতাম ছবি আঁকায়। আমি যতক্ষণ আঁকতাম, সব ভুলে আমি খুশি থাকতাম। আর আম্মু আমি কী আঁকতাম, দেখত। আর বলত, আমি অন্যের ক্ষতি না করে যা করে খুশি থাকি, তা–ই যেন করি।’

ফাইজা এখন আলোকচিত্রী স্বামীর সঙ্গে ফিরেছেন তাঁর ছোট্টবেলার শহর ঢাকায়। এই শহরেই পেতেছেন সংসার। ছোট বোন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ছোট ভাই ক্লাস সেভেনে। মায়ের সঙ্গে কুষ্টিয়ায়।

স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে অনেক সংগ্রাম করেছেন শারমিন সুলতানা। ১৪ বছর কেটে গেল। এখন অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছেন। তবে থামেনি জীবনসংগ্রাম। ধাক্কা খেয়েছেন, উঠে দাঁড়িয়েছেন, বিরতি নিয়েছেন, তবে কখনো হার মানেননি। তাই বাবা দিবসে এই ‘একের ভেতর দুই, মায়ের ভেতর বাবা’দের একটা বিশেষ অভিবাদন তো প্রাপ্যই!