কিছু যদি না-ই থাকে, সে তোর দিকে ওভাবে তাকাল কেন...
‘কিছু যদি না-ই থাকে, সে তোর দিকে ওভাবে তাকাল কেন...’
‘তোর দিকে তাকিয়ে ওর হাসির ধরনটা দেখ, একটা বিশেষ ব্যাপার আছে কিন্তু...’
‘সব সময় সে তোর দিকে তাকিয়ে থাকে, এসবের মানে নেই বলতে চাস...এসবের মানে বুঝিস তুই?’
কথাগুলো ভেতরের ভিতটা টলমল করে দিয়েছিল, খানিকটা নাড়িয়ে দিয়েছিল আমাকে। অনেক দিন ধরে বন্ধুবান্ধবের এত সব লাল-নীল কথায় আমার বুকের ভেতরে কি সুবাসে রাঙায়নি? সুরে-বেসুরে আমি কি গাইনি ‘ভালোবাসা তারপর দিতে পারে গত বর্ষার সুবাস!’
বলা ভালো, খুশবুটি অবশ্যই গত বর্ষার ছিল না, মন ভরে গিয়েছিল অতীত নয়, প্রচণ্ড এই ‘এখন’ গন্ধে। কী যে সেই উন্মাতাল অনুভব! এরপর মেয়েটির ওই হাসির ভেতরে চিড়েচ্যাপ্টা হতে হতে মনে হতো এই মরণ, এই দহনেও তো আছে ঢের শান্তি! তারপর সে মেয়ের হাসি বা চাহনির ধরন কাটাছেঁড়া করে কত কিছু যে পেতাম! হৃদয় বলত, বসরার গোলাপ ফুটে আছে ওই মেয়েটির কাছে, ওর হাসি ও চাহনির সৌরভে!
এভাবেই প্রেম হয়েছিল আমার। আমাদের। এ জন্য কাঠখড় তেমন পোড়াতে হয়নি। আমাদের প্রেমের ক্ষেত্রে কাঠখড় যা পুড়িয়েছিল, সেটি আমার বন্ধুরাই। বন্ধুদের এই প্রণোদনা তথা ‘পিআর প্রেশার–কে মজা করে ‘পেয়ার প্রেশার’ বললে খুব ভুলচুক হবে কি!
তো বন্ধুদের সেই ‘পেয়ার প্রেশার’ বা প্রণোদনায় প্রেম না হলে আমাদের এই প্রেমের গল্পের শেষে হয়তো লেখাও হতো না রূপকথার সেই অমর চরণ, ‘অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল।’
আমার নিজের নাম ধরে এই যে গল্প বললাম, আদতে গল্পটি কিন্তু আমার নয়। চারপাশের আরও অনেকের প্রেমের গল্পেই বন্ধু ও কাছের মানুষদের এমন ‘ইন্ধন’ থাকে। বন্ধুদের ক্রমাগত উসকানিতে দুজন দুজনের কাছে এসেছেন—সমাজে এমন নজির ভূরি ভূরি। ফলে আমার বলে যে গল্পটি শুরু করেছিলাম, সেখান থেকে সরে চলুন এবার ঢুকে পড়া যাক সায়েম আর জিনিয়ার গল্পে। সায়েম ও জিনিয়া নাম দুটি অবশ্যই ছদ্মনাম। কিন্তু তাদের ঘটনাগুলো এক বিন্দু মিছে নয়।
ঘটনাটি তিন-চার বছর আগের। সায়েম আর জিনিয়া একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত ভিন্ন বিভাগে। তবে তাদের দেখা হয়েছিল একসঙ্গে একটি ব্যান্ড করতে এসে। সায়েম ছিল ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট এবং জিনিয়া ভোকালিস্ট ও লিরিসিস্ট। তাদের মধ্যে আলাপ-পরিচয় ছিল, ছিল বন্ধুত্বও। কিন্তু প্রেম ‘ধরো ধরো যদি হঠাৎ সন্ধে/ তোমার দেখা আমার সঙ্গে/ মুখোমুখি আমরা দুজন’—মুখোমুখি বসে থাকার এমন প্রণয় ছিল না মোটেই। এমনকি প্রেমের ভাবনাও ছিল না দুজনের মধ্যে।
সেটি ঘটিয়েছিল ব্যান্ডের অন্য বন্ধুরাই। আর সেই গল্পও এমন বিশেষ কিছু নয়। একদিন এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় ব্যান্ডের প্র্যাকটিস শেষে কোনো কিছু না ভেবেই সায়েমকে জিনিয়া বলেছিল তাকে একটু বাসায় পৌঁছে দিতে। ব্যস, কাণ্ড ঘটে গেল, আগুনে ঘি পড়ল। সায়েমের চারপাশে শুরু হলো বন্ধুদের ফিসফাস, জিনিয়া যদি তোকে পছন্দই না করে, তবে তোকেই বাসায় পৌঁছে দিতে বলল কেন!
কাহিনির নটেগাছটি কি এখানেই মুড়াল? এরপর থেকে ক্রমাগত শুরু হলো একজনের কাছে আরেকজন সম্বন্ধে ইতিবাচক ধারণা দেওয়া। ছেলেটি মেয়েটির জন্য কতটা দিওয়ানা, মেয়েও ছেলের জন্য কতটা পাগল—এই সব নানা বর্ণের ‘লাভ ফ্লাওয়ার’ ফোটাতে ফোটাতে ছেলে আর মেয়ের মনের মধ্যে আস্ত বাগান জাগিয়ে তোলে বন্ধুরা। হ্যাঁ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদেরকেই দেখা যায় এই বাগানের মালির ভূমিকায়।
এমনভাবে কোনো এক মালি হয়তো জিনিয়াকে বলেছিল, সেদিন সায়েম তোর দিকে তাকিয়ে কেমন উদাস হয়ে ‘শহরের উষ্ণতম দিনে’ গানটা বাজিয়েছিল...তোকে মুগ্ধ করার জন্য বেচারা কী-ই না করছে! আর তুই? তোর কোনো উইচুই-ই নেই। হার্ট বলে কিছু নেই রে তোর...
ওদিকে সায়েমের আশপাশেও শুরু হয় বন্ধুদের একই রকম গুঞ্জন।
ফলাফল রূপকথার সেই অন্তিম বাক্যের স্মরণ নিতে হয় আবার, ‘তাহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল।’
তবে বন্ধুদের মালিগিরির ফলে প্রেমের যেসব বাগান তৈরি হয়, তার সবই যে সুখে-শান্তিতে বসবাস করে এমন তো নয়, মুহূর্তের আবেগে আর বন্ধুদের প্রচেষ্টায় যে প্রেম ঘটে, কখনো-সখনো তা ভেঙেও যায়, মনের মিল, মতের মিল, অবস্থানগত দূরত্ব—কতশত কারণ থাকে এর পেছনে।
আমার বন্ধু মাইশা ও ইমুর (ছদ্মনাম) কথাই ধরুন। আমরা তাদের দুজনের সুতো এক করে দিয়েছিলাম। পরে সেই সুতো পাকিয়ে পাকিয়ে চার বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর বিয়ের সানাই বাজল তাদের।
কিন্তু বছর দুই ঘুরতে না ঘুরতেই ঠাস করে ভেঙে পড়ল ওদের ঘর।
কেন এমন হলো? জিজ্ঞাসা করতেই মাইশা আর ইমু—দুজনই দিয়েছিল করুণ স্বীকারোক্তি, এত বছরেও একে অপরকে আমরা বুঝতে পারিনি, চাওয়া-পাওয়ায় খুবই অমিল দুজনের।
প্রেম ও বন্ধুত্ব বিশ্লেষণ করে বহু আগে মোক্ষম একটা কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাইশা ও ইমুর কাহিনির অন্তে ‘এখান থেকে কী শিখিলাম’—এমন প্রশ্ন এলে ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’তে বলা রবিবাবুর অমলিন এই কথাগুলোকে অবলীলায় ‘শিক্ষা’ হিসেবে ব্যক্ত করা যায়, ‘বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদার্থ বুঝায়। দুই জন ব্যক্তি ও একটি জগৎ। অর্থাৎ দুই জনে সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা। আর, প্রেম বলিলে দুই জন ব্যক্তি মাত্র বুঝায়, আর জগৎ নাই। দুই জনেই দুই জনের জগৎ। অতএব বন্ধুত্ব অর্থে দুই এবং তিন, প্রেম অর্থে এক এবং দুই।’
তাই প্রেম যেহেতু ‘এক এবং দুই’, এজন্য বন্ধুদের প্রণোদনায় আকছার যেসব প্রেম ঘটে, তার ক্ষেত্রে একটি সতর্কতা বাতলেছেন মনোরোগবিদেরা—প্রেমের আগে ভাবুন, ভাবুন...এরপর সাড়া দিন। প্রেম হোক, দুজনের সম্মতি থাকলে এটি মন্দ নয় মোটেও, কিন্তু নিজেদের বোঝাপড়া যেন এক শতে এক শ হয়।
আর প্রেমে ও বোঝাপড়ায় এক শতে এক শ-এর যোগ ঘটলে তবেই না বলা যাবে প্রথম আলো উপন্যাসে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই কথাগুলো:
‘তারপর ওরা হাত ধরে চুপ করে বসে রইল। আর কোনও কথা নেই, সমস্ত কথার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। ওরা বসেই রইল। ঘাট ক্রমশ নির্জন হয়ে আসছে। বাতাস বইছে বেশ জোরে। বজরাগুলোও ফিরে যাচ্ছে। সবাই ঘরে ফিরছে। এই দুজনের যেন কোনও ঘরবাড়ি নেই, কোথাও ফিরতে হবে না। এ রকম একটি অনন্তকালের দৃশ্য হয়ে ওরা বসেই থাকবে।’