চলছে বিয়ের মৌসুম। চারপাশে গানবাজনার আওয়াজ শোনা যায়। বিয়ে মানেই তো নতুন অধ্যায়। জীবনে আসে নতুন মানুষ। পরিচয় হয় নতুন এক পরিবারের সঙ্গে। ছেলে-মেয়ে উভয়ের জীবনেই যোগ হয় নতুন স্বপ্ন। নিজেদের ইচ্ছাগুলো ঢেলে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দুজনেই। দুটি মানুষ মিলে তখন একই স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটে। বিয়ের পর নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতেও শিখতে হয়।
তরুণদের কাছেও বিয়ে এক কৌতূহলের বিষয়। তাই তাদের আড্ডায় বিয়ের গল্প প্রায়ই চলে আসে। একেকজন জানায় বিয়ে নিয়ে তাদের স্বপ্ন। সেখানে দেখা যায় ভিন্নতা। জীবনসঙ্গী বেছে নিতেও নানান জল্পনা-কল্পনা তারা করে। তাই তো একসময় ছিল পরিবারের পছন্দের বিয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। এখন পাত্র-পাত্রী নিজেরাই পছন্দ করছে একে অপরকে। পরে নিজেদের ধর্ম, সমাজ আর সংস্কৃতি মেনেই বিয়ে করছে। সমাজের স্বীকৃতি লাভে পালন করছে নিয়মকানুন। যাকে আমরা বলি বিয়ে।
কিন্তু আজকাল বিয়ের মাধ্যমে সম্পর্ক যেমন গড়ছে, তেমনি বিচ্ছেদও দেখা যাচ্ছে। কীভাবে বিয়ের মতো মধুর সম্পর্কটি ভেঙে যায়? এর পেছনের কারণইবা কী? এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং বিবাহ ও পরিবার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা ইকবাল বললেন, বিগত পাঁচ বছরে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যাটা বেড়েই চলছে। কারণ, নারীদের ব্যক্তিত্ববাদ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এটি হতে পারে বিভিন্ন চ্যানেলে যে নাটক, সিনেমাগুলো হচ্ছে, সেগুলোর ফলে। আবার নারীর অবস্থান নিয়ে যে লেখালেখি, সেটা আগের চেয়ে বেড়ে যাওয়ার কারণে।
ড. ফাতেমা রেজিনা ইকবাল আরও বলেন, নারীরা এখন নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে খুবই সচেতন। আর এ সচেতনতার বৃদ্ধিই বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ।
সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণেও বিয়েতে ভাঙছে বলেই অভিমত ড. ফাতেমা রেজিনা ইকবালের। বিষয়ের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, যেমন স্বামী ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে টাওয়েলটা স্ত্রীর নাকে সামনে ঝাড়া দেয়, কিন্তু সেটির অনুভূতি স্ত্রীর ভালো লাগে না। এমন ঘটনাগুলো থেকেও বিয়ের সম্পর্কের অবনতি হতে হতে একসময় বিচ্ছেদে গড়ায়।
পাশাপাশি ফাতেমা রেজিনা ইকবাল উল্লেখ করেছেন, নারীদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিও হতে পারে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ। তিনি বলেছেন, আগে নারীরা ঘর থেকে বের হতে পারতেন না। কিন্তু আজকের দিনে তাঁরা মুদি দোকানে কাজ করছেন, তরকারি পর্যন্ত বিক্রি করছেন। এমনকি নিম্নবিত্ত পরিবারের নারীরাও আজ বসে নেই। বর্তমানে নারীদের অনলাইন বিজনেস বেড়ে গিয়েছে। ফলে নারীরা সংসারে মতামত দিতে পারছেন, যেটি উচ্চবিত্ত থেকে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত নারীদের পারিবারিক জীবনে পরিবর্তন এনেছে।
করোনাকালে বিবাহবিচ্ছেদের কারণগুলো সম্পর্কে ড. ফাতেমা রেজিনা ইকবালের বক্তব্য, করোনা মহামারি আকার নিলে অনেকের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। সংসারেও অভাব দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে বেড়ে গিয়েছে স্বামী-স্ত্রীর বাগ্বিতণ্ডা। একপর্যায়ে মারধরের পর্যায়েও গড়িয়েছে। কথায় আছে, যখন অভাব আসে, তখন ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়। কর্মহীনতা, অভাব-অনটন এবং গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে পরিবর্তন আনছে। যার পরবর্তী ধাপ হয় বিচ্ছেদের মতো ঘটনা।
অন্যদিকে, করোনা থেকে বাঁচতে স্বামী-স্ত্রী অধিক সময় একত্রে বাসায় থাকছেন। এতে একে অন্যের সব জিনিসপত্রে প্রবেশাধিকার বেড়েছে। তাই যদি কারও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থাকে, সেটাও লুকানো কঠিন হয়ে যায়। আবার একজনের আচরণ থেকেও অন্যজন সন্দেহে পড়ে যায়। তখন উভয়ের অবিশ্বাস বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। ফলে, বিচ্ছেদের সংখ্যাটা আরও ভারী হতে থাকে।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; পাঠাগার সম্পাদক, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা।