ঢুঁ মারলেই হাজারো পাত্রপাত্রী

এক মেয়ের জন্য মা কোথায় বর খুঁজবেন, তা ভাবছেন। মেয়ের বাবা স্মার্টফোনটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই দ্যাখো হাজারো পাত্র। মায়ের চিন্তা নিমেষেই উধাও। বলা বাহুল্য, বিজ্ঞাপনটি একটি মেট্রিমোনিয়াল সাইটের।

প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের জীবন এখন প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। পুরো পৃথিবীটাই যেন হাতের মুঠোয়। এক ক্লিকেই সব খবর দোরগোড়ায় হাজির। কী খাব? কোথায় ঘুরব? কোন হোটেলে থাকব? আলাদিনের দৈত্যের মতো ইন্টারনেট বলে দেয় সবকিছু। আড্ডা আর প্রেমও চলে স্মার্টফোনের স্ক্রিনে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাটের অবাধ সুযোগ। বন্ধুদের মুখগুলো ঘুরেফিরে আসে হরহামেশা। বিয়েটাই-বা বাদ থাকে কেন? সে জন্য আছে অনলাইন ডেটিং সাইট বা মেট্রিমোনিয়াল সাইট।

ইকোনমিস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ২০ কোটি মানুষ প্রতি মাসে ডিজিটাল ডেটিং করে। যুক্তরাষ্ট্রে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি বিয়ে হয় ডেটিং সাইটের মাধ্যমে। চীন ও জার্মানিতেও ডেটিং সাইটে বিয়ে বা প্রেম জমজমাট। বাংলাদেশ, ভারতেও রয়েছে মেট্রিমোনিয়াল সাইট।

বিশ্বে অনলাইন ডেটিং ব্যবসা দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। প্রতিযোগিতাও বাড়ছে। এই ব্যবসায় ৪০০ কোটি ডলারেরও বেশি আয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেটিং সাইট টিন্ডার প্রতিযোগিতার বাজারে সবচেয়ে এগিয়ে। টিন্ডারের মতো আরেকটি ডেটিং অ্যাপ বাম্বল। এই সাইটগুলো থেকে সে দেশে রাজস্ব এসেছে প্রায় ১০০ কোটি ডলার।

ফেসবুকও এই বাজারে ঢুকবে। অনেক ডেটিং সাইট ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তাদের লিংক শেয়ার করছে।

চীনের অন্যতম জনপ্রিয় ডেটিং সাইট তানতান। ইউ ওয়াং ২০১৫ সালে এটি চালু করেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তানতানের ব্যবহারকারী ছিল দুই কোটি। এই সাইট ব্যবহার করে এক কোটি মানুষ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।

প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ডেটিং সাইটগুলোয় বাড়ছে বৈচিত্র্য। নারীদের জন্যও আলাদা ডেটিং সাইট রয়েছে। এমনকি মুসলিম, খ্রিষ্টান, ট্রাম্প সমর্থক, ভিগানদের জন্যও রয়েছে আলাদা সাইট। বাইকারকিস, ফার্মাসঅনলি, আগলি বাগ বল—এ রকম কিছু ডেটিং সাইট।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণে বাংলাদেশ ও ভারতে ডেটিং সাইটের ব্যবহার নেই বললেই চলে; বরং এ ধরনের সাইটগুলো পরিচিত মেট্রিমোনিয়াল সাইট হিসেবে। বিবাহ বিডি, সেনসিবল ম্যাচডটকম, বরবধূ ডটকম এ রকমই কিছু মেট্রিমোনিয়াল সাইট। আট থেকে নয় বছর আগে সাইটগুলোর যাত্রা শুরু। ঢুঁ দিয়ে দেখা যায়, হাজারো পাত্রপাত্রীর প্রোফাইল। রেজিস্ট্রেশন থাকলে যেকোনো পাত্র বা পাত্রীর বয়স, উচ্চতা, ওজন, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পছন্দ, অপছন্দ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। হাজারজনের মধ্যে পাত্র বা পাত্রী নিজের পছন্দমতো জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পারেন। তবে তথ্যের যথার্থতা ঠিক না রাখলে মেট্রিমোনিয়াল সাইটগুলো গ্রহণযোগ্যতা হারায়।

আমাদের দেশে মেট্রিমোনিয়াল সাইটগুলোর টার্গেট গ্রুপ রয়েছে বলে জানালেন বিবাহ বিডির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সিইও জি এম ফ্রেজার। যাঁরা শিক্ষিত, প্রগতিশীল ও প্রযুক্তিবান্ধব, তাঁরাই এ ধরনের সাইটের ব্যবহারকারী। আবার ব্যবহারকারীদেরও রকমভেদ রয়েছে। অনেকে স্রেফ বিনোদনের জন্যই মেট্রিমোনিয়াল সাইটে সময় কাটান। তাই যাচাই-বাছাই করে ব্যবহারকারীদের প্রোফাইল অ্যাক্টিভিট করে বিবাহ বিডি। রেজিস্ট্রেশনের জন্যও আছে কড়াকড়ি। জাতীয় পরিচয়পত্র, প্রবাসীদের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট যাচাই-বাছাই করা হয়। দিনে গড়ে ১২০ থেকে ১৩০টি রেজিস্ট্রেশন হয়। যাচাই-বাছাইয়ের পর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ প্রোফাইল অ্যাক্টিভিট করা হয়।

মেট্রেমোনিয়াল সাইটে পাত্রপাত্রী চাইলে নিজেরাই যোগাযোগ করতে পারেন। আবার চাইলে অভিভাবকের মাধ্যমেও যোগাযোগ হয়। লগইন করার পর পাসওয়ার্ড দেওয়া হয় ব্যবহারকারীকে। প্রোফাইলের সঙ্গে মিলে যায়—এমন পাত্র বা পাত্রীর খোঁজ ই-মেইল, মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে মেট্রিমোনিয়াল সাইটগুলো দিয়ে থাকে। এক কথায় ম্যাচমেইড সম্পর্কে ব্যবহারকারীকে ওয়াকিবহাল রাখার কাজটা তারাই করে।

মেট্রিমোনিয়াল সাইটগুলোর ব্যবসায়িক প্রসারের ক্ষেত্রে বড় বাধা বিনিয়োগের অভাব। জি এম ফ্রেজার বলেন, ‘পুরোটাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে চলে। তাই পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো মেট্রিমোনিয়াল সাইটের ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠেনি আমাদের দেশে। আবার কিছু মেট্রিমোনিয়াল সাইট বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়। ফলে গ্রহণযোগ্যতা হারায়।’

মেট্রিমোনিয়াল সাইটের প্রসারে কিছুটা এগিয়ে আছে প্রতিবেশী ভারত। ম্যাচ ডটকম, ভারত মেট্রিমোনি, মেট্রিমোনি ডটকম জনপ্রিয়। মেট্রিমোনি ডটকম ভারতের আলাদা রাজ্যগুলোর জন্য আলাদা সাইটের প্রচলন করেছে। যেমন বাঙালিদের জন্য রয়েছে বেঙ্গলি মেট্রিমোনি। ইকোনমিস্টের এক খবরে জানা যায়, গত বছর ভারতীয় ম্যাট্রিমোনি ডটকমের আয় সাত কোটি ডলারে পৌঁছায়।

সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে প্রাচ্যে মেট্রিমোনিয়াল সাইটের ব্যবহার কিছুটা কম। তবে পাশ্চাত্যের সমাজতাত্ত্বিকেরা বলছেন, অনলাইন ডেটিং সাইটের মাধ্যমে বিয়ে বেশি টেকসই হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিএফকে কয়েক বছর পরপর দম্পতিদের জীবনযাপন-বিষয়ক জরিপ চালান। ক্যালিফোর্নিয়ার স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক টমাস ও মাইকেল রোজেনফেল্ড এ রকম এক জরিপে জানান, অনলাইনের মাধ্যমে যাঁদের বিয়ে হয়েছে, তাঁরা তুলনামূলকভাবে সুখী জীবন যাপন করেন। অনলাইন ডেটিং সাইট বাম্বলের সমাজতাত্ত্বিক জেস কার্বিনো বলেন, অনলাইন ডেটিং সাইটে অনেকের মধ্যে থেকে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের সুযোগ থাকে। ফলে নির্বাচনটাও ভালো হয়।

আমাদের দেশে ভাবনাটা কেমন? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, মেট্রিমোনিয়াল সাইটে বিয়ের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই রকম প্রভাবই আছে। তিনি বলেন, এখন ব্যস্ততার যুগ। মানুষে মানুষে যোগাযোগটা হয় ভার্চুয়াল জগতে। নগরজীবনে মানুষের প্রতিবেশী বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ কম। সে ক্ষেত্রে আগে যেমন প্রতিবেশী বা স্বজনেরা বিয়ের ঘটকালি করতেন, এখন সেই কাজটা অনেক সময় করছে মেট্রিমোনিয়াল সাইটগুলো। এটা একধরনের প্রয়োজন অবশ্যই মেটাচ্ছে। তবে মেট্রিমোনিয়াল সাইটগুলোকে দায়িত্বশীল হতে হবে। অসদুপায় অবলম্বন বা ভুল তথ্য দেওয়া যাবে না। তাহলে এর প্রভাব ইতিবাচক হবে।

মানুষের সম্পর্ক বা যোগাযোগও এখন অনেক বেশি হয় অনলাইনে। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে প্রযুক্তি। তবে প্রযুক্তির ব্যবহারে সচেতনতার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে আমাদের। তবেই প্রযুক্তি হবে কল্যাণকর।