দূরবর্তী দাম্পত্য

ছবি: পেকজেলসডটকম

‘দূরত্ব যদি সত্যি সত্যিই ভালোবাসার গভীরতা বাড়িয়ে দেয়, তবে আমি দূরেই থাকতে চাই’, শেষের কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত এই লাইনের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। মনের মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকলেই যে ভালোবাসা কমে যায়, এমনটা রবিঠাকুর বিশ্বাস করেন না বলেই হয়তো এমন করে লিখেছেন তিনি। বর্তমান আধুনিক সময়ের জীবনযাপনে চাকরি কিংবা নানা কারণে স্বামী-স্ত্রীকে একে অন্যের পাশাপাশি থাকতে দেয় না। দুজন থাকেন একই দেশের কিংবা একই পৃথিবীর দুই প্রান্তে। লং ডিসটেন্স ম্যারেজ লাইফ বা দূরবর্তী বৈবাহিক জীবন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে খুব বেশি অচেনাও নয়। অর্থনৈতিক কারণে দেশের লাখো মানুষ স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে দূরের কোনো দেশে অবস্থান করে থাকেন বছরের পর বছর। এই দূরত্বের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কিছু সমস্যা তো তৈরি হয়। কিন্তু উভয়ের বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে কিছু কাজ নিয়মিত করলেই টানাপোড়েনের উদ্ভব হয় না।

একে অন্যকে সময় দিন, সময় করে

ছবি: পেকজেলসডটকম

আমেরিকান মনস্তাত্ত্বিক গবেষক জন গটম্যান তাঁর ‘দ্য সেভেন প্রিন্সিপালস ফর মেকিং আ ম্যারেজ ওয়ার্ক’ গ্রন্থে লিখেছেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুন্দর ও প্রেমময় সম্পর্ক গড়ে উঠতে দৈনিক অন্তত পাঁচ ঘণ্টা সময় নিজেদের মধ্যে কাটানো উচিত। কিন্তু দূরবর্তী বৈবাহিক জীবনে কি তা সম্ভব? কিছুটা হলেও সম্ভাব্যতা তৈরি করে দিয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। ইন্টারনেট ও মোবাইলের কল্যাণে অনেক দূরের মানুষও এখন বেশ কাছেই থাকেন। কেউ কারও কাছে যেহেতু নেই, তাই একে অন্যকে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে, সময় করে ফোন দেওয়া উচিত, কথা বলা উচিত। ভিডিও কলের যুগে এখন দেখা-সাক্ষাৎ হওয়াটাও খুব কষ্টের নয়। নিয়ম করে দিনের একটা সময় কথা তো বলবেনই, পাশাপাশি সপ্তাহের একটি দিন, হতে পারে শুক্রবার রাতের একটি সময় দীর্ঘ আলাপনের বিষয়ে ঠিক করে রাখুন। তবেই দেখবেন আপন মানুষটি দূরে থেকেও কাছেই আছে মনে হবে।

ইন্দ্রিয়কে জাগ্রত রাখুন

ছবি: পেকজেলসডটকম

বর্ণ, গন্ধ, শব্দ, স্বাদ ও স্পর্শ—আমাদের এই পাঁচ মৌলিক ইন্দ্রিয় প্রেমময় সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাগ্রত হয়। নারী-পুরুষের সুন্দর সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় সচল রাখার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই মনের মানুষ যখন কাছেই নেই, তখন কী হয়। আনন্দমুখর লং ডিসটেন্স রিলেশনশিপ চর্চায় ইন্দ্রিয় যেন জেগে থাকে, সে চেষ্টাটা করা উচিত। প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা করবেন কীভাবে? সমাধানও বেশ সহজ। মনের মানুষকে নিজের ছবি পাঠাতে পারেন, ভিডিও ধারণ করেও দিতে পারেন। মোবাইলে বা রেকর্ডিং ডিভাইসে তাকে নিজের কথা রেকর্ড করেও পাঠাতে পারেন। এ ছাড়া বিশেষ উপলক্ষ ছাড়াও বিভিন্ন উপহারও পাঠাতে পারেন একে অপরকে।

চিঠি লেখার অভ্যাস করুন

ছবি: পেকজেলসডটকম

দূরবর্তী সম্পর্কের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে আরেকটি সহজ কাজ করা যেতে পারে, সেটা হলো চিঠি লেখা। নিজ হাতে মনের অব্যক্ত কথামালা যদি কলমের কালিতে কাগজে লিখে প্রিয়জনকে পাঠানো যায়, এর চেয়ে প্রেমময় আর কীই–বা হতে পারে। বর্তমানের টেক্সট বা ই-মেইলের চেয়ে একটি চিঠির শক্তি যে অনেক, সেটা একবাক্যে স্বীকার করবেন সবাই। তাই স্বামী-স্ত্রী একে অপরের কাছ থেকে যখন দূরে থাকবেন, বিভিন্ন কাজের ফাঁকে হলেও এক সপ্তাহে বা দুই সপ্তাহে হলেও অন্তত একটি চিঠি লিখুন। দেখবেন দূরত্ব সত্ত্বেও সম্পর্ক কত মধুরই–না হয়ে উঠবে।

ঘুমাতে যান এক সঙ্গে

ছবি: পেকজেলসডটকম

দুজন যদি একই দেশে অবস্থান করে দূরে থাকেন, তবে চেষ্টা করুন একই সময়ে ঘুমিয়ে যেতে। রাতের একটা নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষে কথা বলে একসঙ্গে ঘুমোতে যাওয়ার রুটিন করুন। একসঙ্গে ঘুমিয়ে এবং ঘুম থেকে জেগে উঠে দিন যদি শুরু করেন, সেটাও মন্দ হয় না। তখন বরং কাছে না থেকেও দূরে মনে হবে না। আর যদি দুই দেশে থাকেন দুজন কিংবা মান সময়ের দুই প্রান্তে হয় দুজনের অবস্থান, তাহলে নিজেদের সময়েই ঘুমান। তবে নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে নিন। ঘুমানোর আগে মেসেজ দিয়ে হলেও জানান, ‘আমি ঘুমাতে যাচ্ছি’। ঘুম থেকে জেগে উঠেও একে অপরকে বলুন ‘শুভ সকাল’।

সম্পর্কে থাক স্বচ্ছতা ও বিশ্বাস

ছবি: পেকজেলসডটকম

একটি স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের মূল শর্ত স্বচ্ছতা ও বিশ্বাস। এই দুটি বিষয় না থাকলে সেই সম্পর্ক সুখের এবং স্থায়িত্ব লাভ করে না। পাশাপাশি থাকার ক্ষেত্রে এটা যেমন দরকার, দূরবর্তী সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি জরুরি। তাই দূরে থাকার সময়গুলোয় একে অন্যকে নিজের ডেইলি রুটিন সম্পর্কে জানান। কোথায় যাচ্ছেন, কার সঙ্গে মিশছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারা আপনার বন্ধু, কীভাবে অর্থ খরচ করছেন ইত্যাদি বিষয়ে পার্টনারকে জানানো জরুরি। এটা আপনার স্বাধীনতা নষ্ট হবে যদি ভাবেন, তবেই ভুল করবেন। এটা একে অপরকে জানারও একটা মাধ্যম হতে পারে।

ভালো বন্ধু তৈরি করুন

ছবি: পেকজেলসডটকম

আপনার স্বামী কিংবা স্ত্রী যখন কাছে নেই, তখন একা একা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার কোনো মানে নেই। বরং আপনি হয়ে উঠুন আরও বেশি সামাজিক। পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও বন্ধুত্ব তৈরি করুন চেনা-অচেনা মানুষের সঙ্গে। এতে আপনার মনের শূন্যতাবোধ যেমন দূর হবে, তেমনি আপনি পাবেন কিছু ভালো বন্ধুর সাহচর্য। তবে এই বন্ধুত্বের অবশ্যই কিছু নির্দিষ্ট সীমা থাকা উচিত। কতটা ব্যক্তিগত হয়ে উঠবে সেই বন্ধু, সেটাও ঠিক করে দিন। সঙ্গীকেও জানান আপনার বন্ধুদের কথা।