পাঠকের প্রশ্ন
বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে বলেছে, ‘পাঁচ বছর আগে তুমি আমার গায়ে হাত তুলেছিলে।’
পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার
প্রশ্ন: ক্যাম্পাসে থাকতে আমাদের প্রেম হয়। সম্পর্কের এক বছরের মাথায় আমরা লুকিয়ে বিয়ে করি। স্নাতকোত্তর শেষ করে আমি বাসায় চলে আসি। তাকে আসতে বললেও সে (সাবেক স্ত্রী) রাজি হয় না। আবার সবাইকে জানিয়ে বিয়ে করতে চাইলেও বলত, ‘তুমি বেকার, গয়নাগাটি কেনা, কাবিনের টাকা কোথায় পাবে?’ এসব বলেই সে বিয়েতে রাজি হতো না। ছয় বছর পর হঠাৎ সে আমাকে তালাকনামা পাঠায়। আমাদের সংসার চালান আমার মা। বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত, নানু ১০ বছর ধরে কিডনির রোগী। পরিবারে সব সময় টাকার অভাব। যেহেতু আমিও বেকার, তাই পরিবারের কাউকেই কিছু বলতে পারিনি, স্ত্রীকেও না। তার কাছে আমি অনেক মিনতি করেছি বিচ্ছেদের পথে না যেতে। বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে সে শুধু একটি কথাই বলেছে, ‘পাঁচ বছর আগে তুমি আমার গায়ে হাত তুলেছিলে।’
এরপর মাকে জানালাম। মা আমার সাবেক স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন, তার পরিবারের সঙ্গেও আলাপ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা কেউ কথা বলেননি। আমার সাবেক স্ত্রী রাজি না হওয়ায় সরাসরি দেখা করার সুযোগ পাইনি। তবে মোবাইলে কথা বলার সময় সে আমাকে খুব অপমান করে। আমি তাকে না জানিয়ে তার বিসিএস কোচিং সেন্টারের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি। তার সঙ্গে দেখা হলে, ওই বাসস্ট্যান্ডে সবার সামনে তার পা ধরে কেঁদেছিও। সে কোনোভাবেই ফিরতে রাজি নয়। শেষমেশ সে চলে যায়। দুই বছর হয়ে গেল, কোনো যোগাযোগ হয়নি। সম্পর্কটা খুব বাজেভাবে শেষ না হলেও পারত। এখনো আমি তাকে খুব ভালোবাসি। তাকে পাওয়ার কি কোনো উপায় আছে? কোনো পথ খোলা থাকলে, আমি সেভাবে এগিয়ে যেতে চাই। আপনার পরামর্শ কামনা করছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
উত্তর: প্রেমের সম্পর্ক হওয়ার এক বছরের মাথায় তোমরা লুকিয়ে বিয়ে করেছিলে কী কারণে তা বুঝতে পারিনি! তোমার পরিবার যে খুব কষ্টে আছে, সেটা তো তোমার জানা ছিল। কাজেই আরও কিছুদিন পার করে অর্থাৎ স্নাতকোত্তর শেষ করে এ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রী হওয়ার পর কিংবা এর আগে তোমাদের শ্রদ্ধাবোধ ছিল কি না, বা বোঝাপড়ার জায়গাটি কেমন ছিল, তা–ও ভেবে দেখো। ছাত্রাবস্থায় যথেষ্ট পড়ালেখার চাপ থাকে এবং সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক সংকট থাকলে নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা খুব কঠিন। একই সময়ে ভালোবাসার সম্পর্কে টানাপোড়েন চলতে থাকলে দুজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। সে কারণেই কি তোমরা লেখাপড়া শেষ করে যার যার বাড়িতে চলে গেলে এবং মেয়েটিও অনীহা প্রকাশ করল তোমার সঙ্গে সম্পর্ক স্থায়ী করার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে? মেয়েটি সামাজিকভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান করতেও রাজি হয়নি। কারণ, সে হয়তো তোমার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা, তোমার বাবা ও নানুর অসুস্থতার কথা ভেবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল।
যখন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠছিল, তখন তোমরা আবেগের বশবর্তী হয়ে বিয়ের মতো অত্যন্ত বড় ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলে। কিছুটা পরিণত বয়সে যাওয়ার পর, মেয়েটি সম্ভবত জীবনের বাস্তবতা চিন্তা করে শঙ্কিত হয়ে থাকতে পারে। বিয়ের আগে এবং পরবর্তী সময়ে সংসারজীবনের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে থাকে। তখন দুজনের জীবনে আরও নতুন কিছু মানুষের সম্পৃক্ততা তৈরি হয়। সে সময় দুজনের পরিবারের সদস্যরা যদি ইতিবাচক আচরণে ব্যর্থ হন, তখন সার্বিক পরিস্থিতির প্রভাবে উভয় পরিবারের সম্পর্কে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। হতে পারে মেয়েটি খোলামেলাভাবে ওর অস্বস্তি ও আশঙ্কার কথা বলতে পারেনি। তাই তুমি যে অনেক আগে তার গায়ে হাত তুলেছিলে, সেটি এখন একটি বড় কারণ হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছে। তুমি ফোন করলে সে অপমান করছে এবং তোমার মা–ও যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তুমি আত্মমর্যাদাবোধ সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে ওর পায়ে ধরেও শেষ চেষ্টা করেছ।
আমার মনে হচ্ছে, এরপর আরও চেষ্টা করলে তোমার নিজেকে শুধু কষ্ট দেওয়াই হবে। ভেবে দেখো, তুমি নিজেকে কীভাবে আরও ভালোবাসতে এবং সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে পারো। তোমার খুব কষ্ট হবে জানি, তবে চেষ্টা করো মেয়েটির মতামতকে শ্রদ্ধা করতে। ভাবো, এই সম্পর্ক চলাকালে তুমি কিছু ভুল করেছ কি না এবং করলে কী কী কারণে করেছ। সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তুমি নিজের মূল্যবান জীবনকে নতুন করে গুছিয়ে নাও। অতীত ও ভবিষ্যতের কথা না ভেবে বর্তমানকে গুরুত্ব দিয়ে তোমার মধ্যে যে ভালো দিকগুলো রয়েছে, সেগুলোকে বিকশিত করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সুন্দরভাবে করার চেষ্টা করো।