মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না

ছবি: পেকজেলসডটকম

বাবা মানেই প্রখর রোদে এক বিশাল বটগাছের ছায়া। বাবা মানেই পরম আশ্রয়, নিশ্চিন্ত অভয়ারণ্য। বাবার মতো নির্ভরতার জায়গা কি সত্যিই আছে আর?  পরিবারের জন্য বাবাদের নিরলস পরিশ্রম, আত্মত্যাগের কোনো তুলনাই হয় না। প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার তাই পৃথিবীর সব বাবার অন্তরের উৎসারিত আবেগ, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জানাতে বাবা দিবস পালন করা হয় বিশ্বজুড়ে।

ছবি: পেকজেলসডটকম

‘বাবা বলে গেল, আর কোনো দিন গান কোরো না। কেন বলে গেল, সেই কথাটি বলে গেল না।’ আমাদের দেশে প্রায় অনেক পরিবারেই বাবার সঙ্গে এমন অনেক না-বলা কথা, বাবার কাছে অনেক না-করা প্রশ্ন রয়েই যায় সারা জীবন ধরে। এখন যাঁরা নতুন বাবা হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে বেশ ব্যতিক্রম দেখা গেলেও চিরাচরিত কী এক অলিখিত নিয়মে বাবারা অনেকেই যেন কেমন একটু শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয়, সংকোচ আর রাশভারী মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রাখেন তাঁদের অপত্য স্নেহের অমৃত ফল্গুধারা। মাকে যেমন ইচ্ছা হলেই গলা জড়িয়ে ধরা হয়, যা ইচ্ছা তা-ই বলা হয়, আহ্লাদ-আবদারে জর্জরিত করে ফেলা যায়, ছেলেমেয়ে বড় হতে থাকলে বাবারা অনেকেই যেন একটু আড়ষ্ট হয়ে পড়েন নিজের আদর-স্নেহ সন্তানের সামনে মন খুলে মেলে ধরতে। আবার এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে বাবা একেবারে বন্ধুর মতো ছেলেমেয়ের পাশে থাকেন, তাদের ছেলেমানুষি আবদার, কৈশোরের জেদ-রাগ সবকিছুর সঙ্গী হন পরম মমতায়।

বাবার আত্মত্যাগ, অবিরাম স্নেহ-শাসন—এই সবকিছুর কোনো তুলনা নেই পৃথিবীতে। আমাদের মতো দেশে, যেখানে বেশির ভাগ পরিবারে বাবা উপার্জনশীল ব্যক্তি, সেখানে সন্তানের তথা পরিবারের খাওয়া-পরা, শিক্ষা, চিকিৎসা আর সব শখ-আহ্লাদ পূরণ করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বাবা। সন্তানের নিশ্চিন্ত বর্তমান আর সুনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন তাঁরা। নিজে খেয়ে না–খেয়ে, রিপু বা সেলাই করা কাপড় আর শুকতলি মেরামত করা জুতা পায়ে দিয়ে কাটিয়ে দেন জীবনটা। এমন কত যে বাবা আছেন আমাদের দেশে! বাবা দিবসের এই দিনটিতে আরেকটু বেশি করে এই কথাগুলো ভেবে দেখা যেতেই পারে।

ছবি: পেকজেলসডটকম

যখন সন্তানেরা বড় হয়ে যায়, বাবাদের বয়স যায় বেড়ে, ঠিক সেই কঠিন সময়ে তাঁদের শরীর ও মনে এক বিশাল ভাটা নিয়ে আসে বার্ধক্য। একে তো আগের মতো পাহাড় ঠেলে সংসারের সব দায়িত্ব, সব চাহিদা মেটানো যায় না, আর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর বয়সের ভারে আর দীর্ঘদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে শরীরেও দানা বাঁধে জরা, বিভিন্ন রোগব্যাধি। এই সময়ে বাবাদের মনঃকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় সন্তানদের সঙ্গে ভৌগোলিক অথবা মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব। সন্তানদের এ সময়ে খেয়াল করে বাবাকে সময় দেওয়া উচিত। চেষ্টা করা উচিত যেন কোনোভাবে তিনি নিজেকে অপ্রয়োজনীয় বা অপাঙ্‌ক্তেয় না মনে করেন।

বাবা দিবসের এই দিনে লম্বা সময় ধরে বাবার সঙ্গে হাসি, গল্প, স্মৃতিচারণায় সুন্দর একটি বিকেল কাটানো যায়। একই বাড়িতে থাকলে বাবার সঙ্গে পরিবারের সবাইকে নিয়ে একবেলা বাবার প্রিয় খাবারগুলো আয়োজন করে খাওয়া যায় হইচই করে। গল্পচ্ছলে শুনে নিয়ে বাবার প্রিয় কোনো পদ রান্না করে তাঁকে চমকে দেওয়ার মধ্যে এক অদ্ভুত আনন্দ আছে। এই ফলের মৌসুমে দেখেশুনে হরেক আম-কাঁঠাল-লিচু সাজিয়ে নিয়ে গেলেও তা খুব সুন্দর উপহার হতে পারে।

ছবি: পেকজেলসডটকম

বাবাদের আরেকটি ব্যাপার হলো, তাঁরা সহজে নিজের জন্য একটু দামি, একটু বিশেষ কিছু কিনতে একেবারেই নারাজ থাকেন। আগের বছরে কেনা পাঞ্জাবিতেই তাঁদের ঈদ সারা হয়ে যায়। পুরোনো জুতাটা কালি করিয়ে নিয়েই চালিয়ে নেন দিনের পর দিন। একটু খেয়াল করে তাঁর পছন্দের ব্যাপারগুলো পর্যবেক্ষণ করা, জেনে নেওয়া কিন্তু খুব কঠিন না। সুন্দর একটি চামড়ার মানিব্যাগ, মর্নিংওয়াকে যাওয়ার জন্য এক জোড়া রানিং শু, সুচারু কাজের শৌখিন একটি পাঞ্জাবি অথবা যুগের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিতে একটি সহজবোধ্য স্মার্টফোন—বাবার জন্য কত কিছুই না কেনা যায়! প্রথমে একটু কপট রাগ দেখালেও পরে তিনি পরম আগ্রহ আর খুশিতে সবাইকে দেখাবেন সন্তানের দেওয়া উপহার, এ কথা সবার জানা।

অবসরে সুন্দর সময় কাটাতে বইও উপহার দেওয়া যায় বাবাকে অনায়াসে। আর নিজের সন্তানদের বাবার জন্য তো যেকোনো পছন্দসই উপহার, বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে হাতে বানানো কার্ড, তাঁর প্রিয় কোনো খাবার রান্না করা—এ সবকিছুই আনন্দে ভরিয়ে তুলবে দিনটিকে। জীবনসঙ্গীর বাবার জন্যও সমান গুরুত্ব আর আন্তরিকতা নিয়ে বাবা দিবসের পরিকল্পনা আর আয়োজন করার মধ্যেই কিন্তু পরিবারের সার্থকতা প্রকাশ পায়, গাঢ়তর হয় পারিবারিক বন্ধন।

বাবা দিবসে পশ্চিমা সমাজে অনেকেই বাবাকে দামি উপহার, ফুল, চকলেট আর কার্ড পাঠিয়ে কর্তব্য শেষ করেন বলে অনেক সমালোচনা হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে পরিবারের বন্ধন সুদৃঢ় হওয়ার পরও বৃদ্ধাশ্রমে বাবা-মায়েরা থাকেন কেন, অশীতিপর বৃদ্ধ রিকশাচালক আর ফেরিওয়ালা কেন দুমুঠো ভাতের জন্য টেনে চলেন নিজের দুর্বল শরীরটাকে, কেন মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপে কদাচিৎ দেখা মেলে প্রবাসী সন্তানের?

ছবি: পেকজেলসডটকম

এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আজকের বাবা দিবসের চেয়ে ভালো দিন আর নেই। করোনায় কত জনের বাবা আজ পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। আজ যেন প্রত্যয় নিই আমরা বাবার ভালোবাসার অকপট স্বীকৃতি দিতে, কিছুটা হলেও প্রতিদান দিতে, যদিও তা কোনো দিন সম্ভব না। কারণ, মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না, ‘আয়, খুকু আয়’।