মেয়ের পছন্দের বিয়ে শুরুতে মানতেই চাননি লিয়াকত আলী। পরে সেই মেয়েজামাই–ই হয়ে ওঠেন তাঁর সবচেয়ে পছন্দের সন্তান। পপির শ্বশুরমশাই আবার পুত্রবধূর কাছে কিছুই চান না। কেবল চান, তাঁর ছেলের বউ পড়াশশোনা করুক। বই পড়তে খুবই ভালোবাসেন অনামিকা। তাই শ্বশুর–পুত্রবধূর বেড়া কাটিয়ে বাবা–মেয়ে হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। এদিকে চার মাস হলো বিয়ে হয়েছে ইসমাত তমার। বাবা পুলিশের চাকরি করতেন। তমা পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। বিয়ের পর শ্বশুরের সঙ্গে জমিয়ে গল্প করেন। বরের বাবাকে নিজের বাবার চেয়ে একটুও কম মনে করেন না তমা। বরং অনেক কথা আছে, যেগুলো নিজের বাবার সঙ্গে আলাপ করতে পারেন না। কিন্তু সেসব নিয়ে শ্বশুরের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলেন।
বউ-শ্বাশুড়ির সম্পর্ক নিয়ে যত আলাপ হয়েছে, বউ-শ্বশুরের সম্পর্ক যেন ‘আন্ডাররেটেড’ই থেকে গেছে। সময়ের সঙ্গে শ্বশুর আর বাড়ির বউয়ের সম্পর্ক সহজ হয়েছে। অনেক বাড়িতেই শ্বশুর-বউমার খিলখিল হাসির শব্দ স্বাভাবিক হয়ে আসছে। একুশ শতকে দাঁড়িয়ে অনেক শ্বশুরই হয়ে উঠছেন বাবা। আবার মেয়েজামাই বা ছেলেবউয়ের গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠছেন শ্বশুরের প্রিয় সন্তান। ঘরের ডাইনিং টেবিল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের খুনসুটিতে উঠে আসছে সেই সহজ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
অমিত আর লিয়াকত আলী সম্পর্কে জামাই–শ্বশুর। শুরুতে লিয়াকত তাঁর মেয়ের বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা গেল, এই শ্বশুরের বেশির ভাগ সময় কাটে মেয়েজামাইয়ের সঙ্গে ‘গুটুর গুটুর’ করে। অন্যরা ফিসফাস করে বলে, ‘কী কথা তাদের এত!’ কী কথা জানতে চাইলে অমিত বলেন, ‘আমার শ্বশুর সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। ১০ বছর হলো অবসর যাপন করছেন। তাঁর সারা জীবনের গল্প জমে আছে। আমি সেগুলো শুনি। তিনি গল্প করতে ভালোবাসেন। আমি গল্প শুনতে ভালোবাসি।’ তবে লিয়াকত আলীর মেয়ে তাঁর বাবার সঙ্গে স্বামীর ভালো সম্পর্কের পেছনে ফাঁস করলেন এক ষড়যন্ত্রতত্ত্ব। কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘বাবার সব অন্যায়ে “শেল্টার” দেয় অমিত। বাবার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার জন্য রুটি খাওয়া মানা। একবার লুকিয়ে রুটি খেতে গিয়ে “ধরা খেল” বাবা। আর অমনি কোত্থেকে অমিত বেরিয়ে এসে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মতো বলল, “মাঝেমধ্যে এ রকম একটি–দুটি রুটি খাওয়া যায়। এতে দোষ নেই।” এভাবে বাবাকে মায়ের বিশেষ কাঠগড়া থেকে “রেসকিউ” করে নিয়ে গেল। লুকিয়ে মিষ্টি খাওয়ালে তো আমার চেয়ে অমিত আপন হবেই!’
পপির শ্বশুরের ছেলেবউদের কাছে একটাই চাওয়া, তাঁরা যেন পড়াশোনা করেন। পড়াশোনা করা মেয়ে তাঁর খুবই পছন্দ। মেয়ে নেই। দুই ছেলেকে বিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে এসেছেন দুই মেয়ে। এখন দুজনই শ্বশুরের ‘পালস বুঝে’ পাল্লা দিয়ে পড়াশোনা করেন। কী পড়লেন, তা–ই নিয়ে আলাপ করতে করতেই তাঁরা হয়ে উঠেছেন শ্বশুর–বউমা থেকে বাবা–মেয়ে। দুই বউ সংসার সামলে রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে পড়াশোনা করেন। তপতীর গল্পটাও অনেকটা তা–ই। তাঁর শ্বশুর ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক। ছেলেবউকে তিনি ঠিক ছেলেবউ হিসেবে গ্রহণ করলেন না, গ্রহণ করলেন ছাত্রী হিসেবে। অবসরজীবনে যোগ হলো নতুন মাত্রা। তুমুল আগ্রহ নিয়ে শেকসপিয়ার, হেমিংওয়ে, এডগার অ্যালেন পো, এলিয়ট, এমিলি ডিকিনসনের ওপর ক্লাস নিতে লাগলেন।
তপতী এই সম্পর্ককে শ্বশুর-বউমা বা বাবা-মেয়ে বলতে নারাজ। এটা বয়স ও সম্পর্কের গণ্ডি পেরিয়ে তাঁর কাছে কোথাও না কোথাও একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বললেন, ‘আমরা দুজন দুজনের ব্যক্তিত্ব পছন্দ করেছি। আমার শ্বশুর আমাকে তাঁর পরিবারের সদস্য হিসেবে পেয়ে গর্বিত। তিনি ব্যক্তি আমাকে সম্মান করেন। তিনি প্রতিদিন দুই পাতা হলেও ইংরেজি বই পড়েন। ইংরেজি পত্রিকা পড়েন। কিছু না হলে চা খান আর ডিকশনারির পাতা ওল্টান। আমার সেটা ভালো লাগে। আবার আমি অফিস শেষে বাড়ি ফিরে চটপট রান্না সেরে ফেলি। ঝটপট সেজেগুজে পারিবারিক অনুষ্ঠানে যাই। আমার হাতের খাসির মাংস, ডাল, ঝিঙের পাতুরি, ছোট মাছের চচ্চড়ি তাঁর খুবই পছন্দ। সত্যি কথা বলতে কি, আমি কখনো তাঁর মেয়ে হওয়ার চেষ্টা করিনি। তিনিও কখনো আলাদা করে বাবা হয়ে ওঠার জন্য কিছু করেননি। খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আমরা একজন আরেকজনকে পছন্দ করি।’
শ্বশুর–বউমা বা শ্বশুর–মেয়েজামাইয়ের সম্পর্ক বাবা–মেয়ে বা পিতা–পুত্রের মতো সহজ হয়ে উঠতে পারে সহজেই। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কিছু শর্ত আছে। দুই পক্ষকেই হতে হবে আন্তরিক। যেকোনো সম্পর্কেই দুই ব্যক্তি কখনোই একজন আরেকজনের মনের মতো হবে না। তাই অপর পক্ষকে বুঝে ছাড় দিতে হবে। পছন্দ–অপছন্দের মূল্যায়ন করতে হবে। ছেলে বা মেয়ের জন্য যে বিধিনিষেধ প্রযোজ্য নয়, মেয়েজামাই বা পুত্রবধূর ওপরও তা আরোপ করা যাবে না। মোদ্দাকথা হলো, পুত্রবধূ বা মেয়েজামাইকে পুত্র বা মেয়ের মতো করেই দেখতে হবে। ঘরের বউ যদি ব্যবসা বা কিছু করতেই চান, সেই উদ্যোগকে বাবার মতোই অনুপ্রেরণা দিয়ে পাশে দাঁড়াতে হবে। ভুল করলে শুধরে নিতে হবে। দিকে পুত্রবধূ বা মেয়েজামাইকেও শ্বশুরকে আলাদা করে দেখা চলবে না। সেই সম্পর্ককে একটা গাছের মতো করে নিয়মিত পানি দিতে হবে। দুই পক্ষ আন্তরিকভাবে চাইলে শ্বশুরও বাবা হয়ে যান, হয়ে যান বন্ধু!