সমাজ পরিবর্তনের শুরুটা হোক পরিবার থেকে

খায়রুল বাসারের সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেন ইউনিলিভার বাংলাদেশের হেড অব মিডিয়া অ্যান্ড ডিজিটাল ফারহা এন জামান (বাঁয়ে) এবং অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন

চুজ টু চ্যালেঞ্জ থিম নিয়ে সারা বিশ্বে করোনা মহামারির মধ্যেও বেশ ঘটা করে পালিত হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ উপলক্ষে প্রথম আলো আয়োজন করেছিল বিশেষ অনুষ্ঠান ‘লিনা’স থাউজেন্ড থিংস নিবেদিত তাহার কথা’।

খায়রুল বাসার

খায়রুল বাসারের সঞ্চালনায় দ্বিতীয় পর্বে অতিথি ছিলেন ইউনিলিভার বাংলাদেশের হেড অব মিডিয়া অ্যান্ড ডিজিটাল ফারহা এন জামান এবং অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন। অনুষ্ঠানটি ৮ মার্চ প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

ফারহা এন জামান

প্রথমেই ফারহা এন জামানের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে যখন নারী দিবস পালন করা হয়, তখন এ দেশের নারীরা একটি শক্ত অবস্থানে আছেন কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার মতে, নারীদের অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে আছে, এমনকি অনেক পশ্চিমা দেশের থেকেও। অবশ্যই আমাদের যাত্রা এখনো শেষ হয়নি, অনেক দূর যাওয়ার আছে। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নারী দিবসের যেসব অ্যাজেন্ডা নিয়ে কথা বলা হয়, এতে অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ শক্ত একটি অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।’

অভিনেত্রী বাঁধন এই প্রসঙ্গ নিয়ে বলেন, ‘আমরা যখন মোটা দাগে দেখি আমার দেশকে, আমার দেশের মেয়ে এভারেস্ট জয় করেছে, ভারোত্তোলনে মেডেল আনছে, ক্রিকেট-ফুটবল খেলছে, করপোরেট লেভেলে, রাজনীতিতে প্রমাণ করছে। দীর্ঘসময় ধরে এ দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার সবাই নারী। সেটা দূর থেকে যখন দেখি তখন মনে হয়, অবশ্যই এটা খুব বড় একটা প্রাপ্তি। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের দেশের অর্থনীতি চাকা ঘুরেছে পোশাক সেক্টরকে দিয়ে। এর পেছনে সব থেকে বড় অবদান এ দেশের নারীদের।

আজমেরী হক বাঁধন

কিন্তু যখন চোখ খুলে নিজেকে বা আমার কাছের কাউকে দেখি যে একটা অবস্থানে যেতে যে পরিমাণ বাধা ডিঙাতে হয় বা সংগ্রাম করতে হয়, সেটা আমার প্রাপ্য নয়। কারণ, আমি একজন মানুষ। আমি স্বাধীন, আমার অধিকার আছে। এই অধিকারকে প্রতিটি পদক্ষেপে আমাকে ছিনিয়ে নিতে হচ্ছে। এটা আমার জন্মগতভাবে পাওয়ার কথা, যেটা আমার ভাই পাচ্ছে। এটা শুধু আমার সমাজের না, অন্যান্য সমাজের নারীরাও এই বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছে। তবে আমাদের উপমহাদেশে যেখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, সেখানে এই সংগ্রাম করাটা অনেক কঠিন।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই বাঁধনকে নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার হতে দেখা যায়। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘মেয়েদের এমনভাবে গড়ে তোলা হয় যে আমাদের সঙ্গে কিছু অন্যায় হলে বা অধিকার হনন করা হলে আমরা বুঝতে পারি না। আমি যেহেতু বুঝিনি, তার মানে অনেক মেয়েই বুঝতেই পারছে না। আমার কথা যদি তাদের চিন্তাজগতে নাড়া দেয়, তাহলে আমি কেন সামাজিক যোগাযোগে এ নিয়ে কথা বলব না। আমি আমার সন্তান, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্ব থেকেই এমনটা করি। কারণ, আমি মনে করি দেশের উন্নয়ন তখনই হবে, যখন আমরা সবাই মিলে দেশের হয়ে কাজ করব। নারীকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয় একটি জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।’

অনুষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক দিক, যেমন বুলিং নিয়ে কথা হয়। এ অবস্থায় আমরা কী করতে পারি, এ প্রশ্ন রাখা হয় অতিথিদের কাছে। ফারাহ এন জামান বলেন, ‘আমি এটাকে ভিন্নভাবে দেখি। পরিবারেও আমরা যখন একটা কথা বলি, তখন সবাই কিন্তু আমাদের কথার সঙ্গে একমত হয় না। সামাজিক প্ল্যাটফর্মে আমরা কথা বললেও এমন হবে। তাই বলে তাদের জন্য কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। একটি নেতিবাচক মন্তব্যকে স্মার্টলি ও ইতিবাচকভাবে হ্যান্ডল করতে হবে। আর আমি মনে করি, মানুষকে পরিবর্তনের চেয়ে নিজেকে পরিবর্তন করা সোজা।’

এ প্রসঙ্গে বাঁধন বলেন, ‘আগে এসব কমেন্ট নিয়ে আমার খারাপ লাগত। কিন্তু সেই ধাপ পেরিয়ে এসেছি। যারা বাজে কমেন্ট করে, এটা তাদের সমস্যা। পারিবারিক শিক্ষা বা ভালো গ্রুমিংয়ের অভাবে তারা এমন করছে। আর আমি আমার পোস্টে যত বাজে বা কুৎসিত মন্তব্য আসুক না কেন, এগুলো ডিলিট করি না। রেখে দিই, যাতে সবাই দেখে এ সমাজের মানুষ কতটা খারাপ হতে পারে। আমি মনে করি, আমি যখন কোনো অধিকার চাচ্ছি, তখন অন্যের মতপ্রকাশের অধিকার হনন করতে পারি না। এটি উচিত নয়।’

ফারহা ও বাঁধন

বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে প্রায়ই নারীদের শুনতে হয়, ‘ও তো মেয়ে। কাজটা কি ঠিকমতো করতে পারবে?’ ফারাহ এন জামান এ পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘এ দেশে কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা এগোতে পারছে না কারণ, তাদের পুরুষ সহকর্মীরা অনেক বেশি কেয়ারিং এবং ওভারপ্রোটেক্টিভ। অনেকে এটা বোঝে না যে কেয়ার করে একটা মেয়েকে কোনো কাজ দেওয়া হচ্ছে না মানে তার মৌলিক অধিকারে বাধা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু উচিত যে মেয়েটিকে জিজ্ঞাস করা যে সে কাজটি করতে পারবে কি না।’

বাঁধন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘আমার যখন ডিভোর্স হয়, তখন পরিবারের সদস্যরাই আমাকে বলে, যেহেতু আমি জেদি, সেহেতু এটা স্বাভাবিক যে আমার সংসার টিকবে না। কিন্তু কেউ বোঝেনি যে একটা মেয়ে যখন ক্যারিয়ারের একদম পিক টাইমে গিয়ে বিয়ে করে বাচ্চা নিয়ে ফেলেছে, সে কেন হঠাৎ ডিভোর্স চাচ্ছে। মানুষ কী বলবে, এটা ভেবে একটা নিরাপত্তাহীনতা থেকেই আমি প্রথমে কাউকেই বলতে পারিনি যে আমার ডিভোর্স হয়েছে। আমি যখন চুপ ছিলাম, তখন আমার ওপর মানসিক অত্যাচারটা আরও বেশি হয়েছে। এ জন্য আমি এখন কথা বলি। আমি চাই, মেয়েরা কথা বলুক। কারণ, আমি আমার শক্তিটা যখন দেখাব, তখন আরেকটা মানুষ আমার সঙ্গে কথা বলতে ভয় পাবে। এখানে অবশ্যই রাষ্ট্র, সমাজব্যবস্থা অনেক বড় ভূমিকা রাখবে, কিন্তু সবার প্রথমে দায়িত্ব নিজের। নিজেকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।’

অনেকে বাঁধনকে পুরুষবিদ্বেষী মনে করলেও আসলে তিনি মোটেও তা নন। তিনি বলেন, ‘আমার চলার পথে আমি পুরুষদের সাপোর্ট অনেক বেশি পেয়েছি। আমি যা নিয়ে কথা বলি, তা শুধু পুরুষের সমস্যা না। আমাদের সমাজব্যবস্থার সমস্যা। সমাজই পুরুষকে শোষক বানিয়ে ফেলে।’

এ ব্যাপারে দুজন অতিথিই একমত পোষণ করে বলেন যে সমাজ পরিবর্তনের শুরুটা পরিবার থেকে। পরিবারে ছেলে–মেয়েকে সমান অধিকার, মর্যাদা দিয়ে বড় করলে এ ধরনের বৈষম্য আর থাকবে না।