সাম্যের প্রশ্নে পরিবারের শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ

খায়রুল বাসারের সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেন প্রীতি চক্রবর্তী (বাঁয়ে) ও সাবরিনা আইরিন

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে প্রথম আলো অনলাইনের উদ্যোগে আয়োজিত হলো বিশেষ অনুষ্ঠান ‘তাহার কথা’। নিবেদক ‘লিনা’স থাউজেন্ড থিংস’। খায়রুল বাসারের সঞ্চালনায় প্রথম পর্বে অতিথি ছিলেন ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চেয়ারম্যান প্রীতি চক্রবর্তী এবং বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা সাবরিনা আইরিন। অনুষ্ঠানটি ৮ মার্চ প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউবে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

প্রীতি চক্রবর্তী (বাঁয়ে) ও সাবরিনা আইরিন

প্রথমে অতিথিদের কাছে নারী দিবস উপলক্ষে তাঁদের ভাবনার কথা জানতে চাওয়া হয়। প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, ‘নারী দিবস এলে আমাদের যেন একটু কদর বেড়ে যায়। যেভাবেই হোক না কেন কদর বাড়াটাই হলো মূলকথা। আমরা সব সময় সমতার কথা বলি। কিন্তু আমি বলি না। আমি মনে করি, আমার মেধা ও যোগ্যতা যদি থাকে, তাহলে অটোসিস্টেমেই আমি সমতা বা ইকুয়ালিটিতে আপগ্রেডেড হব। এ বছরের নারী দিবসের থিম হচ্ছে “চুজ টু চ্যালেঞ্জ”।

খায়রুল বাসার

মেয়েরা চ্যালেঞ্জ পছন্দ করে নিক আর না নিক, আমাদের সব সময় চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। কারণ, নারীদের অনেক কাজ একসঙ্গে করতে হয়। নারীরা সব কাজ খুব ভালোভাবেই সামলিয়ে করতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘৮ মার্চ নারী দিবস আমি পছন্দ করি। কারণ, এদিন সবার মধ্যে একটি ভাবনা উদয় হয়। যেমন, আমরা আসলে কী করছি, কোথায় আছি, কোথায় যেতে চাই অথবা আমরা কীভাবে পুরো নারীসমাজকে দেখছি। আর নারী-পুরুষ যদি সমান না হয়, তাহলে দেশের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’

সাবরিনা আইরিন বলেন, ‘আমাকে অনেক মেয়েই প্রশ্ন করে, আপনি এখানে কীভাবে গেলেন, এত দূর এগোনো সম্ভব কি না। ৮ মার্চের আয়োজনগুলো যেসব নারী সামনে এগোতে সাহস পায় না বা সন্দিহান, তাদের জন্য খুব সহযোগিতাপূর্ণ হয়। কারণ, এসবের মাধ্যমে নারীরা ভাবতে পারে যে, আমি আসলে এ জায়গায় যেতে পারি। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমাদের কিছু শেখারও আছে, দেওয়ারও আছে।’

সাবরিনা আইরিন

আমাদের দেশে বিজ্ঞাপনে সাধারণত নারীদের পর্দার সামনে বেশি দেখতে পাওয়া যায়, পেছনে কম। সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা সাবরিনা আইরিনের অভিজ্ঞতা হলো, ‘আমি যখনই পর্দার পেছনে কাজ করতে যাই, আমাকে সামনে নিয়ে আসা হয়। আমি উপস্থাপনা করেছি, অভিনয় করেছি। একসময় বুঝলাম, এভাবে চলতে থাকলে আমি কখনোই পর্দার পেছনে কাজ করতে পারব না। এই বোধের পর থেকে আমি সামনে কাজ করা বন্ধ করে দিই। আমার পর্দার পেছনে কাজ করতে ভালো লাগে। নিজে অভিনয় করার থেকে অন্যকে দিয়ে অভিনয় করানোর যে আনন্দ, সেটি আমি উপভোগ করি।’ তিনি জানান, আগে মিডিয়াতে মেয়েদের কাজ বলতে ছিল মডেলিং, অভিনয় বা ডেস্ক জব। এখন ধীরে ধীরে এই চিত্রের পরিবর্তন হচ্ছে। এখন আর্ট ডিরেক্টর, কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে অনেক মেয়েই আসছেন।

বাংলাদেশের হেলথ সেক্টরের একটি লিডারশিপের পর্যায়ে প্রীতি চক্রবর্তী। নারী হিসেবে এখানে তিনি কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন কি না, সেই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে নারী-পুরুষের বিষয়টা নেই। এ জায়গায় যে কন্ট্রিবিউট করতে পারবে, তারই সুযোগ আছে সমাজকে কিছু দেওয়ার। যেকোনো কাজ ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে করলে ভালো ভূমিকা নিয়ে অনেক দূর এগোনো যায়। নিবেদিতভাবে নিজের কাজ করতে না পারলে কোথাও ভালো অবস্থান তৈরি হবে না। এই সার্ভিসের জায়গায় আমি খুবই আপসহীন। সামান্য ত্রুটি সেটা যারই হোক না কেন, গুরুত্বসহকারে নিই। সার্ভিস ঠিকমতো না দিলে লিডারশিপের মতো জায়গায় যাওয়া যায় না।’

প্রীতি চক্রবর্তী

ছোটবেলায় আমাদের সবারই বড় হয়ে কিছু একটা হওয়ার ইচ্ছা থাকে। অতিথিদের কাছে জানতে চাওয়া হয় তাঁদের ছোটবেলার জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে। প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, ‘ষাটের দশকে আমাদের সময় মেয়েদের অলিখিত জীবনের লক্ষ্য ছিল ডাক্তার হওয়া। আমিও অবধারিতভাবে ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। সেটি কোনো একটি কারণে হয়ে ওঠেনি। তারপর আমার প্রিয় বিষয় ছিল কেমিস্ট্রি। আমি এটি নিয়েই পড়াশোনা করি।’

আর একটি বৈষম্যহীন পরিবারে বেড়ে ওঠা সাবরিনা আইরিনের ইচ্ছা ছিল এয়ারফোর্সে যাওয়ার। তিনি বলেন, ‘আমাদের সময় তখন এয়ারফোর্সে কোনো মেয়ে নিত না। কিন্তু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চেয়ে যেকোনো চ্যালেঞ্জিং কাজের প্রতি বেশি আগ্রহ ছিল। এখন বিজ্ঞাপন নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক দেশের অনেক মানসিকতার মানুষের সঙ্গে মিশতে হচ্ছে। এটাও একটি চ্যালেঞ্জের মতো।’

প্রীতি চক্রবর্তী ও সাবরিনা আইরিন

তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, পুরুষেরা তাঁর কাজে বাধা হয় কি না। তিনি বলেন, ‘আমার আশপাশে সবাই পুরুষ। তাই বলতে হবে, তারা বাধা হলে আমি গড়ে উঠতে পারতাম না। কখনোই কোনো নেতিবাচক আবহ আমার কাছ পর্যন্ত আসতে দিইনি।’ অর্থাৎ নারী-পুরুষ সে যে–ই হোক, ইতিবাচক থেকে কাজে ফোকাসড থাকলে সব প্রতিবন্ধকতা এড়ানো সম্ভব।

অতিথিরা বড় হওয়ার সময় নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের গ্রামে বেড়ে ওঠা প্রীতি চক্রবর্তী ও ঢাকার আজিমপুরের সাবরিনা আইরিনের পরিবারের কখনো ‘ছেলে-মেয়ে’ বৈষম্য ছিল না। সাম্যের প্রশ্নে পরিবারের শিক্ষাটা খুব বড় একটা বিষয় বলেই অভিমত উভয়ের।