জন্মের পর থেকে দিন তো আর কম গেল না। কবে যে ৬৮ পেরিয়ে এসেছি, বলতেও পারব না! দীর্ঘ এ জীবনে অসংখ্য চিঠি পেয়েছি। যতটি পেয়েছি, তার সব কটির জবাব দেওয়া জরুরি মনে করিনি। যতটা লিখেছি, তার সব কটির উত্তর যে পাইনি, এ কথা হলফ করে বলতে পারি। চিঠি পেয়েছি অযাচিত! চিঠি পেয়েছি চিঠির উত্তরে। কোনো চিঠি পেয়ে খুশি হয়েছি। দুঃখের হরফে লেখা করুণ চিঠিও পড়েছি আমি। ডাকপিয়ন আবার এমন চিঠিও দিয়ে গেছে, যা পড়ে হো হো করে না হেসে পারিনি।
ভাগ্য ভালো, জীবনে কোনো চিঠি হাউমাউ করে কান্নার কারণ হয়ে এসেছে বলে মনে পড়ে না। আপনজনের মৃত্যুসংবাদ চিঠি বয়ে আনেনি, দুয়ারে এসে কড়া নেড়েছে অন্যভাবে। হাজারো চিঠির মাঝে মাত্র একটি চিরকুট চোখের জলে ভিজিয়ে যত্নে করে তুলে রেখেছি। বাবার কথা যখন মনে পড়ে, মাঝেমধ্যে খুলে দেখি। তাঁর হাতের লেখা, আঙুল ঘষে আলতো করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাই, পড়ি না আজকাল আর। পড়তে পড়তে তো মুখস্থই হয়ে গেছে! বাকিগুলো খুলে পড়েছি, তুলে রাখিনি। যেটা একবার পড়েছি, ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। যেটা বারবার পড়েছি, সেটাও রক্ষা পায়নি আমার অবজ্ঞায়, অবহেলায় ও বেকুবিতে। আজ আর ব্যক্তিগত সংগ্রহে অবশিষ্ট কিছু নেই। হাওয়ায় এমনি হারিয়ে গেছে কত প্রিয়-অপ্রিয় চিঠি, দেশি-বিদেশি ভাষায় লেখা চিঠি, দূর ও কাছে থেকে আসা চিঠি; যেন তারা ছিল সব উড়োচিঠি!
যেসব চিঠি লিখেছি, সেগুলোর অবস্থা আরও করুণ! নকল রাখার তো তেমন কোনো সুযোগ ছিল না, থাকলেও রাখতাম না। যাদের কাছে লিখেছি, অল্প কয়েকজন বাদে বাকি সবার কথা বেমালুম ভুলে গেছি। কী লিখেছিলাম, সে তো আরও কঠিন প্রশ্ন! কিছুই মনে নেই। এ-ও কি মনে রাখা সম্ভব? আরেকটা মজার ব্যাপার, আমার জীবনে এমন কিছু চিঠি আছে, কঠোর–কঠিন প্রতিক্রিয়াসহ কাউকে তুলাধোনা করে লিখেছিলাম। রাগ পড়ে গেলে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি। খামেও ভরিনি, ডাকবাক্সেও ফেলিনি। আরও কিছু আছে তীব্র ও তীক্ষ্ণ অনুভূতি নিয়ে লিখব বলে ভেবে রেখেছিলাম, কী লিখব, তা–ও মনে মনে গোছানোই ছিল, কিন্তু সে চিঠি আর কোনো দিন লেখা হয়নি। সাদা কাগজে কালির আঁচড় পড়েনি! যাকে লেখার ছিল, তার কোনো দিন জানা হয়নি কী ছিল আমার মনের অনুভূতি! তবে আমার জীবনে হারিয়ে যাওয়া, পাওয়া চিঠি, আর লেখা ও না-লেখা চিঠির মাঝে বেশ কিছু ব্যতিক্রমও আছে। তাদের অস্তিত্ব বিলীন হলেও তারা স্মৃতিতে আজও অমলিন হয়ে আছে।
সে রকমই একটি চিঠি। এসেছে আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে। তখন আমার বয়স বড়জোর সাড়ে পাঁচ কি ছয়। আমি একা নানাবাড়িতে থাকি, বাদেপাশায়। সময়টি ছিল বৈশাখ মাসের ঝড়-বৃষ্টিভরা এক বাদলা দুপুর। সেদিন বাড়ির কাজের লোক, যাকে আমরা ‘চটর চাচা’ (চটর চাচা সারা জীবন আমাদের বাড়িতে কাজ করেছেন। আমাদের বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই তাঁকে দেখে এসেছি পরিবারের একজন সদস্য হিসেবেই।) বলে ডাকতাম, তিনি এসেছেন। তাঁকে দেখে তো আমি ভীষণ খুশি। আনন্দে লাফাচ্ছি। চাচা আমাকে কোলে টেনে নিচ্ছেন। আদর করে দিচ্ছেন, যেন আমার কত আপন! অথচ তাঁর সঙ্গে আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই, নেই আত্মীয়তারও কোনো বন্ধন। শুনেছি তাঁর মা-বাবা এক চা–বাগানের কুলি ছিলেন। অনেক যুগ আগে, অজানা কোনো কারণে বাগান থেকে পালিয়ে এসে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এর বেশি আমরাও জানি না, তিনিও না।
চটর চাচা সেদিন খালি হাতে আসেননি। তাঁর হাতে অন্য কিছু ছিল কি না জানি না, তবে পকেটে করে আমার জন্য বয়ে এনেছিলেন একখানা চিঠি। আমার জীবনের মহামূল্যবান প্রথম চিঠির প্রথম পিয়ন তিনিই। চিঠিটি লিখেছিলেন আমার মমতাময়ী মা; তখনো আমি পড়তে শিখিনি। নানা আমাকে ডেকে নিয়ে তাঁর কাছে বসালেন। তারপর চিঠিটি খুলে ধীরে ধীরে তিনি পুরোটা আমাকে পড়ে শোনাচ্ছেন। আমি পাশে সুবোধ বালকের মতো নড়াচড়া না করে চুপচাপ শান্ত হয়ে বসে আছি; কিন্তু বুঝতে পারছি, আমার মনের ভেতর এক উথালপাতাল ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে! চিঠি পড়ছেন নানা, কিন্তু আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে আমার মা জননীর মুখখানা। যেন তিনি কাছেই বসে কথা বলছেন আর আমি শুনছি। শুনছি বুকভরা উৎসাহ, কৌতূহল ও প্রাণচাঞ্চল্য নিয়ে! অল্পক্ষণেই আমার উৎসাহে ভাটা পড়ল। মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। কারণ, আমি আমার মায়ের কথা বুঝতে পারছি না। বুঝব কী করে? তিনি লিখেছেন বাংলায়, কিন্তু আমার মাতৃভাষা (বলা ও বোঝার ভাষা) তো বাংলা নয়; সে তো সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা। ভাষা এবং স্মরণশক্তির দুর্বলতার জন্য চিঠির বিষয়বস্তু কিছুই আজ আমার মনে নেই। শুধু একটি কথাই বলতে পারি। মায়ের ওই কথাটা এখনো আমার কানে বাজে। এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন, ‘...লোকমানের চাচা চেয়ারম্যান হইয়াছেন’। মায়ের এত কথার মধ্যে শুধু এ কথাটাই কেন আমার স্মৃতিতে আজও চিরজাগরূক হয়ে আছে, তার কোনো উত্তর পাই না। বুঝি আর না বুঝি, সেদিন আম্মার ওই চিঠিখানা দুঃখের না বলে সুখেরই বলব। কারণ, সেখানে সুসংবাদ একটা তো ছিলই। তার চেয়ে বড় কথা, ওই দিনই চটর চাচার সঙ্গে আমি আমার মায়ের কোলে ফিরে গিয়েছিলাম। সে কী আনন্দ, সে কী উচ্ছ্বাস, বলে বোঝানোর নয়!
তারপর ছয়-সাত বছর চলে গেল, কত কিছু হলো। নানাবাড়ি থেকে ঘরের ছেলে স্থায়ীভাবে ঘরে ফিরে এলাম। পাঠশালা পাস করে হাইস্কুলে গিয়ে ভর্তি হলাম। দেখতে দেখতে ক্লাস এইটেও উঠে গেলাম। জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা দেব, তৈরি হচ্ছি। পঞ্চম শ্রেণিতে আমি বৃত্তি পাইনি, আমার বড় ভাই পেয়েছিলেন। মন দিয়ে পড়তে লাগলাম। এবার সফল হতেই হবে। বইয়ের পড়ায় যে খুব সুবিধা করতে পারছি তা নয়, তবে আমার বিশ্বাস ও ভরসা অন্য জায়গায়। এবার বৃত্তি হাতছাড়া হবে না। কারণ, আমি শবে বরাতের দিন সারা রাত মসজিদে ছিলাম। বড়দের সঙ্গে নফল নামাজ আর দোয়া-দরুদ পড়ে কাটিয়েছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দোয়া আমার কবুল হয়েছে এবং এবার বৃত্তি ঘরে নিয়ে আসবই। মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করবই। পরীক্ষা দিয়ে এলাম।
খুব যে ভালো হয়েছে, তেমন মনে হলো না। তবু আত্মবিশ্বাসে চুল পরিমাণ চিড় ধরেনি। শবে বরাতে আমার বরাত ঠিক হয়ে গেছে। বৃত্তি আমার হাতছাড়া হবে না এবার। অনেক দিন চলে গেছে, কোনো দিক থেকে কোনো খবর পাই না। অস্থিরতায় ভুগছি। একদিন কী মনে করে একটি চিঠি লিখলাম মৌলভীবাজার মহকুমা শিক্ষা অফিসারের কাছে। একটা প্রাথমিক জবাবও পেয়েছিলাম—‘ফলাফল এখনো তৈরি হয়নি। অপেক্ষা করো।’
তারপর প্রতিদিন পথ চেয়ে থাকি, এই বুঝি পরীক্ষার ফল নিয়ে জবাব এল। এভাবে দিন গুনতে গুনতে চলে গেল আরও কয়েক সপ্তাহ। একদিন অঙ্কের ক্লাসে বসে স্যারের জন্য অপেক্ষা করছি। এমন সময় প্রমথ স্যার ক্লাসে এসে ঢুকলেন। এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন। তারপর আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘আইজ যারা আইছে না, তারা বৃত্তি পাইছে।’ সেদিন ক্লাসের সেরা ছাত্র নৃপেন্দ্র আসেনি, সেকেন্ড বয় অসিতও না। আমি বুঝলাম, আমার শবে বরাতের দোয়া কবুল হয়নি। আর ভাবলাম, আমিও যদি আজ না আসতাম, তাহলে মিছরির ছুরির মতো স্যারের হাসিমাখা মুখের কথাটা আমাকে শুনতে হতো না। একটি স্কুলছাত্রের লিখিত চিঠির উত্তর যে মুখে মুখে এভাবে আসে, সে কথা বুঝতে আমার অনেক দিন লেগেছিল!
সৌভাগ্যের বিষয়, জুনিয়র বৃত্তি না পাওয়ার শোক কাটিয়ে উঠতে আমার বেশি দিন লাগেনি। এখন আমার লক্ষ্য এসএসসি ফাইনাল। কী করে ফার্স্ট ডিভিশন পাব, সেই আমার স্বপ্ন। এবার কৌশল হিসেবে জোর দিচ্ছি ইংরেজি আর অঙ্কের ওপর। এরই ধারাবাহিকতায় ঠিক করলাম সেজ মামার কাছে চিঠি লিখব। তিনি তখন হাবিব ব্যাংক সুনামগঞ্জ শাখার একজন তরুণ কর্মকর্তা। ওই সময় আম্মা-আব্বাকে ফাঁকি দিয়ে তাঁকে আমি একদিন একটি চিঠি লিখেওছিলাম। ঠিকানা কীভাবে জোগাড় করেছিলাম, সে কথা এখন মনে করতে পারছি না। চিঠিতে মামার কাছে কিছু টাকা পাঠানোর আবদার জানিয়ে বলেছিলাম, টাকা দিয়ে আমি ইংরেজি কাগজের গ্রাহক হব, ইংরেজি পত্রিকা পড়ব এবং বিদেশি ভাষাটা ভালো করে শিখব। মামা আমাকে নিরাশ করেননি। স্কুলের ঠিকানায় ডাকযোগে ৩০ টাকা পাঠিয়েছিলেন। পিয়ন যেদিন মানি অর্ডার নিয়ে আমাকে খুঁজছিল, সেদিন আমি ভাবতেও পারিনি মামার কাছ থেকে এত তাড়াতাড়ি টাকা চলে আসবে। এটা ছিল আমার জীবনের প্রথম টাকা পাওয়া। ওই সময় ৩০ টাকা অনেক টাকা ছিল এবং এতে আমি যে কত খুশি হয়েছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়! টাকাটা দিয়ে কী করেছিলাম, তা বিলকুল মনে নেই, তবে পত্রিকা যে কিনিনি, এ ব্যাপারে আমি ষোলো আনা নিশ্চিত। এই টাকার কথা আমি আম্মাকে বলিনি, কিন্তু আব্বা জানতেন। একই স্কুলের শিক্ষক হওয়ায়, পিয়ন যেদিন আমাকে খোঁজাখুঁজি করে, সেদিন তিনি স্কুলেই ছিলেন। মামার টাকা পেলাম, কিন্তু কেন ইংরেজি পত্রিকার গ্রাহক হলাম না, এ রহস্যের কোনো সমাধান আমি আজ অবধি বের করতে পারিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে চার বছরের পাঠক্রম শেষ করতে আমাদের লেগেছিল সাড়ে পাঁচ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে দেশ-বিদেশ থেকে অনেক চিঠি এসেছে, আমিও লিখেছি বেহিসাব। অনেকগুলোর জবাব পেয়েছি, কোনোটার পাইনি। এর মধ্যে একটি চিঠির কথা এখনো মনে আছে এবং কোনো দিন ভুলব না। চিঠিটি লিখেছিল আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু মাহবুব। আমার প্রতি এটা কি তার স্বপ্রণোদিত চিঠি ছিল, নাকি আমার কোনো পত্রের জবাব ছিল, তা মনে নেই। চিঠিটি ছিল অভিনব, এ রকম চিঠি আমি আর কোনো দিন কারও কাছ থেকে পাইনি এবং বাকি জীবনে পাওয়ার আশাও করি না। আমার ধারণা, আপনারাও কেউ এই কিসিমের চিঠি কোনো দিন পাননি এবং পাবেনও না। এটি ছিল চার-পাঁচ পৃষ্ঠা লম্বা একটা চিঠি। এটাকে চিঠি না বলে ডায়েরির ছেঁড়া পাতা বললেও বুঝি ভুল হওয়ার নয়। চিঠিটি এক দিনে এক টানে লেখা নয়। বন্ধু আমার লিখেছে অনেক দিন ধরে, জিরিয়ে জিরিয়ে, ছিঁড়ে ছিঁড়ে। বোঝা যাচ্ছিল একেক দিন দু–তিন প্যারাগ্রাফের বেশি লেখেনি। কারণ, চিঠিটি ভিন্ন ভিন্ন কলমে রংবেরঙের কালিতে লেখা। রঙের দিক থেকে এর একটি দুর্বলতা ছিল। সেটাও দূর হয়ে যেত যদি মাহবুবের হাতের কাছে একদিন একটি পেনসিল থাকত। চিঠিটি ছিল সাহিত্য আর কাব্যরসে ভরপুর। আমি কতবার যে পড়েছি, তার লেখাজোখা নেই। চিঠিটি অনেক দিন যত্ন করে তুলেও রেখেছিলাম। কবে কোথায় হারিয়ে গেছে, কে তার খবর রাখে! আজ যদি চিঠিটা আমার হাতে থাকত, কতই না ভালো হতো। তার চিঠি তাকে উপহার হিসেবে ফিরিয়ে দিতে পারলে বন্ধু অনেক খুশি হতো! এত বড় চিঠির বিষয়বস্তু আজ সব ভুলে বসে আছি। তবু কপাল ভালো, এখনো স্মরণে আছে দুটো কথা। সে এক জায়গায় লিখেছিল, ‘...তুই সরস্বতীকে পেয়েছিস, ভবিষ্যতে লক্ষ্মীর কৃপা লাভে ধন্য হবি...’। আরেক জায়গায় মাহবুব কোনো এক প্রসঙ্গে তার সেই সময়ের মনের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্বৃতি দিয়েছিল,
‘...দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না,
সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি...’
আমরা দুই বন্ধু সরস্বতী ও লক্ষ্মীর প্রভাববলয় থেকে নিঃসন্দেহে অনেক দূরে সরে এসেছি। কিন্তু রবি ঠাকুরের গান ও কবিতা এখনো আমাদের আকৃষ্ট করে, মনে দ্যোতনা জাগায়! এসব নিয়ে আমরা সব সময় কথাও বলি, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও করি।
এবার চলে এসেছি শেষ চিঠিতে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর আমার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি ছিল ব্র্যাকে। মাসখানেক পর ব্র্যাক ছেড়ে চলে এলাম, ‘ভিইআরসি’তে (ভিলেজ এডুকেশন রিসোর্স সেন্টার)। সেই চাকরিতে থাকাকালে একবার ফিল্ড ট্রিপ থেকে ফেরার পথে থেমেছিলাম মানিকগঞ্জে। এক চায়ের দোকানে বসে চা-মিষ্টি খাচ্ছিলাম। মিষ্টি খেতে খেতে যা মনে পড়ল, তা আরেকটু বিশদ বিবরণের দাবি রাখে। মানিকগঞ্জে এর আগে আমি কোনো দিন যাইনি, তবু এ শহর নিয়ে আমার শিক্ষাসংক্রান্ত একটি সুন্দর বাল্যস্মৃতি রয়েছে। চা খেতে খেতে সেই স্মৃতি এসে আমার মনকে বারবার নাড়া দিতে লাগল। ঘটনাটা আরও অনেক আগের, সেটা আমার হৃদয়ের অনেক গভীরে প্রোথিত!
গত শতকের ষাটের দশকের শেষ দিক। আমি তখন ক্লাস নাইন কি টেনে পড়ি। তৎকালীন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমা সদরে ছিল ‘ইস্ট পাকিস্তান বাইবেল করেসপনডেন্স স্কুল’। এই স্কুলের সঙ্গে কীভাবে আমার যোগাযোগ হয়েছিল, তা একদম ভুলে গেছি। তবে তাদের একটি বই ‘লুকলিখিত সুসমাচার’ আমার হাতে এসে পৌঁছেছিল। এটা পড়ে পড়ে আমি সপ্তাহ দু–এক পরপর ডাকযোগে একগুচ্ছ প্রশ্নের উত্তর জমা দিতাম। বাইবেল স্কুলের উদ্দেশ্য ছিল তরুণদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্মের প্রচার ও প্রসার। আমার আগ্রহ ছিল অন্যখানে।
আমি কয়েক দিন পরপর যেমন নতুন নতুন প্রশ্নোত্তরের খাতা জমা দিতাম, তেমনি আবার লাল কালি দিয়ে পরীক্ষা করা এবং মার্ক করা আগে জমা দেওয়া খাতাগুলো ফেরতও পেতাম। আর সেখান থেকেই উঠে এসেছিল আমার মনের যত আনন্দ! আমি সব হোমওয়ার্ক অ্যাসাইনমেন্টে ৯৮ শতাংশ, ৯৯ শতাংশ, শতভাগ নম্বর পেতাম। বাহ্! জীবনে কোনো পরীক্ষায় তো অমন করে নম্বর পাইনি। নম্বরের বেলায় এই কোর্সগুলোর ফলাফল ছাত্র হিসেবে আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিল। আমি ভাবতে লাগলাম, তাহলে ক্লাসের পরীক্ষায়ও এ রকম সফলতা আশা করা যায়। যদিও আমি তখনো এত ভালো নম্বর কোনো পরীক্ষায়ই পাইনি, তবু ওই আত্মবিশ্বাস আমাকে লেখাপড়ায় অনেক বেশি মনোযোগী করে তুলল এবং আমার ক্লাস-পরীক্ষার ফলাফলও দিনে দিনে ভালো হতে লাগল।
এ থেকে আমি দ্বিতীয় আরেকটি উপকার পেয়েছিলাম, তা হলো ওই বাইবেল স্কুলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে পোস্ট অফিসের সঙ্গে আমার একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে, পরবর্তীকালে যার হাত ধরে ধীরে ধীরে সারা বিশ্বের সঙ্গে আমার সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বড় হয়ে কারণে-অকারণে আমি সারা দুনিয়ার অসংখ্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি এবং ছাত্রজীবনের শেষ দিন অবধি তা অব্যাহত রেখেছি। এতে আমার পয়সা খরচ হয়েছে বটে, কিন্তু ক্ষতি হয়নি। উপরন্তু নিয়মিত নিজেকে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করার একটি অনবদ্য সুযোগ পেয়েছিলাম এবং বলতে পারি, সে সুযোগের আমি যথাযথ সদ্ব্যবহারও করেছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ নিয়ে কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই।
আমার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য পূরণে আমি সফল হয়েছি কি না জানি না, তবে মানিকগঞ্জের ‘বাইবেল’ স্কুল যে মাঠ থেকে ‘মানিক’ কুড়োতে পারেনি, সে কথা নির্দ্বিধায় বলাই যায়। তারা আমাকে খ্রিষ্টান বানাতে পারেনি। আমার বড় ভাই ও মক্তবের হুজুর, বাইবেল স্কুলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিন্ন করার দাবি জানিয়েছিলেন। তাঁদের ভয়, আমি যদি ধর্মান্তরিত হয়ে যাই!
এখন আসি আরও তুচ্ছ একটি প্রশ্নে, যেটা সেই সময়ে আমার কাছে অনেক বড় একটি বিষয় ছিল। যেমন আমি যে বাইবেল স্কুলে নিয়মিত ডাকযোগে চিঠি পাঠাতাম, তার ডাকমাশুল জোগাত কে? পয়সাটা কোথায় পেতাম? উত্তর আমার মনে নেই, জানা নেই, তবে আজ আপনাদের এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি, পোস্টাল স্ট্যাম্পের পয়সা জোগাতে কোনো দিন আব্বার পকেটে হাত দিইনি কিংবা আম্মার টিনের কৌটা থেকে সিকি-আধুলিও সরাইনি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ওই পয়সার জোগান দিতে আমার কোনো অসুবিধাও হয়নি। আমার জীবনের অনেক রহস্যের মধ্যে এটিও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষুদ্র রহস্য!
লেখক: অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াস
ছবি: পেকজেলসডটকম, প্রথম আলো