স্মৃতির গভীরে আমার বাবা

সহকর্মীদের সঙ্গে প্রফেসর ডা. এম এ গফফারছবি: লেখক

বাবাকে কয়েক বছর ধরে হৃদয়ের গভীরে খুঁজে বেড়াচ্ছি। খুঁজতে খুঁজতে হয়তো আমারই সময় শেষ হয়ে আসবে, তবু বাবার হাতের স্পর্শ পাব না। কোনো মায়া–মমতাতেই তো আমার বাবাকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি। প্রতি মুহূর্তে মনের গভীরে বাবাকে অনুভব করি। মনে হয় যেন বাবা আমাদের পাশেই আছেন ছায়া হয়ে। আমরা তো বাবার কন্যাসন্তান ছিলাম। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে মনে হয়, আমাদের বাবা এক বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে রেখেছিলেন আমাদের।

আমার বাবা ছিলেন এক সংগ্রামী মানুষ। সংগ্রাম করতেই ভালোবাসতেন। সংগ্রাম ও ভালোবাসা দিয়ে সবকিছুকে জয় করতে চাইতেন। তিনি ছিলেন একজন প্রথিতযশা সার্জন। খুব বেশি ভালোবাসতেন নিজের কর্মক্ষেত্রকে, প্রিয় রোগীদের; ভালোবাসতেন তাঁর ছাত্রছাত্রীদের, সেই সঙ্গে তাঁর সহযোগী চিকিৎসক ও সহকর্মীদের।  

চিকিৎসক হিসেবে তাঁর জীবন যখন শুরু হয়েছিল, তখন থেকে তিনি অন্তরের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে রোগীদের সেবা (অপারেশন) করতেন এবং সারিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন। তাঁর কথা অল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। গরিব রোগীদের প্রতি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ছিলেন তিনি। অনেক দেশ ঘুরেছেন তিনি, প্রচুর লেখাপড়া করেছেন, ছিলেন বড় মাপের একজন চিকিৎসক। তবে সাফল্যমণ্ডিত জীবনের সর্বোচ্চ শিখরে উঠেও তিনি ছিলেন সাধারণ একজন মানুষ।

যুবক বয়সে প্রফেসর ডা. এম এ গফফার
ছবি: লেখক

আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। ঢাকা মেডিকেল কলেজে চাকরিরত অবস্থায় প্রয়াত মেয়র মো. হানিফ সাহেবের পুরান ঢাকার বাসায় বঙ্গবন্ধু ও আমার বাবা দীর্ঘ সময় পাশাপাশি থেকেছেন। তিনি লন্ডন থেকে এফআরসিএস করে যখন দেশে আসেন, তখন বঙ্গবন্ধু অনেকবার তাঁকে বলেছেন, ‘আপনি ঢাকায় থাকেন। আমার ব্যক্তিগত চিকিৎসক হবেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজে থাকেন।’ তিনি থাকেননি। তিনি নিজের এলাকার মানুষের সেবা করার কথা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে নিজের এলাকা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে চলে যান।

বড় সন্তান হিসেবে আমি তাঁর কর্মজীবনের অনেক কিছু দেখেছি। বাবা আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে সৎ জীবন-যাপন করতে হয়। সৎ পথে থেকে কীভাবে জীবনকে জয় করা যায়। বাবা আমাদের গ্রামের বাড়িতে দুটি স্কুল করেছেন দাদার জমির ওপর। একটি প্রাইমারি স্কুল আরেকটি হাইস্কুল। প্রাইমারি স্কুলটি বাবা দীর্ঘ সময় নিজের খরচে চালিয়েছেন। পরে অনেক পরিশ্রম করে সেটার সরকারি অনুমোদন পেয়েছিলেন। আর হাইস্কুলটি আরম্ভ করে শেষের দিকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর আমার এক চাচাতো ভাইয়ের ছেলের হাতে তা ছেড়ে দেন। তাঁর নাম হেলিম। হেলিম পরে বাকি কাজ সমাপ্ত করেছিলেন। দুটি স্কুলই দাদার বাড়ির পাশে।

সহকর্মীদের সঙ্গে প্রফেসর ডা. এম এ গফফার
ছবি: লেখক

বাবা লিবিয়ায় থাকাকালে সেখানকার বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সেখানেও তিনি বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে আমাদের বাসায় স্কুল শুরু করেছিল, প্লে থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। আমরা তখন দেশে ছিলাম। বাবা লিবিয়া যাওয়ার পর বেনগাজী ক্যান্টনমেন্টের গেটের সামনে একটি বাসা ভাড়া করে স্কুলটি স্থানান্তর করেন। তিনি বেনগাজী ক্যান্টনমেন্টের আর্মি হাসপাতালের গাইনি ও সার্জারি বিভাগে কাজ করতেন।

আমার বাবা ময়মনসিংহ শহরে প্রথম প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন এবং সে প্রতিষ্ঠানের কমিউনিটি হেলথ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। কর্মজীবনে ঢাকা মেডিকেল কলেজে দীর্ঘ সময় কর্মরত ছিলেন। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বদলি হন। সেখান থেকে পরে আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজে চলে আসেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৃত্তি নিয়ে লন্ডন যান এফআরসিএস করতে।

সহকর্মীদের সঙ্গে প্রফেসর ডা. এম এ গফফার
ছবি: লেখক

বাবা ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলার গুণীজন সংবর্ধনায় দুইবার সম্মাননা পুরস্কার পান ভালো চিকিৎসক হিসেবে। তিনি আতিথেয়তাপ্রিয় মানুষ ছিলেন। তাঁর সততা–বিশ্বাসের ওপর আমাদের লালনপালন করতে চেষ্টা করেছেন। আমাদের বাসাতেই ক্লিনিক ছিল। তিনি গরিব ও দুস্থ রোগীদের অল্প পয়সায় চিকিৎসা করতেন।

তিনি ময়মনসিংহ সরকারি মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৩ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। এরপর প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে কর্মরত ছিলেন।

বাবার দীর্ঘ কর্মজীবনে অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প আছে। তাঁর কর্মজীবনের অনেক ঘটনা মনে রাখার মতো। এত কর্মপাগল, খ্যাতিমান আমার বাবাকে আর খুঁজে পাই না। আমি ও আমরা গর্ববোধ করি, যখন দেশের মানুষ, অনেক চিকিৎসক, অনেক রোগী সততা, ভালো চিকিৎসা ও ভালো মানুষ হিসেবে আমার বাবার গল্প করেন। তখনই মনে হয় আমি এক ত্যাগী, সৎ ও একজন আদর্শ বাবার সন্তান। সে আদর্শটুকু হাজার হাজার কোটি টাকার চেয়েও বড় সম্পদ ও সম্মানের। এটা অর্জন করতে হলে জীবনে যে কাউকে সততা, ত্যাগ ও আদর্শ দিয়ে জয় করতে হয়।

পরিণত বয়সে প্রফেসর ডা. এম এ গফফার, এমবিবিএস (ডিএমসি), এফআরসিএস (এডিনবরা), এলএম (রটানডা), ডিজিও (গ্লাসগো)
ছবি: লেখক

আমার বাবার নাম প্রফেসর ডা. এম এ গফফার। চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন তিনি। আজ ভাবতে গর্ব হয়, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলার বাইরের লোক ছাড়াও দেশের অনেক প্রান্তের মানুষ আমার বাবাকে চেনেন। আমরা বাবার আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ যেন তাঁকে বেহেশত নসিব করেন। বাবা তুমি চির অম্লান হয়ে বেঁচে থাকুন আমাদের হৃদয়ে।

লেখক: ডা. এম এ গফফারের জ্যেষ্ঠ কন্যা