আর্জেন্টিনা সমর্থন করে সেই নব্বই থেকে কাঁদছি

১৯৯০ সালের ফিফা বিশ্বকাপের সময় আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। চট্টগ্রামের চাঁদপুর জেলার হাজিগঞ্জের নাসির কোট উচ্চ বিদ্যালয়ে। স্কুলের সবচেয়ে বড় ক্লাসরু‌মটাতে ২৪ ইঞ্চি রঙিন টি‌ভি‌তে খেলা দেখার ব্যবস্থা করেছে গ্রা‌মের ক্রীড়মোদীরা। ওয়ার্ল্ডকাপের ‘মর্ম’ বোঝার মতো বয়স তখনো হয়নি। সে কারণেই কেউ আমাকে রাতের বেলায় স্কুলে নিতে চায়নি। অথচ বা‌ড়িতে ভি‌‌সিআর আনা হলে উঠা‌ন বা কাছা‌রিতে খড় বিছিয়ে রাত জেগে হি‌ন্দি-বাংলা ছ‌বি দেখার অভ্যাস আমার মা‌য়ের পেট থে‌কেই!

ইং‌রে‌জি ধারাভাষ্যের মধ্যে একটা নাম কমন পড়লেই সবাই‌ চেঁচিয়ে উঠ‌ত ‘ম্যারা‌ডোনা, ম্যারাডোনা’
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

বড়রা আয়োজন করে, টুল-টেবিলে বসে, স্কুলঘরে সিনেমা দেখে বেড়াচ্ছে, অথচ ছোটদের নিচ্ছে না। এমন অনুমান ও অভিমান নিয়ে বসে ছিলাম অনেক দিন। পর্যাপ্ত কান্নাকাটির পর ছোট মামা‌র দিলে দয়া হলো। যে‌দিন আমা‌কে নি‌তে রা‌জি হলো, সেদিন ছিল আর্জেন্টিনা-জার্মানির ফাইনাল ম্যাচ। সবাই ‘ম্যারা‌ডোনা, ম্যারা‌ডোনা’ জপছে! দূর থে‌কে কাউকেই পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছিল না।

বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার বিপুল জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান কারণ ম্যারাডোনা
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

মূলত প্রথম কয়েক সারির পর দর্শকদের কেউই খেলোয়াড়দের ঠিকঠাক দেখতে পারছিল না। হুদাই চিল্লাপাল্লা করত আর উত্তেজিত হতো। ইং‌রে‌জি ধারাভাষ্যের মধ্যে একটা নাম কমন পড়লেই সবাই‌ চেঁচিয়ে উঠ‌ত ‘ম্যারা‌ডোনা, ম্যারাডোনা’ ব‌লে। ক্লোজ শটে ১০ নম্বর জা‌র্সিসহ তার মুখটা কয়েকবার দেখানোর পর খানিকটা বুঝতে পারলাম, এই লোকটাই ম্যারাডোনা।

ম্যারা‌ডোনার অঝোর কান্নার সঙ্গে সে রাতে কেঁদেছে গোটা স্কুলঘর
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

খেলায় টান টান উত্তেজনা। গোলশূন্য প্রথমার্ধ। দ্বিতীয়ার্ধও! শেষে এক্সট্রা টাইমে পেনা‌ল্টি কি‌কে ১-০ গো‌লে হে‌রে যায় আর্জেন্টিনা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল তখন। ম্যারা‌ডোনার অঝোর কান্নার সঙ্গে সে রাতে কেঁদেছে গোটা স্কুলঘর। দুই নম্বরি ক‌রে আর্জেন্টিনার কাছ থে‌কে কাপ ছি‌নি‌য়ে নেওয়া হ‌য়ে‌ছে—এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত ছিল না। সেই ষড়যন্ত্রতত্ত্বে তীব্রভাবে প্রভা‌বিত হলাম আমিও।

মেসি ও ম্যারাডোনা
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

ট্র্যাজিক হিরো ম্যারাডোনার পপুলারিটি বাড়তে থাকল আর্জেন্টিনা থেকে কত শত মাইল দূরে বাংলাদেশের একটা ছোট্ট গ্রামেও! বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার বিপুল জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান কারণ ম্যারাডোনা। চা‌বি ছাড়াই তার ছ‌বিসংবলিত চা‌বির রিং নি‌য়ে ঘুরে বেড়িয়েছি বহু বছর। উৎসুক চোখ নিয়ে অপেক্ষা করতাম, আর্জেন্টিনার ১০ নম্বর জা‌র্সি এরপর কার গায়ে ওঠে।

চের ছবি হাতে ম্যারাডোনা
ছবি: সংগৃহীত

ম্যারা‌ডোনা–প্রেমের দ্বিতীয় স্রোত আসে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে! বামপন্থী রাজনী‌তি‌তে হা‌তেখ‌ড়ির পর থে‌কে। খেলার বাইরে তাঁকে পছন্দের কারণ হিসেবে আদর্শগত ভিত্তি মিলতে থাকে। যেমন চি‌কিৎসার জন্য পুঁজিবাদী কো‌নো দেশে না গিয়ে তি‌নি কিউবায় যান। ফি‌দেল কাস্ট্রো কিংবা হু‌গো শা‌ভেজ তাঁর বন্ধু। বিপরীতক্রমে ম্যারাডোনার ‘রাইভাল’ পে‌লে হ‌চ্ছেন প্রো-এস্টাবলিশমেন্টের লোক। এ রকম অনেক গল্প!
সময় পরিক্রমায় ম্যারাডোনা–প্রেমে কিঞ্চিৎ ভাটা পড়েছে সত্য! কিন্তু ম্যারাডোনা আমার আশৈশব প্রেম। সেই নব্বই থেকে কাঁদছি। আর্জেন্টিনা করে আজও তার নাম জপতে জপতে কাঁদি।

লেখক: খোরশেদ আলম, সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।