বরেণ্য এই অভিনেতার প্রেম, বিয়ে ও সংসারের দিনগুলো রোমাঞ্চে ভরা, তাঁকে চিনতে পেরেছেন কি

বিয়ের আসরে আবুল হায়াত ও শিরী হায়াতছবি: অভিনেতার পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

আমার পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এক ভাগনে রিটু হঠাৎ মাইক্রোফোন নিয়ে বলে বসল, ‘মামা, মামির সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার গল্পটা আজ বলতেই হবে।’

উপস্থিত অতিথিরাও বেশ মজা পেলেন, সবাই এক বাক্যে ধুয়া তুললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বলতে হবে।’ 

কী আর করি, মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে জমাটবাঁধা ধুলা ঝেড়ে থলের বিড়াল বের করার চেষ্টা করলাম।

ঘরনি শিরী হায়াত আমার মেজ দুলাভাই মনিরুজ্জামানের ছোট বোন। বাস করত গ্রামের বাড়িতে, ঢাকা শহরের অদূরে বেরাইদ গ্রামে। বড় ভাইয়ের বিয়েতে পরিবারের সঙ্গে গিয়েছিল চট্টগ্রামে। চার চোখের মিলনটা তখনই হয়ে গেল। তখন তাঁর বয়স চার, আর আমি ১০ বছরের ভরপুর যুবাপুরুষ। বোনের বিয়েতে সেজেগুজে ছিলাম বেশ। ওতেই সে কাত, আমিও তথৈবচ। এটাই ছিল আমাদের প্রথম দেখা। সে চট্টগ্রামে তার ভাবি, অর্থাৎ আমার মেজ বোনের কাছেই থাকত। ফোর কি ফাইভে উঠে চলে যায় খুলনা। কারণ, দুলাভাই বদলি হয়ে গিয়েছিলেন ওখানে।

আব্বা যেহেতু রেলে চাকরি করতেন, আর বোনের বাসা খুলনায়, বছরে একবার অন্তত রেলে চড়ে খুলনায় যাওয়া হতোই। এ রকম যাওয়া–আসার মধ্যে সময় অনেক গড়িয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। আমি ঢাকায় ইপিইউইটিতে ভর্তি হলাম। ওদিকে সে–ও বেশ ডাঙর হয়ে উঠেছে। কোনো একসময়ে চার চোখ আবার এক হলো। তবে বলার সাহস হয় না। চারদিকে সব লোকজন, দুলাভাইয়ের কাজের মানুষই ছিল সাত–আটজন, প্লাস ড্রাইভার।

কোনো এক স্বর্ণালি সন্ধ্যায় ঘটনাক্রমে একা পাওয়া গেল তারে। নানা গল্পগুজবে পেরিয়ে যায় সময়। কথাটা হয় না কওয়া। হঠাৎ দেখি সে একটা প্রশ্ন করে বসল আচমকা, তখনো আমাদের সম্পর্ক আপনি আর তুই।

‘প্রেমট্রেম করেন নাকি?’

‘হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?’

‘এমনি, জানতে ইচ্ছা করল।’

‘উঁ, না মানে—’

‘সত্যি বলবেন কিন্তু!’

‘না মানে, একজনকে মনে মনে—’

‘মনে মনে? বলে ফেলেন, বলেন না কেন?’

‘সাহস হয় না।’

‘কেন? আমি কি বাঘ নাকি?’

কথাটার মানে বুঝতে আমার মন সময় নিল না এক সেকেন্ডও।

সে তো উঠে দৌড়।

অভিনেতা আবুল হায়াত ও শিরী হায়াত
ছবি: অভিনেতার পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

ব্যস, হয়ে গেল আরকি! এটা সেই ১৯৬৬ সালের কথা। তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আমি। সে বোধ হয় দশম শ্রেণিতে। জমে গেল প্রেম। চিঠি লেখালেখিও শুরু হলো। অনেক বাধা পেরিয়ে চিঠি বেচারা আসত–যেত। খুলনায় এক মাধ্যম পেলাম, আমার বড় দুলাভাই আবদুর রাজ্জাক সাহেবকে। তখন তিনি পরিবার নিয়ে ওখানেই স্থায়ী হয়েছিলেন।

দু–তিনবার চিঠি আসা–যাওয়ার পর দুলাভাই সাহেব হঠাৎ হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন। আমার মেজ বোন জানলেন, বাড়ির সবাই জানল, এদিকে চট্টগ্রামে ফোন চলে গেল।

চিঠি বন্ধ হলো। আমারও খুলনা যাওয়া বন্ধ। কিছু খবর আসত আমার দুই শুভাকাঙ্ক্ষী ছোট বোন মমতাজ আর পুতুলের মাধ্যমে। ওদের মাধ্যমেই জানলাম, আমার আম্মা ভীষণ ক্ষিপ্ত, এক বাড়িতে তিনি কিছুতেই দুই বিয়ে দেবেন না। ওদিকে নাকি অবস্থা আরও গুরুতর, তার বাবা–মা ঘরবাড়িহীন পাত্রের হাতে মেয়েকে দেবেন না।

চতুর্থ বর্ষে পড়ার সময় কোনো এক ছুটি উপলক্ষে আমাদের বাড়ির সবাই চলল খুলনা, তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। সবাই যাবে, আমাকে কেউ নেওয়ার কথা বলে না। শেষে আমিই আব্বাকে বললাম, ‘আব্বা, আমার বন্ধু রুমমেট আনিস, নড়াইলে থাকে, ওর ওখানে যেতে বলেছিল, আপনাদের সঙ্গে যাই?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলো।’

আব্বা সব সময়ই এমন। দুই পরিবারের মধ্যে যতই মন–কষাকষি হোক, ওই ব্যাপার নিয়ে আব্বা-আম্মা, এমনকি ও বাড়ির কেউই কিন্তু আমাকে কিছু বলেননি।

যশোর স্টেশনে নেমে গেলাম মনের দুঃখ মনে চেপে। একটা দেখা অন্তত হওয়া দরকার ছিল শিরীর সঙ্গে; কিন্তু কী আর করা।

নড়াইল পৌঁছে ধাক্কাটা খেলাম জোরেশোরে। বন্ধু আমার খুলনায় গেছে বেড়াতে। আমি এখন করি কী। রাত কাটিয়ে পরদিন সকাল যশোর এসে ট্রেনে উঠলাম। না, ঢাকার ট্রেনে নয়, খুলনার ট্রেনে। আর যাবই–বা কোথায়? মন টানছে খুলনায়, আনিসের জন্য অবশ্যই নয়।

আমাকে দেখে অনেকেই মনে হলো চমকে গেলেন। দিনদুয়েক ছিলাম, বন্ধু মঞ্জুর (শিরীর সেজ ভাই) আমার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী। ওর সঙ্গেই ঘুরে বেড়িয়েছি।

শিরী ও আবুল হায়াতের দুই সন্তান বিপাশা ও নাতাশা হায়াত
ছবি: অভিনেতার পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

দুই দিনে একবার দেখা হলো। বাড়িতে পার্টি হচ্ছিল। মেলা মানুষ। সেই ভিড়ে, অপরূপ সাজে সজ্জিত শিরী ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে, পরনে কালো শাড়ি লাল পেড়ে। আহ্‌ কী অপরূপ লাগছিল। এক ফাঁকে সেই চার চোখের মিলন, দিল একটা ফোন নম্বর হাতে গুঁজে, ‘এখানে ফোন কোরো।’

ব্যস, ওইটুকুই। আর কোনো সুযোগই হলো না কথা বলার। ঢাকা ফিরে ওই নম্বরে ফোন করলাম একদিন।

ওপারে নারীকণ্ঠ—‘কে বলছেন?’

‘ঢাকা থেকে রবি (আমার ডাকনাম) বলছি, শিরী আমাকে এই নম্বর দিয়েছিল।’

এবার হাসির আওয়াজ। ‘আমি শিরীর আপা, কাজিবাড়ির আপা। ওকে তো এখন পাবেন না। কাল চারটার সময় ওকে ডেকে রাখব।’

এভাবেই ম্যানেজ করে চলত আমাদের কথাবার্তা, দিনের পর দিন।

একসময় পাস করে বেরোলাম, তিনিও তখন বয়রা কলেজের ছাত্রী। আমি ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী। এবার অফিসের ফোন ব্যবহার করেছি।

শিরীর আর আমার ব্যাপারটা চলমান থাকলেও দুই পক্ষের নীরবতা সত্যিই পীড়াদায়ক ছিল। আমরা একটু শঙ্কিতও ছিলাম, ভবিষ্যতে কীভাবে সমস্যার শেষে পৌঁছাব।

এক দুপুরে, রোববার ছুটির দিন, খেয়েদেয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি। বাইরের ঘরটায় আমি থাকতাম। ভেতরের দিকে আলাদা আরেকটা ঘরে আম্মা-আব্বা আর বোনেরা। হঠাৎ গায়ে একটা খোঁচা। ঘুম ভেঙে দেখি জানালার বাইরে থেকে কে যেন একটা ছড়ি দিয়ে খোঁচাচ্ছে।

‘কে রে?’ বলতেই চেহারা দেখাল একটি চঞ্চলা মুখ। রাবু, শিরীর মামাতো বোন, গোপীবাগে থাকত ও। আঙুলের ইশারায় চুপ থাকতে বলে ফিসফিস করে ডাকল, ‘বাইরে আসেন।’ তাড়াতাড়ি শার্ট–প্যান্ট পরে বাইরে এসে আমি হতবাক! শিরী দাঁড়িয়ে তার পেছনে। সঙ্গে আমার এক বোন, নাজমা। তাদের কথামতো শিরীকে নিয়ে রিকশায় উঠলাম।

জীবনে প্রথম তার সঙ্গে একা পথে, তা–ও রিকশায় ঘনিষ্ঠ হয়ে। ঘামছি আমি, বুঝতে পারছি না কী বলব।

সে-ই বলা শুরু করল, ‘অবাক হয়েছ না?’

‘হ্যাঁ, মানে হঠাৎ?’

এভাবেই গ্যাঁ গ্যাঁ করে চললাম কিছুক্ষণ। কিন্তু যাচ্ছি কোথায়! মোহাম্মদপুর থেকে বেরিয়ে মীরপুর রোড ধরে এগোচ্ছি। নিউমার্কেটের দিকে। পেছনের রিকশায় রাবু আর চুনি (বোন)। হঠাৎ মনে হলো শেরেবাংলা হলে যাই। ওখানে অন্তত বসে কথা বলা যাবে। সেদিকেই ছুটলাম। তিনতলায় থাকত আমার এক জুনিয়র বন্ধু, টিটো। তার রুমেই হাজির হলাম।

সে তো অবাক, ‘হায়াত ভাই, তুমি হঠাৎ!’

‘দেখ, কাকে নিয়ে এসেছি।’

ওকে দেখে টিটোও থতমত, ‘বিষয় কী?’

‘বিষয় কিছু না। আমরা একটু আলাপসালাপ করব। ভাবলাম এখানেই ভালো।’

ওর আর একটা রুমমেটও ছিল। দুজনই বেরিয়ে গিয়ে আমাদের কথা বলার সুযোগ
করে দিল।

দুজনের কী আলাপ হয়েছিল, সেটা নাহয় ঊহ্যই থাক। টিটোই আমাদের আপ্যায়ন করল প্যাটিস আর কোকা–কোলা দিয়ে। ঘটনাটা সম্ভবত ১৯৬৯ সালের জুন–জুলাইয়ের দিকের।

এরপর হঠাৎ একদিন মেজ দুলাভাই এসে হাজির। নানা কারণে তাঁর মনও বিক্ষিপ্ত। তিনি বললেন, ‘চলো, তোমাদের বলাকায় সিনেমা দেখাব।’ গেলাম, তবে দুলাভাই সিনেমা দেখলেন বলে মনে হলো না। একসময় আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ‘আর ইউ সিরিয়াস অ্যাবাউট শিরী।’

তাঁর সঙ্গে এসব বিষয়ে কখনোই কথা হয়নি। বাড়িতেও এসব আলাপে যোগ দেননি কোনো দিন। অন্ধকার সিনেমা হলে তিনি কথাটা বলে ভালোই করেছেন, নইলে দেখতেন আমি কি রকম কুঁকড়ে গেছি। ‘হ্যাঁ, দুলাভাই,’ কোনো রকমে বলেছিলাম।

দুলাভাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘ওহ গড। মাই ফিউচার ইজ ব্ল্যাক।’ আমার একটু খারাপই লাগল কথাটা শুনে। একটু নীরবতা। আমিও সিনেমায় মন দিতে পারছি না। একটু পর দুলাভাই বলে উঠলেন, ‘একটামাত্র শালা, তার বউকে নিয়ে মজাও করতে পারব না।’

এবার তাঁর চাপা হাসিটা পরিষ্কার শুনলাম। বুঝলাম, আমার সমস্যাটা বোধকরি সমাধান
হয়ে যাবে।

সত্যিই এর চার মাসের মাথায় সমস্যাটা সমাধান হলো, দুলাভাইয়ের কল্যাণে। তবে এভাবে যে হবে, তা আমাদের সবারই কল্পনার বাইরে ছিল। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে প্রোস্টেট অপারেশন করতে গিয়ে মারা গেলেন দুলাভাই। আর তাঁরই কারণে দুই পক্ষের মুরব্বিরা বিয়েটা হুড়োহুড়ি করে দিয়ে দিলেন। সেটা ১৯৭০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। আক্‌দ হলো আমাদের দুলাভাইয়ের কুলখানির পরদিনই।

এক ফ্রেমে অভিনেতা আবুল হায়াত, তাঁর স্ত্রী শিরী হায়াত, ছোট মেয়ে নাতাশা, বড় মেয়ে বিপাশা ও জামাই তৌকীর আহমেদ
ছবি: অভিনেতার পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

এক দিন পর ঢাকা চলে আসতে হলো। চাকরির কারণে। কয়েক মিনিটের জন্য নববধূকে পেয়েছিলাম আমার বড় আপার বাসায় একান্তে। জানালায়–দরজায় উঁকির চোটে একটা ইয়েও কোনো রকমে...বড়ই দুর্ভাগ্য।

৫ জুলাই ট্রেনে চড়ে খুলনায় হাজির হলাম আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে। ৬ তারিখে রকেট সার্ভিসে ফিরে এলাম নারায়ণগঞ্জ ঘাটে। ও হ্যাঁ, ফুলশয্যাটা করেই এসেছি, খুলনার খালিশপুরে আমার প্রিয় বন্ধু ওয়ালিউলের প্রজেক্টের আবাসিকে। ও তখন কেব্‌ল কোম্পানির কাজে প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সেখানে নিয়োজিত।

৮ জুলাই মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার বাসার পাশেই এক নতুন খালি বাড়িতে হলো বউভাত। ব্যস, এরপর কোমর বেঁধে নতুন সংসার গোছাতে নেমে গেল শিরী। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, যে মেয়ে ভাই–ভাবির আদরের দুলাল, অমন ব্রিটিশ কোম্পানির ম্যানেজারের বাসায় যার কুটোটি কোনো দিন ভেঙে খেতে হয়নি, সে নেমে গেল হেঁশেল সামলাতে, ঘরবাড়ি নতুন করে সাজাতে।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে অনায়াসে বাড়ির সব দায়িত্ব নিয়ে নিল। আমি নিশ্চিত হলাম।  কারণ, ভয় ছিল, এই মধ্যবিত্ত পরিবারে সে মানিয়ে নিতে পারে কি না। দুই বোন, আর ছোট ভাগনে কাজল তার ভক্ত আগেই ছিল। এবার ন্যাওটা হয়ে গেল। মমতাজ–পুতুল এখনো শিরীর আদরের ননদিনী। প্রায় প্রতিদিনই ওদের ফোন চলে। কতবার আমাকে বলেছে, ভাবি না থাকলে ভাই আমাদের হয়তো চিনতেও পারত না। কাজল সেই কানাডার সাচকাটন থেকে প্রায় ফোন করে মামির সঙ্গে কথা বলে দীর্ঘ সময়, মামাকে না হলেও তাদের অসুবিধা নেই।

এখনো বেলীর মৌসুমে স্ত্রীর জন্য রোজ মালা কেনেন আবুল হায়াত
ছবি: সংগৃহীত

আম্মাও একসময় অর্থকড়ির ভারমুক্ত হলেন শিরীর হাতে দায়িত্ব দিয়ে। কিছুদিন পর দেখা গেল, মাস শেষে ৫৬৫ টাকা বেতন থেকে ৪০ থেকে ৫০ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। তাতে সবাই মিলে সিনেমা দেখা বা চায়নিজ খাওয়া চলছে। মমতাজ কলেজে, পুতুল আর কাজলও স্কুলে, সব সামলেও সাশ্রয়—চিন্তার বাইরে!

এরপর তো নেমে এল জাতীয় জীবনের মহাদুর্যোগ—বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযোগ আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধ। বিপাশা এল ২৩ মার্চ। বিপাশা যখন পৃথিবীতে এল, আমি অসুস্থ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে পড়ে রইলাম সংজ্ঞাহীন। এরপর তিন দিনের বাচ্চা কোলে নিয়ে পাঁচ মাইল হেঁটে গ্রামে যাওয়া, তিন–চার মাস গ্রামে বাস। যুদ্ধ শেষে সবকিছু আবার নতুন করে গুছিয়ে নেওয়া—সবকিছুর কৃতিত্ব শিরীর।

আমি ছোটবেলা থেকেই ভীরু। আহ্লাদের সন্তান বলে সব সময় একটা মানসিক দুর্বলতা কাজ করে আমার ভেতর। এইটা সামাল দেওয়াও তার প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল, সার্থকতার সঙ্গে আজও সে প্রতিটি বিপর্যয়েই উদ্ধার করে আমাকে।

তার কথাতেই বিদেশ গেলাম, তিন বছর থেকে এসে যতটুকুই হোক সচ্ছল হয়েছি, মানসিকভাবে সরকারি চাকরি ছাড়ার মতো শক্তি অর্জন করে জীবনের ধারাই পাল্টে ফেললাম। একসময় ব্যবসায়ও নামলাম। সেটা ছেড়ে আবার চাকরি। আবার সিনেমা, শেষমেশ প্যাকেজ প্রোগ্রামের পেশা—সবকিছুতেই তার সঙ্গে পরামর্শ
করে এগিয়েছি।

নিজের স্ত্রী সম্বন্ধে এত কিছু বলছি, সবাই ভাববে আমি বাড়িয়ে বলছি। কিন্তু বিশ্বাস করেন, এতটুকু নয়। আমি অভিনয় করি, সে বিয়ের আগেই জানত। সে মেয়েদের লেখাপড়ার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে, সার্থকভাবে তাদের গড়ে তুলেছে, তাদের গান শিখিয়েছে, নাচ শিখিয়েছে। আবার বিপাশা–নাতাশা দুজনকেই মাস্টার্স ডিগ্রি নেওয়ার মতো যোগ্য করেছে এবং তাদের পছন্দের পাত্রের সঙ্গেই বিয়ে দিয়েছে। আমার কৃতিত্ব এটুকুই যে আমি আমার অ্যানালাইসিস দিয়ে শুধু তাকে অনুমোদন দিয়েছি, ‘হ্যাঁ, এটা করতে পারো!’ তাকে কতটা ভালোবাসতে পেরেছি জানি না, তবে এখনো বেলির মৌসুমে সন্ধ্যাবেলা বেলির মালা ছাড়া বাড়ি ফিরি না, সেই বিয়ের পর থেকে আজ অবধি। জানি বেলি তার প্রিয় ফুল।

সার্থকতার সঙ্গে আজও শিরী হায়াত প্রতিটি বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করেন আবুল হায়াতকে
ছবি: সংগৃহীত

যত কিছুই হোক, সে আমার কাছে প্রাণসখা। ৫৪ বছর যৌথ জীবন যাপিত হয়েছে, নানান সুখ–দুঃখ, আনন্দ–বেদনায়। এখনো হাসিমুখে মেয়ে, জামাই, নাতি–নাতনি নিয়ে জীবনের আলো–বাতাস উপভোগ করছি, মহান আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া।

২০২১ ডিসেম্বরে জানতে পারলাম আমি কর্কট রোগে আক্রান্ত। দোষী আমি, নিজের শরীরের প্রতি অবহেলা, ঠিক অবহেলা বলব কি না জানি না, ভয়, হ্যাঁ, ভয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হইনি সময়মতো। শেষবেলায় যখন গেলাম, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। রোগটা বিস্তৃতি লাভ করেছে ইচ্ছেমতো।

মনে পড়ছে সেই রাতটার কথা, রোগের কথাটা চিকিৎসক নিশ্চিত করে বলে দেওয়ার পর। আমি নিশ্চুপ। শিরী বারবার বলছিল, ‘ভেঙে পোড়ো না, এ রোগ তো আজকাল অনেকেরই হয়, আমরা চিকিৎসা করাব, যতটুকু প্রয়োজন, যতটুকু সামর্থ্য সব করব, তুমি নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবে।’ আরও কত কিছু বলছিল, কিন্তু শোনার মতো মন আমার ছিল না তখন।

একসময় রাত এল। দিনের বাদবাকি সময়ের কথাটুকু আর নাইবা বললাম, আমি প্রায় বোবার মতো হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু শিরী ছিল শান্ত আর স্বাভাবিক। অন্ধকার ঘরে আমি একা শুয়ে অশ্রুপাত করছি, একসময় নিঃশব্দে আমার পাশে এসে
শুল শিরী।

নীরব কিছু মুহূর্ত, জীবনে অনেক নাটকে যেমন অভিনয় করেছি, ঠিক তেমনই। হঠাৎ ওর একটা হাত এসে পড়ল আমার গায়ে, ফুঁপিয়ে উঠলাম, সঙ্গে সঙ্গে সে–ও। ‘আমি থাকতে আল্লাহ তাআলা এ রোগ তোমাকে কেন দিলেন?’ বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরল। এ কথার উত্তরে বলার মতো কোনো ভাষা সে সময় আমার ছিল না।

কয়েক বছর কেটে গেছে এরপর। দেশ–বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছি, কাজ করছি, আর যুদ্ধ করছি মরণব্যাধির বিরুদ্ধে। আর এতে প্রধান সহযোদ্ধা শিরী। ছায়ার মতো সে আমার সঙ্গে থেকে প্রতি পদক্ষেপে উজ্জীবিত করছে। আমাকে অনুপ্রাণিত করছে প্রতিমুহূর্তে যুদ্ধ করার জন্য। হ্যাঁ, ওর কারণেই এখনো আমি যুদ্ধরত।

আবুল হায়াতের আত্মজীবনী রবি পথ থেকে (ঈষৎ সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)।