মায়ের আবার বিয়ে!

সবাই ভাবেন, নারী যত কম বয়সেই বিধবা হোন না কেন, বাকি জীবন তিনি সন্তান পালন করেই কাটাবেন। বিকল্প ভাবনা খুব একটা দেখা যেত না। তবে আজকাল কোনো কোনো নারী দ্বিতীয় বিয়ে করছেন। একটা বয়স পর্যন্ত সন্তানদের বড় করার পর মা একা হয়ে পড়েন। কোনো কোনো সন্তান এই একাকিত্বের কথা ভেবে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে মায়ের বিয়ে দিচ্ছেন। পরিবারও পাশে থাকছে।

মা যাতে একা হয়ে না পড়েন, তাই অনেক সন্তান উদ্যোগ নিয়ে মাকে আবার বিয়ে দিচ্ছেন
প্রতীকী এই ছবিটি তুলেছেন সুমন ইউসুফ

১৯৯৩ সালের ঘটনা। হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যান আমার এক ফুপাতো ভাই। ভাবির বয়স তখন ২৩ বছর। আড়াই বছরের মেয়েকে নিয়ে ভাবি যেন অথই সাগরে পড়লেন। আর্থিক সমস্যা না থাকলেও, সেই সময় একা মেয়েকে নিয়ে বাকি জীবন পাড়ি দেওয়াটা তাঁর জন্য অনেক কঠিন ছিল। নিজে নতুনভাবে আবার জীবন শুরু করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুই পরিবারের বাধার মুখে সাহস করে ভাবনাটা আর কাজে পরিণত করতে পারেননি। যখন বড় হলাম, দেখা হলে সেই ভাবি প্রায়ই বলতেন, ‘কেউ তো বুঝল না, আমার জীবনটা কীভাবে যাবে? মেয়েকে নিয়ে কীভাবে এই দীর্ঘ পথ একা পার করছি।’

এখন অনেক পরিবারেই এই চিন্তার বদল ঘটছে। আর এই বদল ঘটাচ্ছেন এই সময়ে বেড়ে ওঠা সেই মায়েদের সন্তানেরা। বাবার মৃত্যু হলে বা বিচ্ছেদের পর মায়েরও যে একজন সঙ্গী প্রয়োজন, সন্তানেরা নিজে থেকেই সেটা উপলব্ধি করে মাকে নতুনভাবে জীবন গড়তে সাহায্য করছেন। তৌহিদা তহু তেমনি একজন মা। দেশীয় পোশাক উদ্যোক্তা হিসেবে ছিলেন পরিচিত মুখ। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর ১১ বছর পর সন্তানেরা আবার তাঁর বিয়ে দিয়েছেন।

পরিবারের আট ভাইবোনের মধ্যে তৌহিদা চতুর্থ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রথম বর্ষে পড়ার সময় তাঁর জীবনে আসেন বিশেষ একজন মানুষ। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, নাম মাহমুদ ইসলাম চৌধুরী, ডাকনাম মিশু। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুদর্শন ছেলে বললেও ভুল হবে না! তহুর তখন বয়স কম। আর সেই সময় প্রেম করাটাকে কেউ স্বাভাবিকভাবে নিতেন না। সেসব নিয়েও কম কথা শুনতে হয়নি। এই অবস্থায় মিশুর পরিবারই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায় তহুর পরিবারের কাছে। খুব দ্রুত সিদ্ধান্তে তাঁদের বিয়ে হয়ে যায়।

এখন অনেক পরিবার চিন্তার বদল ঘটিয়ে মায়েদের দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবছে। ছবিটি প্রতীকী
ছবি: সুমন ইউসুফ

বিয়ের পরও আগের মতোই হোস্টেলেই থাকতেন তহু, আর মিশু ব্যাচেলর বাসায়। এর মধ্যে প্রথম সন্তানের মা হতে চলেন তহু। তখনো স্থায়ী কোনো কাজ করতেন না মিশু। এই নিয়ে যখন দুশ্চিন্তা, এগিয়ে এলেন তহুর মা। বললেন, ‘কোনো চিন্তা কোরো না। সন্তানের দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার।’ মায়ের এই কথায় অনেকটাই নিশ্চিন্ত হলেন মেয়ে। জন্ম নিল তহু–মিশুর প্রথম সন্তান নৈঋতা। মেয়ের বয়স যখন দুই বছর, মিশু পরিবার থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঝড় এসে এলোমেলো করে দেয় তহু–মিশুর সংসার। তহুর গর্ভে তখন দ্বিতীয় সন্তান। ঝড় থেকে ছেলেকে বাঁচাতে আমেরিকায় পাড়ি জমান তহুর শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এরপর স্বামীর সঙ্গে দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ ছিল না। এর মধ্যে তাঁদের ছেলে নম্র আসে পৃথিবীতে। দুই সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় তহুর কঠিন সংগ্রাম। দিনাজপুরে তহুর মায়ের কাছে থাকত তাঁর ছেলে আর মেয়ে। তখন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করতেন তহু। দিনাজপুরে থাকা ছোট্ট দুই সন্তানের জন্য মায়ের মন কাঁদত সারাক্ষণ। পুরো সপ্তাহ অফিস শেষে বৃহস্পতিবার রাতে ছুটে যেতেন মায়ের কাছে। শুক্র–শনিবার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাটিয়ে আবারও ফিরে আসতেন। চাকরিটা ছোট ছিল, তাই বাড়ির লোকজনের ভীষণ আপত্তি ছিল। তবে দিনরাত পরিশ্রম করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন তৌহিদা তহু।

১৯৯৩ থেকে ২০০৯ সাল—দীর্ঘ এই সময়ে মাঝেমধ্যে খোঁজ নিতেন মিশু। তারপর আবার গায়েব হয়ে যেতেন অনেক দিনের জন্য। আবার হঠাৎ করে কিছু টাকা পাঠাতেন। ২০০৯ সালে আমেরিকায় মারা যান মিশু। তহু বলেন, ‘মিশু মারা যাওয়ার পর দেশে লাশ আনানোর ব্যবস্থা করি, শেষবারের মতো ছেলেমেয়েরা যেন বাবাকে দেখতে পায়। শেষবার বলাও ভুল, প্রথমবারের মতো বাবাকে দেখে ছেলে। মেয়ে যদিও বাবাকে আগে দেখেছে, তবে দুই বছর বয়সের সেই স্মৃতিতে বাবা অধরাই ছিল।’

এরপর পেরিয়ে যায় অনেক পথ। সিঙ্গেল মাদার (একা মা) হিসেবে অনেক ঝড় সামলাতে হয়েছে। বড় মেয়ে নৈঋতা এ লেভেল শেষ করে ভারতে পড়তে গেছেন, ছেলেও একসময় বোনের পথ ধরেছেন।

ছেলেমেয়েরা যখন বড় হলেন, তৈরি হলো তাঁদের নিজস্ব জগৎ, তখন কেমন জানি একা হয়ে গেলেন তহু। এই অনুভূতি যে আগেও হয়নি, তা নয়। তৌহিদা বলেন, ‘দিন তো কেটে যেত ব্যস্ততায়। কিন্তু যখন নিজের ঘরে ফিরতাম, নিজেকে খুব একা মনে হতো। মনে হতো পাশে তো কেউ নেই।’

প্রয়োজনে নতুন সঙ্গীর কথা ভাবা দোষের কিছু না। ছবিটি প্রতীকী
ছবি: সুমন ইউসুফ

এর মধ্যে যে নতুন করে জীবন শুরু করার প্রস্তাব আসেনি, তা নয়। কিন্তু সেসব নিয়ে সন্তানদের জীবনে যাতে নতুন কোনো সমস্যা তৈরি না হয়, সে জন্য নিজের কথা আর ভাবেননি। ২০১৯ সালে নৈঋতার বিয়ে হয়ে যায়। এর কয়েক মাস পরের ঘটনা। তহুর ছোট ভাইয়ের বন্ধু শাহরিয়ার হঠাৎ একদিন বাসায় এসে তহুকে বলেন, ‘ছোটবু, চলো গলফ ক্লাবে এক কাপ কফি খেয়ে আসি।’ ভাইয়ের বন্ধুদের সঙ্গে তহুর বেশ সখ্য। এখানেই শাহরিয়ার একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রলোকের নাম শরীফ মাহমুদ হাসান। আর্মিতে ছিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে ‘আপু, তোমরা বসে কফি খাও, আমি চললাম’, বলেই সেদিন চলে যান শাহরিয়ার।

বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন তহু। অপরিচিত লোক, তাঁর সঙ্গে কী কথা বলবেন! একসময় দেরি হচ্ছে দেখে শরীফ মাহমুদও বাড়িতে ফেরার তাড়া দিলেন। গাড়িতে যেতে যেতে ঢাকার রাস্তা নিয়ে অনেক কথা হলো।

এ ঘটনার কয়েক দিন পর শাহরিয়ার তহুকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন, কোনো আপডেট আছে কি না। বাকিটা তহুর মুখেই শুনুন, ‘ওর কথায় আঁচ করতে পারলাম, সে ইচ্ছা করেই মানুষটির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়েছে। এরপর ভদ্রলোক নিজেই ফোন দিলেন, কথাবার্তা হলো। আমি যেমন, ঠিক তার বিপরীত তিনি। কিন্তু তাঁর সততা, ভদ্রতায় মুগ্ধ হলাম। আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২০ সালের ১০ আগস্ট তিনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। দ্বিধায় পড়লাম, সন্তানদের জীবনে এর প্রভাব পড়বে কি না বা আমিই মানিয়ে নিতে পারব কি না—এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। এই সময় এগিয়ে আসে আমার মেয়ে নৈঋতা।’ ঘরের দরজা বন্ধ করে বেশ শক্তভাবে মাকে বোঝান মেয়ে, ‘আমি যখন উচ্চশিক্ষার্থে দূরে কোথাও যাব, তখন মনে হবে, মা দেশে একা কীভাবে সব কাজ করছে। আবার আমার কাছে হয়তো তোমাকে নিয়ে গেলাম, কিন্তু তোমাকে টেককেয়ার করতে করতে আমি আমার কাজই করতে পারলাম না। তখন তোমাকে কিন্তু বোঝা মনে হবে মা।’ জীবনের নানা বাস্তবতার কথা তাঁকে বলেন মেয়ে।

শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নিলেন তহু? ‘মেয়ের কথাগুলো শোনার পর নতুন করে ভাবলাম। মনে হলো, আসলেই তো বাস্তবতা এখন এমন। নিজের মনকে অনেক বোঝালাম। সব দ্বিধা ঝেড়ে ২০২০ সালের ২০ আগস্ট পা রাখলাম নতুন জীবনে।’ মাকে বিয়েতে রাজি করানো থেকে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা—সবকিছুই নিজ হাতে সামলেছেন নৈঋতা আর তাঁর বর জামী। শাশুড়ির গায়েহলুদের অনুষ্ঠানের সব আয়োজন জামাই–ই করেছেন। বাবার ভূমিকা নিয়ে হলুদ ছোঁয়ালেন জামাই। আর তাঁদের এই স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ–আনন্দ ধুয়ে দিল তহুর সব দ্বিধা।

তৌহিদা তহু ও শরীফ মাহমুদ হাসানের সংসারের বয়স প্রায় আড়াই বছর। তৌহিদা তহুর কাছে জানতে চাইলাম, কেমন যাচ্ছে এই অধ্যায়? সংসারজীবনের সবটুকুই যে মসৃণ নয়, সেই অভিজ্ঞতা থেকে তৌহিদা তহু বলেন, ‘ভালো–মন্দ মিলিয়ে ভালোই আছি। এই বয়সে দাম্পত্য মানে তো রোম্যান্স নয়, একটু অন্য রকম কিছু। আমি টিভি দেখছি, আর মাথার কাছে চেয়ার নিয়ে বই পড়ছে শরীফ। মনে হচ্ছে, দিন শেষে আমি তো একা নই, একজন পাশে আছে। এই বয়সে এসে এটাই তো জীবন।’