যে ১০ কারণে স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে বেশি ঝগড়া হয়

সঙ্গীকে সময় না দিলে ঝগড়া হতে পারেমডেল: নাদিরা ও আসিফ। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েই বিয়ে করেন দুজন ব্যক্তি; কিন্তু একসঙ্গে থাকতে শুরু করার পর সবচেয়ে আপন এই মানুষের সঙ্গেও নানা কারণে তৈরি হয় মতবিরোধ। এক কথা, দুই কথায় বাধে ঝগড়া। বয়োজ্যেষ্ঠদের মতে, স্বামী–স্ত্রীর ঝগড়া আসলে এক জায়গায় রাখা দুটি বাসনের ঠোকাঠুকির মতো। এগুলো জীবনেরই অংশ; কিন্তু এই ঠোকাঠুকি বাড়তে দিলেই বিপত্তি। তাই দাম্পত্য জীবনে ঝগড়া কমিয়ে আনতে চাইলে প্রথমে মতবিরোধের কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্বজুড়ে কী কারণে দাম্পত্যে ঝগড়া হয় বেশি, চলুন আগে সেটিই জেনে নেওয়া যাক।

১. বোঝাপড়ার অভাব

নাবিলা ও রাফি (ছদ্মনাম) দুজনেই চাকরিজীবী। কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরে ক্লান্ত নাবিলা আশা করেন, স্বামী তাঁর কাছে জানতে চাইবেন সারা দিন কেমন কাটল। কিন্তু তা না করে চুপচাপ নিজের মনে ফোন স্ক্রল করেন রাফি।

স্বামীর এমন আচরণে কষ্ট পান নাবিলা। অন্যদিকে রাফি ভাবেন, সারা দিন কাজের পর স্ত্রীর হয়তো কথা বলতে ইচ্ছা করছে না, ও একটু নিজের মতো থাকুক। দুজনের চাওয়া ভিন্ন। এভাবে নিজের প্রত্যাশার কথা না জানিয়ে দিনের পর দিন কাটাতে থাকলে মনের ভেতর ক্ষোভ জমা হতে থাকে।

আবার বাসার বাড়তি বিল নিয়ে রাফি যখন চিন্তিত, সেটিকে পাত্তা না দিয়ে হেসে উড়িয়ে দিলেন নাবিলা। এভাবে অপর পক্ষকে কষ্ট দিতে না চেয়েও কষ্ট দিচ্ছেন তাঁরা। দাম্পত্য কলহ নিয়ে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণা করা মার্কিন মনোবিজ্ঞানী জন গটম্যান জানান, ৬৯ শতাংশ বৈবাহিক দ্বন্দ্বের কারণ পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব।

আরও পড়ুন

২. অর্থনৈতিক হিসাব

একজন বাইরে খেতে ভালোবাসেন, অন্যজন সঞ্চয়ে বিশ্বাসী। আর এতেই বাধে বিপত্তি। এ ছাড়া দুজনেই আয় করলে কে কোন খাতে ব্যয় করবেন, তা নিয়েও ঝগড়া করেন দম্পতিরা। দীর্ঘদিন ধরে দাম্পত্য বিচ্ছেদ নিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম।

অভিজ্ঞতার আলোকে এই আইনজীবী বলেন, ‘কেউ নিজের শখ পূরণ করতে গিয়ে অন্যের দিকটা ভাবছেন না, কেউ আবার নিজের ইচ্ছা–অনিচ্ছায় ক্রমাগত ছাড় দিয়েই যাচ্ছেন। সংসারে বারবার একপক্ষীয় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে যিনি ছাড় দিচ্ছেন, তাঁর মনে অসন্তুষ্টি তৈরি হয়, যা একসময় বড় ঝগড়ায় রূপ নেয়।’

এ ছাড়া ছোটখাটো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও ঝগড়া করেন দম্পতিরা। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণা বলছে, টাকাপয়সা নিয়ে ঝগড়া করা দম্পতিদের ৩০ শতাংশই সম্পর্কে খুশি থাকেন না।

৩. সময় না দেওয়া

সঙ্গীকে সময় না দিলে দ্বন্দ্ব বাড়ে
মডেল: নাদিরা ও আসিফ। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

দাম্পত্যে উপেক্ষার কোনো জায়গা নেই। শত ব্যস্ততার মধ্যেও সঙ্গীর জন্য সময় বের করা একটি নৈতিক ও পারিবারিক দায়িত্ব। জার্নাল অব ম্যারেজ অ্যান্ড ফ্যামিলিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব দম্পতি নিজেদের মধ্যে প্রতিদিন ৩০ মিনিটের কম একান্তে সময় কাটান, তাঁদের সম্পর্কে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়, বাড়ে দ্বন্দ্বের মাত্রা।

৪. ঈর্ষা, সন্দেহ ও অবিশ্বাস

স্বামী–স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক। একজনের সাফল্যে অন্যজন আনন্দিত ও গর্বিত হবেন—এটিই স্বাভাবিক। উল্টোটা ঘটলেই মুশকিল। একে অপরকে প্রতিযোগী ভাবলে বৈবাহিক জীবনে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম বলেন, ‘বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে সঙ্গীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে সন্দেহের চোখে দেখেন অনেকে। সন্দেহ বাড়তে বাড়তে তৈরি হয় অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা। দীর্ঘমেয়াদি ঈর্ষা দাম্পত্যে ঘনিষ্ঠতা কমায়, বাড়ায় মানসিক চাপ। তাই এসব দিকে দুজনেরই নজর রাখা উচিত।’

আরও পড়ুন

৫. অসম যৌনতা

সঙ্গীর প্রতি যৌন আগ্রহের অভাব দাম্পত্য কলহের একটি অন্যতম কারণ। একজন আলিঙ্গন, স্পর্শ বা শারীরিক ঘনিষ্ঠতা চাচ্ছেন, অথচ অন্যজন ক্লান্তি, মানসিক চাপ বা অবসাদের কারণে শারীরিক সম্পর্কে অনাগ্রহী—এমন হলে তাঁদের সম্পর্কে অসন্তুষ্টি থেকে যৌন অসমতা তৈরি হয়। শারীরিক সম্পর্কের অভাবে দূরত্ব বাড়ে।

আর্কাইভস অব সেক্সুয়াল বিহেভিয়ার অনুসারে, শারীরিক চাহিদার মিল না থাকলে সম্পর্কে অসন্তুষ্টি বাড়ে, আবেগসংক্রান্ত যোগাযোগ কমে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এসব থেকে পারিবারিক কলহ তৈরি হয়।

৬. দায়িত্বে অসমতা

দাম্পত্য সম্পর্কে দায়িত্ব পালনে অসমতা কলহ বাড়ায়
মডেল: নাদিরা ও আসিফ। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

আমাদের দেশে কর্মস্থলের কাজ শেষে বাসায় ফিরে রান্না থেকে শুরু করে ঘরের যাবতীয় কাজ সাধারণত স্ত্রীরাই করেন। স্ত্রীর কোনো কাজেই সাহায্য করেন না স্বামী। আবার হয়তো সংসারের খরচ জোগাতে একাই খেটে যাচ্ছেন স্বামী, আয় না করলেও ব্যয়ের ব্যাপারে অসচেতন স্ত্রী।

দাম্পত্য সম্পর্কের দায়িত্ব পালনে এমন অসমতা কলহ বাড়াবেই। কাজকর্মে, লক্ষ্য পূরণে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে একে অপরকে সাহায্য না করা নিয়ে ঝগড়া করেন দম্পতিরা।

৭. পরিকল্পনায় মতভেদ

হয়তো বিদেশে যেতে চান একজন, অন্যজন পরিবারের সঙ্গে দেশেই থাকতে চান। কবে সন্তান নেবেন—এই নিয়েও ঝগড়া করেন দম্পতিরা। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় অসংগতি ও মতভেদ সম্পর্কে চাপ সৃষ্টি করে।

এতে তাঁরা একে অপরের থেকে মানসিকভাবে দূরে সরে যেতে শুরু করেন। আর মতের পার্থক্য থাকায় দুজনের মধ্যে ঝগড়া হতে থাকে।

আরও পড়ুন

৮. তৃতীয় ব্যক্তির হস্তক্ষেপ

সম্পর্কে তৃতীয় কাউকে জায়গা দিতে নেই। সম্পর্কের একান্ত বিষয়গুলো নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে তৃতীয় কাউকে জানালে তা ভালো কোনো ফল বয়ে আনে না।

কেউ অন্ধের মতো শ্বশুর–শাশুড়ি, মা–বাবা, ভাই–বোন, বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের পরামর্শে চলতে চাইলে বৈবাহিক সম্পর্কে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। দুজনের একান্ত বিষয়গুলোতে অন্য কাউকে ঢুকতে না দেওয়াই ভালো।

৯. ব্যক্তিত্বের ভিন্নতা

নিজের মত সময় টাকানো নিয়েও ঝগড়া বা অসন্তোষ তৈরি হয়
ছবি: সুমন ইউসুফ

বাটারফ্লাই ম্যাট্রিমনিয়াল প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্ক–বিষয়ক পরামর্শক হুরায়রা শিশির বলেন, ‘একজন হয়তো সঙ্গীর সঙ্গে একান্তে গল্প করতে চান, অন্যজনের পছন্দ বন্ধুদের নিয়ে হুল্লোড়। দুজনের ব্যক্তিত্ব ভিন্ন হতেই পারে, কিন্তু একজন অন্যজনের ব্যক্তিত্বকে সম্মান না করলে সেটা ঝগড়ায় রূপ নেয়।’

১০. অমীমাংসিত অতীত

অনেক সময় ঝগড়া শেষ হলেও অন্যজনের ক্ষোভ থেকে যায়। সেটি মিটমাট না হলে দীর্ঘদিন জমতে জমতে বড় আকার নেয়। যেকোনো ছোটখাটো বিষয়ে সেই জমিয়ে রাখা ক্ষোভ তখন বেরিয়ে আসতে চায়। এভাবে ঝগড়া করার সুযোগ তৈরি হয়। তাই যেকোনো সমস্যা হলে সেটি দ্রুত মিটিয়ে নেওয়া জরুরি।

সূত্র: দ্য সাইকোলজি টকস, ম্যারেজ ডটকম ও ফোকাস অন দ্য ফ্যামিলি

আরও পড়ুন