কল্পনায় প্রেম-ভালোবাসার মতো ‘ডিলিউশনশিপ’ কি আপনারও আছে?

মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ডিলিউশন হলো এমন কিছুকে বিশ্বাস, বাস্তবে যার অস্তিত্ব নেই। প্রথাগত বিশ্বাস বা ধারণার বাইরে একজন মানুষ হঠাৎ কিছু একটা বিশ্বাস করতে শুরু করলে সেটাকেই বলা হয় ডিলিউশন। তেমনই এক অবাস্তব সম্পর্ক হলো ডিলিউশনশিপ। সম্পর্কটা অবাস্তব হলেও চমৎকার এক অনুভূতির উৎস। প্রথাগত সম্পর্কের চেয়ে একেবারেই আলাদা। জেন-জির কারও কারও মধ্যে এমন সম্পর্ক গড়ার প্রবণতা দেখা যায়।

ডিলিউশনশিপে ভুগলে কল্পনায় কারও প্রেমে পড়ে তার সঙ্গে সময় কাটাতে দেখা যায়মডেল: কোকো। ছবি: কবির হোসেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী ও পিএইচডি গবেষক হাজেরা খাতুন বলেন, ‘ডিলিউশনশিপ একধরনের কাল্পনিক সম্পর্ক। এ সম্পর্কে পছন্দের মানুষটিকে নিয়ে কল্পনার জগতে আনন্দময় সময় কাটানো হয়। তবে পছন্দের মানুষের কাছে বাস্তবে নিজের অনুভূতির কথা প্রকাশ করা হয়ে ওঠে না। আর এর পেছনে থাকে মানুষটির সঙ্গে স্বাভাবিক দেখাসাক্ষাতের সুযোগ হারানোর ভয়।’ চলুন, এই বিশেষজ্ঞের কাছ থেকেই ডিলিউশনশিপের বিস্তারিত জেনে নিই।

কেন হয় এমন সম্পর্ক?

পছন্দের মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিক একটি সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ যেখানে খুব কম, সেখানে গড়ে ওঠে ডিলিউশনশিপ। ধরা যাক, একজন শিক্ষককে কোনো শিক্ষার্থী প্রেমের দৃষ্টিতে দেখে। শিক্ষক বয়সে অনেক বড়, তিনি সব শিক্ষার্থীকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেন। যে শিক্ষার্থীর মন প্রেমের আবেগে ভেসে যাচ্ছে, সে নিজেও জানে, এই সম্পর্ক সম্ভব নয়। তবু সে মন থেকে ওই শিক্ষককে মুছে ফেলতে পারে না। বরং ওই শিক্ষককে নিয়ে কল্পনার জগতে ডানা মেলে। বাস্তবে ওই শিক্ষক যদি সবারই প্রশংসা করেন, তবু ওই শিক্ষার্থীর মনে হয় তাকে একটু বিশেষভাবে প্রশংসা করেছেন। ব্যাপারটা ঠিক ভালো লাগা বা ‘ক্রাশ’ নয়, তার চেয়ে আরও একটু বেশি।

ডিলিউশনশিপে কারা জড়ান?

যাঁরা একটু বেশি আবেগপ্রবণ, অন্যের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে যাঁদের সংকোচ হয় কিংবা যাঁরা কোনো অনিশ্চয়তায় ভোগেন, তাঁরা ডিলিউশনশিপের দিকে ঝুঁকতে পারেন। তাঁদের আত্মমর্যাদাবোধ একটু কম থাকতে পারে, থাকতে পারে যৌক্তিক ভাবনা আর বাস্তব জ্ঞানের ঘাটতি। কল্পনার জগৎটা তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। উঠতি বয়সেই এমনটা হয়। স্বাভাবিক কোনো সম্পর্কে জড়ানোর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নানা কারণে যাঁরা তা পেরে ওঠেননি বা কোনো কারণে সম্পর্ক ভেঙে গেছে, তাঁরাও জড়াতে পারেন ডিলিউশনশিপে। তবে এ সময়ের তরুণ প্রজন্ম; অর্থাৎ জেন-জিদের মধ্যে এমনটা দেখা যাওয়ার অর্থ কিন্তু এই না যে এটি তাঁদেরই প্রবর্তিত কোনো ধারা। বরং যুগে যুগেই উঠতি বয়সীরা এ ধরনের সম্পর্কে জড়িয়েছেন। তবে এ ধরনের সম্পর্কের নাম যে ডিলিউশনশিপ, তা হয়তো অনেকেরই তখন জানা ছিল না।

এ সম্পর্কের পরিণতি কী?

কল্পনার জগতে ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে দারুণ আনন্দে সময় কাটে ডিলিউশনশিপে
প্রতীকী ছবি: প্রথম আলো

ডিলিউশনশিপে থাকার কারণে বাস্তবে পছন্দের মানুষটির সামনে নিজেকে ইতিবাচকভাবে প্রকাশ করার জন্য অনেকে ভালো কাজের চর্চা করেন। তাই ব্যাপারটিকে পুরোপুরি মন্দ বলারও সুযোগ নেই। আর এই কল্পনার জগতে বিচরণের সময় তিনি সত্যিই দারুণ আনন্দে থাকেন। তবে ব্যাপারটা মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে মুশকিল। দিনের অধিকাংশ সময়ই যদি কল্পনার জগতে কেটে যায়, পছন্দের মানুষটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রাখেন, তাহলে স্বাভাবিকতা হারায় জীবন। একসময় বাস্তব জীবনে অন্য কারও কাছ থেকে সত্যিকার প্রেমের দেখা পেলেও পুরোনো ডিলিউশনশিপের সেই ভালো লাগাটা কোথাও খুঁজে পান না তিনি। নতুনভাবে একটা বাস্তব সম্পর্ক শুরু করতে সমস্যা হতে পারে তাঁর।

আরও পড়ুন

ডিলিউশনশিপ থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসবেন

ডিলিউশনশিপ কোনো অপরাধ নয়, বরং মানুষের স্বাভাবিক আবেগিক অনুভূতির ভিন্নতর প্রকাশ। তবে এ কারণে জীবনের স্বাভাবিকতা ব্যাহত হলে তা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। নিজের শক্তির জায়গাগুলো খুঁজে বের করতে হবে, আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। নিজেকে বোঝাতে হবে, বাস্তবে আরও অনেক রোমাঞ্চ অপেক্ষা করছে। জীবন তো সত্যিই এক অজানা রহস্য। ভালো থাকার জন্য বাস্তবের বিভিন্ন সম্পর্কে সময় দিতে হবে। পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে ভালো সময় কাটানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে খুব কাছের কারও সঙ্গে বিষয়টা ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে, যিনি বিষয়টি অবশ্যই গোপন রাখবেন। উঠতি বয়সী সন্তানের অভিভাবকদেরও উচিত, সন্তানের আচরণে কোনো অসংগতি দেখা দিলে এ বিষয়ে খোলামেলাভাবে আলাপ করা। কাছের মানুষদের সহায়তায় স্বাভাবিক ভাবনার জগতে ফিরে আসা খুব কঠিন ব্যাপার নয়। প্রয়োজনে পেশাদার ব্যক্তির সহায়তা নিন।

আরও পড়ুন