বিয়ের পরও অন্য ছেলেকে এসএমএস করে, ‘আই মিস ইউ জান’

পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার

ব্যারিস্টার মিতি সানজানা

প্রশ্ন: আমরা চার ভাই এক বোন। আমার বাবার বাড়িতে অনেক জমিজমা আছে। অন্যদিকে মেয়ের পরিবার মেয়ের সৎমামার বাড়িতে থাকে। নিজেদের জমি নেই। মেয়ের বাবা দুই বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রী তালাকপ্রাপ্ত। দ্বিতীয় স্ত্রী তিনটি বিয়ে করেছেন। প্রথম ঘরে সন্তান নেই। দ্বিতীয় ঘরে একটি মেয়ে, তৃতীয় ঘরে দুটি মেয়ে। আমার সঙ্গে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে।

আমার অভিযোগ অনেক। যেমন অন্যের জমি–বাড়ি নিজের বলে দেখিয়ে বিয়ে করানো, সৎমায়ের তথ্য গোপন রাখা, বিয়ের দুই দিন পরই আমার সঙ্গে অজামাতাসুলভ আচরণ, ইত্যাদি। তাঁদের মেয়ে আমার বাড়িতে আসার পর অন্য ছেলেকে ‘আই মিস ইউ জান’ লিখে মেসেজ করেছে। সব মিলিয়ে আমি সব দিক থেকেই প্রতারিত হয়েছি।

এমন অবস্থায় আমি তালাক চাচ্ছি। কাবিন তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। বিয়ে এক বছর পেরিয়েছে। চাওয়া সত্ত্বেও কাবিনের কাগজ আমাকে দেওয়া হয়নি। মেয়ে মোহরানা ছাড়া তালাক দিতে রাজি। কিন্তু মেয়ের বাবা, সৎমা, আপন মায়ের পরিবার—সবাই মিলে মোহরানার টাকা ছাড়া তালাক দিতে রাজি নয়। আর আমার কথা হলো, আমি একটি ভালো মেয়ে নিয়ে সংসার করতে চেয়েছি। তাঁরা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আমি কেন টাকা দেব। আমি এখন কী করতে পারি। কীভাবে তালাক দিতে পারি, জানাবেন প্লিজ।

জাহিদ

উত্তর: আপনার প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। আপনার চিঠি পড়ে বুঝতে পারছি, বিয়ের আগে আপনার স্ত্রী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন আপনার কাছে অনেক তথ্য গোপন করেছেন। তাঁদের এ ধরনের আচরণে আপনি প্রতারিত বোধ করছেন এবং তালাকের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে আমি শুধু আইনি পরামর্শের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব।

মোহরানা নিয়ে আপনার প্রশ্নের উত্তরে বলতে চাই, স্ত্রী বা স্বামী যে কেউ তালাক দিক না কেন, সব ক্ষেত্রেই দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। তালাকের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ১৯৬১ সালের পারিবারিক আইনের ১০ ধারা মোতাবেক দেনমোহর প্রদানের পদ্ধতি সম্পর্কে কাবিনে বিস্তারিত উল্লেখ না থাকলেও স্ত্রী চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করতে হবে। তবে স্ত্রী যদি দেনমোহর পরিত্যাগ করে, সে ক্ষেত্রে তা দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। স্ত্রী ইচ্ছা করলে আংশিক বা সম্পূর্ণ দেনমোহর মওকুফ করে দিতে পারে। এর জন্য কোনো প্রতিদান প্রয়োজন নেই। তবে তা অবশ্যই স্ত্রীর পূর্ণ সম্মতিতে হতে হবে। কাজেই এ সম্পর্কে আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে দেখতে পারেন।

কাবিননামার কপি আপনি নির্ধারিত ফি দিয়ে সংশ্লিষ্ট কাজি অফিস থেকে তুলতে পারবেন।

তালাক দেওয়ার বিষয়ে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে—তালাক ঘোষণার পর, অন্য পক্ষ যে এলাকায় বসবাস করছেন, সে এলাকার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র বা সিটি করপোরেশনের মেয়রকে লিখিতভাবে নোটিশ দিতে হবে। সেই সঙ্গে তালাকগ্রহীতাকে নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তালাকের নোটিশটি কত সময়ের মধ্যে পাঠাতে হবে। আইনে বলা আছে, তখনই বা পরবর্তী সময়ে বা যথাশিগগির সম্ভব। নোটিশ পাঠানোর কাজটি ডাকযোগেও হতে পারে, আবার সরাসরিও হতে পারে। ডাকযোগে রেজিস্ট্রি করে এডি (অ্যাকনলেজমেন্ট ডিউ) সহযোগে পাঠালে ভালো হয়।

চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে যে তারিখে নোটিশ পৌঁছাবে, সেদিন থেকে ৯০ দিন পর বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক কার্যকর হবে। এ নোটিশ পাওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে সালিসি পরিষদ গঠন করে সমঝোতার উদ্যোগ নিতে হবে। নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সালিসের কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হলেও তালাক কার্যকর বলে গণ্য হবে। এ বিষয়ে একজন আইনজীবীর পরামর্শ নেবেন।

আপনি বলেছেন মেয়েটি ও তার পরিবার আপনার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। কেউ যদি প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে কারও কাছ থেকে কোনো অর্থনৈতিক সুবিধা বা তাঁর ওপর প্রভাব বিস্তার করে কোনো কিছু আদায় করে, সে ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনা যেতে পারে। তবে এসব অভিযোগ আপনাকে আদালতের সামনে প্রমাণ করতে হবে।

দণ্ডবিধির ৪১৫ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি যদি অসৎ উদ্দেশ্যে কারও ওপর প্রভাব বিস্তার করে তাঁর কাছ থেকে কোনো কিছু আদায় করে, সেটা ওই ব্যক্তির সম্মতি সাপেক্ষে হলেও প্রতারণা হবে। এই অপরাধের জন্য এক বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রয়েছে। যদি আপনি প্রমাণ করতে পারেন যে আপনার স্ত্রী ও তাঁর পরিবার আপনার কাছ থেকে কোনো সুবিধা নেওয়ার উদ্দেশ্যে আপনার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে এবং আপনার বিশ্বাস অর্জন করে তারপর আপনার ক্ষতিসাধন করেছে, তবে অবশ্যই এর জন্য আইনি প্রতিকার রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা প্রতারণার উদ্দেশ্য নিয়েই আপনার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারণার জন্য ঘটকের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

দণ্ডবিধির ৪০৬ ধারায় বলা আছে, অপরাধজনিত বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে দোষী হলে দায়ী ব্যক্তিকে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। বিশ্বাসভঙ্গ একটি জামিন অযোগ্য অপরাধ। থানায় এজাহার করে মামলা করা যায় অথবা আদালতে সরাসরি মামলা করা যায়। আশা করি আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন। আপনার জন্য শুভকামনা।

পাঠকের প্রশ্ন পাঠাবেন যেভাবে

পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে।

ই–মেইল ঠিকানা: [email protected] (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’)

ডাক ঠিকানা: প্র অধুনা, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’)

ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA