সান্ত্বনা দিতে গিয়ে উল্টো বিরক্তির কারণ হয়ে উঠছেন না তো

দুঃখকে পুরোপুরি বাতিল করে প্রতিটি মুহূর্ত হাসিখুশি থাকার যে চাপ, তাই টক্সিক পজিটিভিটি (বিষাক্ত ইতিবাচকতা)
ছবি: পেক্সেলস

ধরুন, আপনার কোনো বন্ধুর মন খুব খারাপ। সে আপনাকে তার মন খারাপের কথা শোনাচ্ছে। আপনি তার মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিলেন। এরপর পিঠ চাপড়ে দিয়ে মন খারাপ করতে নিষেধ করলেন। হাসিখুশি থাকতে বললেন। এখানেই শেষ নয়। এই খারাপ ঘটনা ঘটার ফলে তার কী উপকার হলো বা ভবিষ্যতে কী কী উপকার হবে, সেটারও একটা লম্বা ফিরিস্তি তাকে শুনিয়ে দিলেন!

আপনি হয়তো ভাবছেন, খুব একটা কাজের কাজ করলেন। খারাপ সময়েও পজিটিভিটি (ইতিবাচকতা) ছড়ালেন। বন্ধুকে খুব সান্ত্বনা দিলেন। অথচ বাস্তবতা হলো, নিজের অজান্তেই আপনি নিজেকে তার কাছে একজন নেতিবাচক মানুষ হিসেবে প্রমাণ করে ফেলেছেন। পরেরবার মন খারাপের সময় সে আর আপনার কাছে আসবেই না। মন খারাপের কথা ভাগাভাগি করতে যাবে না। কারণ, আপনি তার কথা না শুনে তার ওপর পজিটিভিটি চাপানোর চেষ্টা করেন বেশি!

‘টক্সিক পজিটিভিটি’ জিনিসটা কী?

টক্সিক পজিটিভিটি হলো, একটা মানুষ যতই দুঃখ, কষ্ট বা হতাশার মধ্য দিয়ে যাক, তাকে জোর করে সুখী দেখানোর চেষ্টা করা। দুঃখকে পুরোপুরি বাতিল করে প্রতিটি মুহূর্ত হাসিখুশি থাকার যে চাপ, তাই বিষাক্ত ইতিবাচকতা (টক্সিক পজিটিভিটি)।

পজিটিভিটি কখন ভালো আর কখন বিষাক্ত?

প্রথমেই বলে রাখি, পজিটিভিটি খুব অসাধারণ একটা ব্যাপার। সুন্দর কথা, অনুপ্রেরণা ও বিপদের সময় আরেকজনকে আশা দেওয়াও খুব ভালো কাজ। তবে এই ভালো কাজ করতে গিয়ে যখন আমরা মানুষের আবেগকে ছোট করে দেখি বা কারও মন খারাপের অনুভূতি মনোযোগ দিয়ে শোনার বদলে বিরাট লেকচার দিয়ে বসি, তখন সেটা মাঝেমধ্যেই টক্সিক পজিটিভিটিতে রূপ নেয়। চারপাশে এত এত অনুপ্রেরণার ভিড়ে আপনার একান্ত আবেগ আর অনুভবগুলোও মাঝেমধ্যে চাপা পড়ে যায়। কারও দুঃখের কথা, কষ্টের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার পর নরম কণ্ঠে আশার কথা বলা মানুষকে সান্ত্বনা দেয়। আর কারও কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার আগেই, আবেগ প্রকাশকে পাত্তা না দিয়েই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে টাইপের মন্তব্য মানুষকে বিরক্ত করে, তৈরি করে অবহেলার অনুভূতিও।

কী বলবেন, কী বলবেন না

আপনার মধ্যেও যদি এই টক্সিক পজিটিভিটির অভ্যাস থেকে থাকে, তবে আপনার উচিত সেখান থেকে বের হয়ে আসা। কারণ, উদ্দেশ্য যত ভালোই থাকুক, আপনার এই জোর করা পজিটিভিটি মানুষের ওপর ইতিবাচক প্রভাব তো ফেলেই না, বরং ওপাশের মানুষটাকে আরও বেশি চাপের ভেতরে ফেলে দেয়। মানসিক যন্ত্রণা বাড়ায়। তারা না পারে ঠিকঠাক আবেগটাকে প্রকাশ করতে, না পারে নিজেদের দোষারোপ করা বন্ধ করতে। কাজেই, টক্সিক পজিটিভিটির বদলে তাদের দুঃখ, কষ্টের আবেগকে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করুন। কম বলুন, বেশি শোনার চেষ্টা করুন। যার গল্প, তাকে বলতে দিন, কারও মুখ থেকে কথা কেড়ে নেবেন না। কোনো কিছু অনুমান করে না নিয়ে আগে বিস্তারিত জেনে নিন।

টক্সিক পজিটিভিটি সম্পর্কে ডেকে আনতে পারে দূরত্ব
ছবি: পিক্সাবে

সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের আবেগ ও অনুভূতিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখুন। তার সমব্যথী হন। ‘তৈরি’ (রেডিমেড) সমাধান হাতে তুলে দেওয়ার আগে তাকেই প্রশ্ন করুন, কীভাবে আপনি তাকে সাহায্য করতে পারেন? নন-জাজমেন্টাল আচরণ করতে শিখুন। কী করলে কী হতো এবং ভবিষ্যতেও কী করলে কী হবে, এসব নিয়ে কথা বলা ছেড়ে দিন; বরং তার বর্তমানের জন্য দুঃখিত হোন। কষ্ট পাওয়া যে জীবনের স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া, আমাদের সবাইকেই যে নানা সময় এই কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, কথাটা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করুন। এতে কষ্টের সমাধান না হলেও কিছুটা লাঘব হওয়ার কথা।

আমাদের সব সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানের দরকার নেই। সব কষ্টের ভালো দিক অবশ্যই আছে, শিক্ষাও আছে, তবে খুব খারাপ সময়ে এসব নিয়ে কথা না বলাই ভালো। সব সময় মানুষ মন খারাপের সমাধান খোঁজে না। সব দুঃখ-কষ্টের সমাধান আসলে হয় না। কাজেই, সমাধানের চেষ্টা না করে বরং তাদের মন খারাপের গল্পটাই মন দিয়ে শুনুন। তাদের দুঃখের কথা তাদের মতো করেই বলতে দিন, তাদের দুঃখে একটু সমব্যথী হোন। এটুকুই আপনাকে একজন সত্যিকারের ইতিবাচক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে।

সূত্র: ফোর্বস

আরও পড়ুন