পরিবার, সম্পর্ক ও চাকরিতে জেনারেশন গ্যাপ কমাতে কী করবেন
‘জেন-জি’ শব্দটি সবার কাছেই বেশ পরিচিতি পেয়েছে। ১৯৯৭ থেকে ২০১২–র মধ্যে যাঁদের জন্ম, সেই প্রজন্মকে বলা হচ্ছে ‘জেন-জি’। এ রকম আরও কিছু শব্দ আছে, যেগুলো দিয়ে আলাদা আলাদা প্রজন্মকে চেনা যায়। যেমন বুমারস (১৯৪৬-৬৪), জেন এক্স (১৯৬৫-৮০), মিলেনিয়ালস (১৯৮১-৯৬), জেন আলফা (২০১৩-২৪)।
প্রতিটি প্রজন্মেরই রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি প্রজন্মেরই যোগাযোগের ধরন, মূল্যবোধ ও সমাজকে দেখার চোখ ভিন্ন। এক প্রজন্মের সঙ্গে অন্য প্রজন্মের এসব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের তফাতকেই আমরা বলছি ‘জেনারেশন গ্যাপ’ বা ‘প্রজন্ম ব্যবধান’।
জেনারেশন গ্যাপের কারণে দেখা দিচ্ছে নানা সমস্যা। পরিবার, সম্পর্ক ও কর্মক্ষেত্র—সবখানেই জেনারেশন গ্যাপের ফলে তৈরি হচ্ছে ভুল–বোঝাবুঝি ও তিক্ততা। এ সমস্যাগুলো এড়াতে প্রতিটি প্রজন্মের মানুষেরই অপর প্রজন্মের মানুষদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে।
নিজের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে না মিললেই তাকে সরাসরি নাকচ করে দেওয়া যাবে না। বরং একে অপরের বৈশিষ্ট্যকে আমলে নিয়ে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটি ঠিক রাখতে হবে। এতে করে প্রজন্মগুলোর মধ্যে সহাবস্থান তৈরি হবে, কমানো যাবে জেনারেশন গ্যাপ।
পরিবারে পারস্পরিক বোঝাপড়া
আমাদের দেশের পরিবারগুলোয় ‘অর্ডার’ ওপর থেকে নিচের দিকে আসার নিয়ম প্রচলিত। সাধারণত বড়রা যা বলেন বা সিদ্ধান্ত দেন, ছোটরা বিনাবাক্যে সেটি মেনে নেন। কথা বা সিদ্ধান্তটি যদি ভুলও হয়, ছোটরা সঙ্গে সঙ্গে সেটি বলেন না।
পরে ভুল প্রমাণিত হলে হয়তো অল্প কিছু বলেন বা তা–ও বলেন না। এ বৈশিষ্ট্যগুলো সাধারণত বুমারস ও মিলেনিয়ালসদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। তাঁরা যেহেতু এই পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন, ছোটদের কাছ থেকেও তাঁরা তেমনটিই আশা করেন।
তবে বর্তমান প্রজন্ম, বিশেষত জেন-জি, প্রচলিত এই বৈশিষ্টগুলোর বাইরে অবস্থান করছে। পরিবারের বড়দের কেউ কোনো কথা বললে বা সিদ্ধান্ত দিলে সেটি যদি তাঁদের কাছে ভুল মনে হয়, তাঁরা তা সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিতে পছন্দ করেন।
দেখা যাচ্ছে, মা–বাবা হয়তো মিলেনিয়ালস, তাঁরা আশা করেন, তাঁদের সন্তানও তাঁদের মতো বিনা বাক্যে সব সিদ্ধান্ত মেনে নেবে। কিন্তু তেমনটি ঘটছে না। এতে করে জেন-জিরা পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন।
আবার এই প্রবণতার কিছু সামাজিক প্রভাবও চোখে পড়ছে। জেন-জিদের এই বৈশিষ্ট্য তাঁদের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিতেও উৎসাহিত করছে। অপ্রিয় হলেও সত্য, আমরা পরীক্ষা না দিতে চাওয়ার জন্য আন্দোলন, ফলাফল মনমতো না হওয়ায় আন্দোলনের মতো বিভিন্ন আন্দোলন প্রত্যক্ষ করছি।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একে অপরকে কিছুটা ছাড় দিতে হবে। পরিবারের বড়দের বুঝতে হবে, প্রযুক্তির সহায়তায় ছোটরা দ্রুত পৃথিবী সম্পর্কে জানছে, তাঁরা আলাদা আলাদা সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সংস্পর্শে আসছে। এতে করে তাঁদের মনন নতুনভাবে গড়ে উঠছে। ফলে তাঁদের মতামতকে সেভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।
আবার পরিবারের যাঁরা ছোট আছেন, তাঁদেরও বড়দের অভিজ্ঞতার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বড়দের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া জ্ঞানকে সম্মান করতে হবে। বড়দের কেবল তাঁদের প্রযুক্তিজ্ঞানের ভিত্তিতে বিচার করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, তাঁরা দীর্ঘ জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছেন, এই বিষয়টিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে হবে।
সম্পর্কে যাওয়ার আগেই ভাবা
প্রেম বা বিয়ে, দুই ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রেই জেনারেশন গ্যাপের বিষয়টি গুরত্বপূর্ণ। সাধারণত দেখা যায় এসব ক্ষেত্রে অনেকেই আবেগতাড়িত হয়ে দ্রুত সম্পর্কে চলে যান। পরে যা নানা সমস্যা তৈরি করে। প্রথমেই যে সমস্যাটি দেখা দেয়, পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
সেটি পোশাক থেকে শুরু করে সিনেমা বাছাই, সবক্ষেত্রেই হতে পারে। বয়সের বেশি ব্যবধানের কারণে একজন যেমন পোশাক পরতে বা সিনেমা দেখতে চান, অন্যজনের সেগুলো হয়তো পছন্দ হয় না।
একজন হয়তো সত্তর বা আশির দশকের সিনেমা দেখছেন, অপরজন দেখতে চান এই সময়ের সিনেমা। এসব ক্ষেত্রে একে অপরের ওপর নিজের পছন্দ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে সম্পর্কে আসে তিক্ততা। ধীরে ধীরে সম্পর্কের মধ্যে তৈরি হয় দূরত্ব।
আরেকটি বিষয় আছে, হরমোনাল। এটির কারণেও দুজনের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কে নানা জটিলতা দেখা দেয়। সেখান থেকে অবিশ্বাসের জন্ম নিতে পারে, সংসারে তৈরি হতে পারে অশান্তি।
এটিকে মোকাবিলার বৈজ্ঞানিক উপায় নেই। তবে এ বিষয়ে আমরা পূর্ববর্তী প্রজন্মের দিকে তাকাতে পারি। কেননা সেখানে আমরা অনেক বয়সের ব্যবধানে বিয়ের সম্পর্ক দেখতে পাই।
যদিও তখন এককভাবে পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা হওয়ায় নারীরা অনেক কিছু মেনে নিতেন, কিন্তু তারপরও আমরা সেখানে অনুসরণযোগ্য কিছু উপাদান পাই। যেমন শ্রদ্ধাবোধ। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটি স্পষ্ট করতে হবে।
আবেগতাড়িত হয়ে দ্রুত সম্পর্কে যাওয়া যাবে না। সঙ্গীর পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে নিজের পছন্দ-অপছন্দ মিলিয়ে নিন। সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানবিক গুণাবলিকে প্রাধান্য দিন। যেমন কোনো প্রতিভা দেখে আকৃষ্ট হয়ে প্রেমে পড়া।
সেসব ক্ষেত্রে সম্পর্কে প্রজন্মগত দূরত্ব কমবে। তবে এ ক্ষেত্রে সেই প্রতিভার চর্চা বজায় রাখতে হবে, সম্পর্ক স্থায়ী হওয়ার পর চর্চা বন্ধ করা যাবে না।
‘বস সর্বদাই সঠিক’
কর্মক্ষেত্রে জেনারেশন গ্যাপের বিষয়টি অতি প্রকট হওয়ার সুযোগ নেই। কেননা সেখানে নির্দিষ্ট কাজের জন্য কর্মী বাছাই করে নেওয়া হয়। ওই কাজটার জন্য ভালো বলেই তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা থাকে।
কিন্তু তারপরও জেনারেশন গ্যাপের কিছুটা প্রভাব থেকেই যায়। অফিসে ‘বস সর্বদাই সঠিক’ বলে একটি বিষয় আছে। দেখা যায়, অফিসের বস হয়তো মধ্যবয়সী বা প্রবীণ, তাঁদের ধ্যান–ধারণা খানিকটা পুরোনো হবে। অনেকের প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা কম থাকে।
এসব ক্ষেত্রে কোনো তরুণ কর্মী নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে গেলে কেউ কেউ সেটি বাতিল করে দেন। ফলে সেই তরুণ কর্মী নিরুদ্যম হয়ে পড়ে। এটি আদতে সেই প্রতিষ্ঠানেরই ক্ষতি ডেকে আনে। কর্মক্ষেত্রে যাঁরা উর্ধ্বতন আছেন, তাঁদের এটি মাথায় রাখতে হবে যে, তরুণকর্মী তাঁর কাজের মাধ্যমেই ওপরে উঠতে চায়। ফলে সে নিশ্চয়ই এমন কোনো পরিকল্পনার কথাই বলছে, যা প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো।
আবার তরুণ কর্মীকেও মাথায় রাখতে হবে, ঊর্ধ্বতন তার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। হয়তো ধ্যানধারণা পুরোনো, কিন্তু দীর্ঘদিন কাজের ফলেই তিনি সেই অবস্থানে আছেন। তাঁদের কোনো পরিকল্পনা সময়োপযোগী মনে না হলে সেটি যথাযথ উপায়ে বলতে হবে।
সে ক্ষেত্রে বিনয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। সিদ্ধান্তটি কেন সময়োপযোগী নয়, সেটির যথেষ্ট ব্যাখ্যাসহ বিনয়ের সঙ্গে ঊর্ধ্বতনের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের বিষয়টিই প্রধান।
ডা. মো. জোবায়ের মিয়া, সহকারী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি), জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা