আপনি করলে আত্মসম্মানবোধ, অন্য কেউ করলে ইগো?
বর্তমানে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুটি বহুল আলোচিত শব্দ হলো অহমিকা (ইগো) আর আত্মসম্মানবোধ। বলা হয়ে থাকে, নিজেদের বেলায় যে আচরণকে আমরা আত্মসম্মানবোধ বলি, অন্য কেউ সেটা করলে আবার বলি ইগো। কিন্তু আসলেই কি ইগো আর আত্মসম্মানবোধ এক জিনিস? উত্তর হলো, না। বরং দুইটার ভেতরে খুব সূক্ষ্ম আর বড় কিছু পার্থক্য আছে, যেগুলো জানা আমার আপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আত্মসম্মানবোধ যেমন মানুষের কাছে আপনাকে করে সম্মানিত, অনুকরণীয় একজন মানুষ, অন্যদিকে ইগো আপনাকে ‘টক্সিক’ আর বিরক্তিকর একটা লোকে পরিণত করে। কাজেই দুটোকে আলাদা করতে পারা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে ‘ইগো’ বিসর্জন দিয়ে আপনি নিজের আত্মসম্মানবোধ বজায় রাখবেন? কীভাবে বুঝবেন, কোনটা ইগো আর কোনটা আত্মসম্মানবোধ?
নিজেকে ভালোবাসা
নিজেকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে আত্মসম্মানবোধ আর ইগো—দুটোই দুনিয়াতে কাজ করে। আপনি যদি আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন একজন মানুষ হন, তবে নিজেকে নিজের ভুলত্রুটিসহই ভালোবাসবেন। আপনি নিজেকে নিখুঁত ভাববেন না; বরং অন্যদের কাছে থেকে ক্রমাগত শেখার মাধ্যমে নিজেকে নিখুঁত করে তোলার চেষ্টা করবেন। অন্যদিকে এই ভালোবাসা ইগোতে রূপান্তরিত হলে নিজেকে আপনি সবার চেয়ে সেরা, নির্ভুল এবং নিখুঁত মানুষ বলে মনে করবেন। উন্নতি তো দূরের কথা, অন্য কারও পরামর্শ আপনি কানে তোলারও প্রয়োজন মনে করবেন না।
স্বার্থ চিন্তা করে কাজ করা
অন্যের জন্য কোনো কাজ করার সময় আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ কখনো স্বার্থের চিন্তা করেন না। কারও উপকার করলে কী ফেরত পাবেন, এর চেয়ে তাঁরা চিন্তা করেন, কীভাবে মানুষের আরও বেশি উপকার করার মাধ্যমে নিজেকে উন্নত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়। অন্যদিকে আত্ম–অহংকারীরা অন্যের উপকার করাকেও মোক্ষম একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। কাজেই কারও কোনো কাজ করে দেওয়ার আগে তাঁরা চিন্তা করেন, বিনিময়ে তাঁরা আসলে কী পাবেন। এটাকে কীভাবে নিজেকে সেরা প্রমাণ করতে বা কোনো স্বার্থসিদ্ধি করতে ভবিষ্যতে ব্যবহার করতে পারবেন। এ ছাড়া তাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরাই সেরা। বাকি সবাই তাঁদের সাহায্য করতে বাধ্য! যেন তাঁদের সাহায্য করাই অন্যদের জন্য একটা গৌরবের ব্যাপার।
অন্যের কথা শোনা
আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষমাত্রই খুব ভালো একজন শ্রোতা। যেহেতু তাঁরা নিজের মূল্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, ফলে বেশি কথা বলে নিজেদের গুরুত্ব বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন তাঁরা দেখেন না। কেউ কিছু বলতে চাইলে তাঁরা অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে তাঁদের কথা শোনেন। সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেন। অন্যদিকে আত্ম–অহংকারী মানুষমাত্রই মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতে পছন্দ করেন। তাঁরা শুনতে নয়; বরং বলতে পছন্দ করেন বেশি। বলতে না দেওয়া হলেই তাঁরা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। রেগে যান। চিৎকার–চেঁচামেচি করতে থাকেন।
সমালোচনা গ্রহণ করা
সমালোচনা গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও দুই শ্রেণির মানুষ দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখান। আত্ম–অহংকারী লোকমাত্রই সমালোচনা গ্রহণ করতে পারেন না। যেহেতু তাঁরা নিজেদের ‘ফলস পারফেকশন’-এর মোড়কে ঢেকে রাখেন, সেই সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন তুললে তাঁরা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। পাছে তাঁদের দুর্বলতা বের হয়ে মানুষের কাছে গুরুত্ব কমে যায়, এই ভয়ে সমালোচনাকে তাঁরা যমের চেয়েও বেশি ভয় পান। অন্যদিকে আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ সমালোচনাকে দেখেন আত্মোন্নয়নের একটা সুযোগ হিসেবে। যেহেতু তাঁরা নিজেদের নির্ভুল মনে করেন না, সেহেতু সমালোচনা শুনতেও তাঁদের খুব একটা সমস্যা থাকে না। বরং নিজেদের ভুল সংশোধনের সুযোগ পেয়ে তাঁরা সন্তুষ্ট হন।
অন্যকে ভালোবাসার ক্ষমতা
আত্ম–অহংকারী লোকজন অতি মাত্রার আত্মপ্রেমী (নার্সিসিস্ট) হয়ে থাকেন। তাঁরা শুধু নিজেদের ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে পারে না। সব মুগ্ধতা আর ভালোবাসা তাঁরা নিজের জন্য ব্যয় করেন। অন্যদের মূল্যায়ন না করতে পারলে ভালোবাসা আসবে কীভাবে? অন্যদিকে আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ নিজের মতোই অন্যদের ঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেন। মানুষ আর সম্পর্কের মূল্য বোঝেন। ফলে তাঁরা নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে অন্যকেও ভালোবাসেন, যত্ন নেন এবং সম্পর্ক ধরে রাখেন।
নীতিই শেষ কথা
যে মানুষটার আত্মসম্মানবোধ প্রবল, তিনি কখনো কোনো কিছুর বিনিময়ে নিজের নীতি বিসর্জন দেন না। অন্যদিকে যাঁর কাছে ‘ইগো’ বড়, তিনি নিজের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতেই ব্যস্ত থাকেন।
এভাবেই আত্মসম্মানবোধ ও আত্মমর্যাদাবোধ আপনার নিজের কাছে এবং মানুষের কাছে অত্যন্ত চমৎকার একজন মানুষ হিসেবে তুলে ধরেন। অন্যদিকে ইগো শুধু আপনার নিজের মানসিক শান্তিই নষ্ট করে না; বরং আপনার চারপাশের লোকজনকেও বিরক্ত করে দিন শেষে আপনাকে একা করে ফেলে।
সূত্র: এক্সপ্লোরিং ইয়োর মাইন্ড