আমি অবিবাহিত, আজ আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে

আজ আমার ছোট ভাইয়ের বিয়ে। ১২ হাজার মাইল দূরে বসে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমিও জুমের মাধ্যমে বিয়েতে অংশ নিচ্ছি। আমি ঢাকায়, আর আমার ভাই যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামায়। এই বিয়েতে সশরীর উপস্থিত থাকতে না পারায় আমার খানিকটা মন খারাপ।

বিয়ের আয়োজনপ্রতীকী ছবি: পেক্সেলস

পিঠেপিঠি ভাই আমরা। ছোটবেলা থেকেই পড়েছি একই ক্লাসে। ও একটু ছোটবেলায় ভর্তি হয়ে গেছে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা একই স্কুল-কলেজ থেকে দিয়েছি। স্কুল পেরিয়ে এসে ঢাকায় একই সঙ্গে থাকতাম। আমার বড়জন, ছোটজন আর আমি—তিন ভাই থেকেছি একই বাসায়।

বড় ভাই একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করে চলে গেলেন বিদেশে, পিএইচডি করতে। তখনো ছোটজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ভাইয়া চলে যাওয়ার পর দুই বছর আমরা একই বাসায় থেকেছি। এ সময়টা আমাদের মধ্যে বোঝাপড়াটা আরও বেড়েছে।

এরপর ছোট ভাইটাও চলে গেল বড় ভাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাস্টার্সে ভর্তি হলো। ওর বিদেশে চলে যাওয়ার দিনটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আজ যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে, বিদায় দেওয়ার জন্য তখন সেও এয়ারপোর্টে ছিল। এর পরের বছর সেও চলে গেল পিএইচডির জন্য, একই দেশে একই স্টেটে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ভিন্ন।

এদিকে দেশে আমি কিছুটা পারিবারিকভাবে দিশাহারা হয়ে থাকলাম। সব চলছে, চাকরি করছি, সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলছি, পরিবারের অন্য ভাই–বোনদের বাসায় যাচ্ছি, তবু কোথায় যেন একটু ছেদ পড়েছে। সারাদিন বাইরে থেকে বাসায় ফিরে যাদের সঙ্গে রাতে খেতে বসতাম, তারা বহু দূরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। দেখা হলেই লোকজন জিজ্ঞাসা করছেন, ‘তোমার ভাইয়েরা চলে গেল, তুমি কবে যাবে?’

উত্তর দিতে পারছি না। দেশে থেকে কিছু করার বিষয়টি যেন কারও চোখে পড়ছে না।
একসময় ছোট ভাইয়ের মাস্টার্স শেষ হলো। সে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে গেল আলাবামার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজ ওর যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে, সে পিএইচডিতে ভর্তি হয়েছে আলাবামার আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন আমার মনে হয়েছে, আচ্ছা ওরা কাছাকাছি আছে। ওদের একজন থেকে আরেকজনের দূরত্ব ঘণ্টাখানেকের ড্রাইভ।

এ বছরের শুরুতে আমার বড় ভাই-ভাবির ঘর আলো করে এসেছে এক ফুটফুটে কন্যা। মা দেশ থেকে ওদের দেখতে গেছেন। থাকছেন বড় ভাইয়ের পরিবারে।

আরও পড়ুন

ছোট ভাই ওদের থেকে তিন ঘণ্টার ড্রাইভ দূরত্বে থাকে। কাছাকাছি বলা যায়। যখন–তখন ওদের দেখা হয়। এদিকে দেশে আমি ওদের থেকে দূরে। ওদের রাত তো আমার দিন। ওরা জেগে থাকলে আমি ঘুমিয়ে থাকি। আমি ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে ওদের ঘুমানোর সময় হয়ে যায়।

এভাবে চলছে। কোনো অসুবিধা হয়নি। ফোনে আমাদের যোগাযোগ আছে। মাসখানেক আগে ছোট ভাই আমাকে বলল, ‘আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। কাউকে বলিনি, তোকে প্রথম বললাম।’
প্রথম প্রশ্নটা করেছি, ‘কাকে?’

পিঠাপিঠি হওয়ায় আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো। আমি জানি, ও কাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে, তবু জিজ্ঞাসা করলাম। এরপর মাসখানেক ছোটাছুটির মধ্যে চলে গেল। ওদের জন্য কেনাকাটা করা, হবু স্ত্রীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ, দেখা–সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা, এসব করে সময়টা পার হয়ে গেল।

আজ বিয়ে। গত পরশু রাতে মাকে ফোন করেছি। মায়ের ওখানে তখন প্রায় বিকেল। কথায় কথায় মজা করে মা বললেন, ‘ছোটর তো দুদিন বাদে বিয়ে। তুই এক কাজ কর, এখনই একটা বিয়ে করে ফেল। তাহলে ওর আগে বিয়েটা সেরে ফেলতে পারবি।’

আমি হাসলাম। মা-ও হাসলেন। বললাম, ‘এখন বিয়ে করব, মেয়ে পাব কোথায়? কে আমাকে বিয়ে করবে?’

আমার আগে ছোট ভাই বিয়ে করবে কি করবে না, এই চিন্তাটা আমার কখনো মাথায় আসেনি। তবে মাঝেমধ্যেই কিছু ফেসবুক পেজে এ রকম পোস্ট দেখি—‘এখন বিয়ের দাওয়াতে যেতে শরম লাগে, গিয়ে দেখি জামাই-বউ দুজনই আমার চেয়ে ছোট।’

এর মানে, যাঁরা বড়, তাঁদের আগে ছোটদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ছোটরা বিয়ে করছে, এ জন্য সামাজিকভাবে লজ্জা পাওয়ারটা বিষয়টা সবার কাছেই বুঝি বেশ মজার। হা হা রিঅ্যাক্টের বন্যা বয়ে যায় এসব পোস্টে।

প্রশ্নটার আসলে কোনো ভিত্তি নেই। কারণ, আমার ছোট ভাইয়ের জীবনে বহু সাফল্য এসেছে, বহু জায়গায় ও আমার থেকে এগিয়ে থেকেছে। আমাদের মধ্যে কখনো প্রতিযোগিতা ছিল না। সহোদর শব্দের অর্থের মধ্যে কোথাও প্রতিযোগী নেই। আমরা সহযোগী। এমনকি আমার প্রথম বইটা আমি ওর সঙ্গে লিখেছি। আমরা সহ–লেখক। জীবনে টিকে থাকার জন্য সারা জীবন ওর থেকে সাহায্য পেয়েছি। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, আমার টিউশন না থাকলে ও টিউশন করে আমাদের খরচ চালিয়েছে।

আরও পড়ুন

ও যখন যুক্তরাষ্ট্রে মাস্টার্সের জন্য গেছে, আমি তখন একটা চাকরি ছেড়েছি, আরেক চাকরিতে ঢুকিনি। তখন ভাবছি, মাস্টার্স করব কি না। ও যখন পিএচডি শুরু করল, আমি তখন মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি, চাকরি করছি।  

জীবনের বহু ক্ষেত্রে ও আমার থেকে সব সময়ই এগিয়ে। বহু সাফল্য ওর আগে এসেছে বা শুধু ওর এসেছে। আমার আগে ওর বিয়ে হচ্ছে, এর কারণ ওর ব্যাটে-বলে মিলেছে, আমার মেলেনি। প্রাপ্তবয়স্ক হলে এই প্রশ্নই থাকা উচিত নয়—কে কখন বিয়ে করবে? যার সব মিলে যাবে, সে বিয়ে করবে।

পরিবারে কেউ বয়সে ছোট না বড়, সেটা আদতে দেখার কিছু নেই। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এই প্রশ্নের মুখে বেশি পড়েন। মেয়েদের জীবনে, বিশেষ করে মায়েদের কথাটা বেশি শুনতে হয়। বিয়ে খেতে এসে কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, ‘ভাবি, আপনার বড় মেয়ের বিয়ে হয়নি। ছোটজনকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন? ওর যদি পরে বিয়ে না হয়?’

মা হয়তো বাধ্য হয়ে বলেন, ‘আমার বড় মেয়ে এখন ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করছে। ছোট মেয়েটার একটা ভালো পাত্র পাওয়া গেল…।’

বড় বোনের আগে ছোট বোনের বিয়ে হলে সামাজিক চাপে পড়েন মা–বাবা। ছেলেদের বেলায় চাপটা হয়তো কম। ছোট মেয়ের যদি বড় মেয়ের আগে বিয়ের প্রস্তাব আসে, বহু মা–বাবা সেটা ফিরিয়ে দেন। সন্তানের মতামত জানতে চান না। মা–বাবারা বলেন, ‘আমার বড় মেয়ের এখনো বিয়ে হয়নি, আগে বড় মেয়ের বিয়ে হবে, এরপর আমার ছোট মেয়েকে বিয়ে দেব।’
ছেলেদের ক্ষেত্রে বিষয়টা এত শক্ত না হলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে ট্যাবুটা সমাজে বেশ শক্তপোক্ত হয়ে আছে।

ছোটজনের কেন আগে বিয়ে, এমন প্রশ্ন করা আদতে অন্যায় বলেই মনে করি। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে যার যখন সুবিধা হবে, সে তখন বিয়ে করবে। বিয়ের ক্ষেত্রে বর আর কনেই আসল। বড় ভাই বা ছোট বোন অবিবাহিত কি না, তা একদমই বিবেচ্য নয়। আমার ছোট ভাই আমার আগে বিয়ে করেছে, এতে আমার কোনো অসুবিধাই মনে হয়নি। বিয়ে করছে, খুব ভালো করেছে। আমাদের জন্য আনন্দের বিষয়।

ছোট ভাই যদি আগে বিয়েতে প্রস্তুত হতে পারে, তাহলে নিশ্চয়ই ওর বিয়ে আগে করা উচিত। ও সেটাই করছে। ওদের জন্য অনেক ভালোবাসা ও অভিনন্দন। ওদের দাম্পত্য জীবন সুখী হোক।

আরও পড়ুন