সাত পাকে বাঁধা
প্রিয় কোনো বন্ধুর বিয়েতে দাওয়াত খেতে গিয়েই হোক, কিংবা সিনেমার পর্দায় দেখেই হোক—বাঙালি সনাতনী বিয়ের সঙ্গে কিছুটা হলেও পরিচয় কমবেশি সবারই আছে। গায়েহলুদ, বিয়ে কিংবা বউভাতের মতো উৎসবমুখর অনুষ্ঠানগুলো তো সবাই চেনেন। তবে হিন্দু বিয়ের আর সব রীতিনীতি জানলে মনে হবে, এ যেন শেষ হতে না চাওয়া দীর্ঘ এক অনুষ্ঠানমালা! এত এত নিয়মের মধ্য দিয়ে শুধু বর-কনেকেই যেতে হয় না, এ মহাযজ্ঞে অংশ নেয় দুজনের পুরো পরিবার।
ছেলে বা মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় সাবেকি ধাঁচের বিয়ে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ঘটক। প্রথা অনুসারে প্রথমে কন্যাকে দেখতে আসে পাত্রপক্ষ। পাত্রী পছন্দ হলে মেয়ের বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা গিয়ে ছেলেকে দেখে আসেন। পাড়া–প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ছেলে সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার কাজটাও সেরে নেন কেউ কেউ।
পাত্র পছন্দ হলে সেদিনই ধান-দূর্বা দিয়ে ছেলেকে আশীর্বাদ করে আসেন কনেপক্ষ। এরপর একইভাবে ছেলেপক্ষের বড়রা এসে মেয়েকে আশীর্বাদ করে যান। কেউ আবার হবু বর বা কনেকে দেখার পর আশীর্বাদস্বরূপ টাকা বা সোনার অলংকার দিয়ে থাকেন। দুই পক্ষের পছন্দ এবং কথা দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় বিয়ের প্রস্তুতি।
আজকের যুগে বেশির ভাগ যুগলই অবশ্য নিজের পছন্দে জীবনসঙ্গী খুঁজে নেন। তা সত্ত্বেও কোথাও কোথাও এখনো মানতে হয় ঘটকের আলাপ নিয়ে আসার রীতি। প্রথমে ছেলের পরিবারের কাউকে মেয়ের বাড়িতে যেতে হয় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। এরপর শুরু হয় পাঁজি দেখে বিয়ের তারিখ পাকা করার পালা।
হিন্দু বিয়েতে তারিখটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্জিকায় বর্ণিত নির্দিষ্ট দিনেই সাধারণত হিন্দু বিয়ে হয়ে থাকে। বিয়ের সময়ও নির্দিষ্ট করা থাকে। একে বলে ‘লগ্ন’। এই লগ্নে শুরু হয় বিয়ের অনুষ্ঠান, শেষও করতে হয় নির্ধারিত সময়ের ভেতর।
লগ্নপত্রের পরই শুরু হয় বিয়ের আচার। তখন গঙ্গা ও অগ্নিদেবতাকে পান-মিষ্টি দিয়ে বিয়েতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ব্রত বা পূজা করে হবু বর ও কনের মঙ্গল কামনা করা হয়।
গায়েহলুদের অনুষ্ঠান থেকে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হলেও বর্তমানে রং খেলা, মেহেদি সন্ধ্যা ইত্যাদি অনুষ্ঠানও যোগ হয়েছে। সাধারণত বিয়ের আগের দিন গায়েহলুদের আয়োজন হয়ে থাকে। এ অনুষ্ঠানে বর ও কনের গায়ে হলুদ মাখানো হয়। গ্রামাঞ্চলে বিয়ের গীত আর বাজনার সঙ্গে এদিন রাতভর চলে নাচ। তবে শহুরে অনুষ্ঠানে জাঁকজমকই মুখ্য। মঞ্চ, আলোকসজ্জা, নানা রকম সাজ, ডিজে পার্টি, গান, নাচসহ থাকে বিভিন্ন আনন্দ–আয়োজন।
গায়েহলুদের পর সেই কাঙ্ক্ষিত বিয়ের দিন। শুভকাজ সারতে এদিন কনের বাড়িতে যায় বরপক্ষ। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে মায়ের কাছ থেকে আশীর্বাদ নেন হবু বর। অবশ্য এখনকার বিয়ে মানেই কমিউনিটি সেন্টার বা ‘ডেসটিনেশন ওয়েডিং’। সেখানে বর পৌঁছানোমাত্রই তাঁকে ঘিরে চলতে থাকে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা।
কনের বাড়িতে ঢোকার মুখেই তাঁকে ঘিরে ধরে শ্যালক-শ্যালিকা, বৌদিরা। বরপক্ষের কাছে ‘গেট ধরা’র মাধ্যমে চলতে থাকে নানা আবদার। কখনো বেশ বড় অঙ্কের টাকা বিনিময়ের পর বিয়ের আসরে ঢোকার অনুমতি পায় বর ও তাঁর সঙ্গীরা। দীপ জ্বেলে ধান-দূর্বাসহ নানা রকম দ্রব্যে হবু জামাতাকে বরণ করে নেন কনের মা।
হিন্দু বিয়ের প্রথম আচার লগ্নপত্র বা মঙ্গলাচরণ। অঞ্চলভেদে এ অনুষ্ঠানকে পাটিপত্র বা সোনা-বস্ত্র দানও বলা হয়। এ অনুষ্ঠানে বরের বাসা থেকে কনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাঠানো হয়। যে বাক্স বা স্যুটকেসে করে এসব জিনিস যায়, তাকে বলে ‘বিয়ের ঝাঁপি’। এতে থাকে শাঁখা-সিঁদুর, অলংকার, শাড়ি, প্রসাধনসামগ্রীসহ কনেসাজের নানা উপাদান। মূলত বউভাতের অনুষ্ঠানে কনে যা পরবে, ঝাঁপিতে তা–ই দেওয়া হয়।
এদিন সাধারণত মিষ্টি নিয়ে আসে বরপক্ষ। এ অনুষ্ঠানেই বিয়ের দিন-ক্ষণ সর্বসমক্ষে ঘোষণা করা হয়। বিয়ের পুরোহিত পঞ্জিকার পৃষ্ঠায় বিবাহের তারিখে সিঁদুরের শুভ সূচক চিহ্ন দেন। আশীর্বাদ হিসেবে পঞ্জিকার পাতার ভাঁজে ধান-দূর্বা রাখা হয়। আগত স্বজনেরা বরপক্ষের পাঠানো তত্ত্ব দেখে কনেকে আশীর্বাদ করে যান। এ সময় উভয় পক্ষ একে অপরকে বিয়ের নিমন্ত্রণ করে থাকেন। তখন কনেপক্ষের স্বজন ও পাড়া–প্রতিবেশীর ভেতর মিষ্টি বিতরণ করা হয়। বরপক্ষের লোকেরা বাড়িতে যাওয়ার পর পাড়া–প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের মধ্যে মিষ্টি বিলি করেন। তবে অঞ্চলভেদে এ আচারে ভিন্নতা দেখা যায়।
অতীতে লগ্নপত্রের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যৌতুক হিসেবে পাত্রপক্ষের দেনাপাওনা স্থির করা হতো। এরপর বর-কনেকে কী কী দেওয়া হবে, উপস্থিত সবাইকে ঘোষণা দিয়ে জানানো হতো।
হিন্দু মেয়েরা পিতার সম্পদের ভাগ পান না। সে কারণে তাঁদের বিয়েতে মেয়ের বাড়ি থেকে নগদ অর্থ, অলংকার, আসবাব ইত্যাদি পণ বা যৌতুক হিসেবে দেওয়া হতো। এখনো কোনো কোনো জায়গায় এ চল রয়েছে।সনাতন শাস্ত্র অনুসারে
এবার সাত পাকে বাঁধা পড়ার পালা। বিয়ের বেদি বা ছাঁদনাতলায় যাওয়ার আগে বরকে কনের বাড়ি থেকে দেওয়া পোশাক পরানো হয়। চিরায়ত ধুতি-পাঞ্জাবিতে সেজে ছাঁদনাতলায় বসেন বর।
অন্যদিকে লাল বেনারসি শাড়িতে সেজে আসরে আসেন কনে। বরকে মাঝখানে রেখে সাতবার ঘোরেন কনে। কোথাও কোথাও পিঁড়িতে বসিয়ে পানপাতায় মুখ ঢাকা কনেকে বরের চারপাশে ঘোরানো হয়। সাত পাকে বাঁধা পড়েন বর ও কনে । শাস্ত্রমতে এই সাত পাকের মাধ্যমে বর-কনে একে অপরের প্রতি, পরস্পরের পরিবারের প্রতি এবং ভবিষ্যৎ সন্তানের প্রতি দায়িত্ববান থাকার প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হন। সাত পাকের পর মালাবদল। মঙ্গলপ্রদীপের আলোয় বিনিময় হয় ‘শুভদৃষ্টি’, নতুন পরিচয়ে দুজন দুজনকে দেখেন নতুন করে।
সাত পাকের পর কন্যাদান ও যজ্ঞ। হিন্দুধর্মানুসারে প্রত্যেক ব্যক্তির রয়েছে একটি বংশধারা বা গোত্র। কন্যাদানের মাধ্যমে মেয়ের সঙ্গে তাঁর পিতৃবংশের ধারা ছিন্ন হয়। অগ্নিসাক্ষী রেখে বাবা মেয়েকে বরের হাতে তুলে দিলে গোত্রান্তরিত হন মেয়ে। এর পর থেকে স্বামীর গোত্রই তাঁর গোত্র। কন্যাদানের পর সেই অগ্নিকুণ্ডের পাশেই বিবাহের মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় বিবাহ। এ সময় বর ও কনে উভয়ই উচ্চারণ করেন,
’যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।’বিয়ের শাশ্বত আর চিরায়ত সেই মন্ত্র
সংস্কৃত এই মন্ত্রের অর্থ—আমার হৃদয় তোমার হোক, তোমার হৃদয় আমার।
আগুনকে সাক্ষী রেখে বিবাহের আচার শেষ হওয়ার পর কনের সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দেন বর। পরে পুকুর পাড়ি দেওয়া, পাশা খেলা ইত্যাদি নানা কৌতুকপূর্ণ খেলা হয় বর–কনেকে নিয়ে। এরপর বিশাল সাজানো থালায় বর-কনেকে খাবার পরিবেশন করা হয়।
পরদিন হয় বাসি বিয়ের অনুষ্ঠান। অঞ্চলভেদে এ অনুষ্ঠানের ভিন্নতা রয়েছে। এদিন সকালে বর-কনেকে একসঙ্গে বসিয়ে হলুদ মেখে স্নান করানো হয়। কোথাও আবার বর-বধূ একসঙ্গে সাত বা চৌদ্দ পাক ঘোরেন। এরপর আসে কনে বিদায়ের মুহূর্ত।
আত্মীয়স্বজনেরা বর-কনেকে আশীর্বাদ করেন। মেয়ে পেছন ফিরে মায়ের আঁচলে চাল দিয়ে বাবার ঘর থেকে বিদায় নেন। এই আচারকে বলে ‘কনকাঞ্জলি’। বলা হয়ে থাকে এ আচারের মাধ্যমে মা–বাবার ঋণ শোধ করে শ্বশুরবাড়িতে যান মেয়ে। তবে এর অন্য একটি ব্যাখ্যাও রয়েছে। হিন্দুধর্মে ঘরের মেয়েকে দেবী লক্ষ্মী রূপে দেখা হয়। লক্ষ্মী ধন-সম্পদ ও শস্যের দেবী। মেয়ে বিদায় দেওয়া মানে ঘরের লক্ষ্মী চলে যাওয়া। তাই যাওয়ার সময় চাল ছিটিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে পরিবারের লক্ষ্মী বাড়িতেই আছে, এটা নিশ্চিত করা হয়। শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছানোর পর নানা আয়োজনের মাধ্যমে ঘরের বউকে বরণ করে নেওয়া হয়। আলতা মেশানো দুধে পা ভিজিয়ে স্বামীগৃহে পদার্পন করেন নতুন বউ। এ যেন প্রতীকী অর্থে দেবী লক্ষ্মীকে বরণ করে নেওয়া।
শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পর প্রথম রাতে স্বামী-স্ত্রী আলাদা ঘুমান। সাধারণত বর সেদিন অন্য কারও বাড়িতে গিয়ে থাকেন। এ রাতে বর-কনে একজন আরেকজনের মুখ দেখেন না। একে বলে ‘কালরাত’। এই কালরাত নিয়েও গল্প আছে।
বলা হয়, কালরাতে বেহুলা ও লখিন্দর একসঙ্গে ছিল। সে রাতেই বিষধর সাপের কামড়ে লখিন্দর মারা যায়। যদিও পরে মনসাকে তুষ্ট করে স্বামীর প্রাণ ফিরে পেয়েছিল বেহুলা। তবু স্ত্রী প্রথম রাতে স্বামীর সঙ্গে থাকলে বা তাঁর মুখ দেখলে স্বামীর অমঙ্গল হবে—এই আশঙ্কা থেকেই এমন আচার মানা হয়।
পরদিন ভাত-কাপড় ও বউভাত। কোনো কোনো অঞ্চলে এদিন সকালে সূর্যপ্রণাম করে একে অন্যের হাত ধরে সাত পাক ঘোরেন বর–বউ। বউভাতের অনুষ্ঠানে মূলত নববধূর মাছ কাটা, রান্নায় সাহায্য করা, স্বামীর পরিবারের সদস্যদের পরিবেশন করে খাওয়ানোর রীতি রয়েছে। আর ‘ভাত-কাপড় দেওয়া’র আচারে স্ত্রীর হাতে সাজানো ভাতের থালা, নতুন কাপড় ইত্যাদি তুলে দেন স্বামী। এর মাধ্যমে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে স্ত্রীর আজীবন ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বউভাতে বরপক্ষের আত্মীয়স্বজন ও কনের বাড়ির স্বজনদের নিমন্ত্রণ করা হয়। তাঁদের আপ্যায়ন করার মাধ্যমে নতুন জীবনে সবার আশীর্বাদ কামনা করেন বর-বধূ।
বর ও বধূর বন্ধুবান্ধবেরা এদিন নতুন ফুল দিয়ে সুন্দর করে বাসরঘর সাজান। বিয়ের পর সেদিনই প্রথম একসঙ্গে থাকেন স্বামী-স্ত্রী।
বউভাতের সাত দিনের মধ্যে স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়িতে যান মেয়ে। বরের ভাই, বোন বা বন্ধুস্থানীয় কয়েকজন তাঁদের সঙ্গে যান। এই পর্বকে বলে দ্বিরাগমন বা অষ্টমঙ্গলা। এ সময় জামাই বাজার করে শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে খাওয়ান। মূলত নতুন পরিবারের সঙ্গে হৃদ্যতা বাড়াতেই এ ধরনের আচার পালন করা হয়। আর এভাবেই শেষ হয় হিন্দু বিয়ের আয়োজন।