বেশি কাছের মানুষকে সরি বলতে দ্বিধা হয় কেন
তমা ও রাজ ভালোবেসে বিয়ে করেছে। একদিন ঝগড়ার সময় নিজের অজান্তেই এমন কিছু কথা বলে ফেলে তমা, যা শুনে খুব কষ্ট পায় রাজ। তমা বুঝতে পারে, রাগের মাথায় এসব কথা বলা তার ঠিক হয়নি। ভেতরে ভেতরে সে দুঃখিত ও অনুতপ্ত হতে থাকে; কিন্তু ক্ষমা চাইতে কোথায় যেন একটি দ্বিধা ও অস্বস্তি কাজ করে।
তমার মনে হতে থাকে, আগে নিজের ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করলে রাজের দিক থেকে যে ভুলটুকু ছিল, তা হয়তো বৈধতা পেয়ে যাবে; রাজের আচরণে সে–ও যে কষ্টটা পেয়েছে, তা চাপা পড়ে যাবে। তা ছাড়া সব মুখে বলতে হবে কেন, রাজ বুঝে নিলেই তো পারে। এদিকে রাজও একরাশ অভিমান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, তমাই আগে কথা বলে মিটমাট করুক। দুজনই কষ্ট পেতে থাকে অথচ কেউ–ই নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না।
শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই না, যেকোনো আপনজনের মধ্যেই এমনটা হতে পারে। এর পেছনের কারণ জানতে হলে আমাদের বুঝতে হবে, যে মানুষগুলোকে আমরা ভালোবাসি তার ভিত্তি কী।
শৈশবের বন্ধন
কাছের মানুষকে কেন আমরা ভালোবাসি, কেন কাছে পেতে চাই, কেনই–বা তাঁদের প্রতি আবেগীয়ভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ি; তার একটা ব্যাখ্যা ব্রিটিশ মনোরোগ–বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিশ্লেষক জন বলবির অ্যাটাচমেন্ট থিওরিতে পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, ‘মানবশিশুর শৈশব পৃথিবীর আর সব প্রাণীর চেয়ে দীর্ঘতম। জন্মের পর থেকেই আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুরক্ষিত থাকার জন্য অন্যের যত্ন ও ভালোবাসার ওপর নির্ভরশীল থাকি। মা বা অন্য কেউ যখন শিশুর প্রয়োজনগুলোকে বুঝে সাড়া দেন; যত্ন, নিরাপত্তা ও ভালোবাসা দেন, তখন শিশুর সঙ্গে অভিভাবকের একধরনের অ্যাটাচমেন্ট তৈরি হয়, যাকে বলা হয় নিরাপদ বন্ধন। অবশ্য অভিভাবক শিশুকে অতি সুরক্ষা দিতে চাইলে, অবহেলা বা নিপীড়ন করলে শিশু-অভিভাবকের মধ্যকার বন্ধনটি আর নিরাপদ থাকে না।’
তবে শিশুর সঙ্গে অভিভাবকের বন্ধন নিরাপদ বা অনিরাপদ যা–ই হোক না কেন, বন্ধনের চাহিদা তার মধ্যে রয়েই যায়। অ্যাটাচমেন্ট থিওরি অনুযায়ী, মানুষ কেবল শৈশবেই নয়, সারা জীবন ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রয়োজন বোধ করে।
রোমান্টিক সম্পর্ক বা বন্ধুত্বেও আমরা অবচেতনভাবে শৈশবের সেই সুখকর অনুভূতিগুলোকেই খুঁজি। কাছের মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্কে অক্সিটোসিন ও ডোপামিনের মতো হরমোন নিঃসৃত হয়, যা নিরাপত্তা ও ভালোবাসার অনুভূতি বাড়ায়।
এই জৈবিক প্রক্রিয়াগুলো অ্যাটাচমেন্ট বা বন্ধনকে শক্তিশালী করে। ফলে একদিকে আমরা কাছের মানুষের সঙ্গ পছন্দ করি, আরেক দিকে হারানোর ভয়ও কাজ করতে থাকে।
আর তাই কাছের মানুষের যেকোনো আচরণের প্রতিই আমরা সংবেদনশীল থাকি। ফলে কোনো আচরণে কষ্ট পেলে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলি; যা হয়তো বাইরের অন্য কোনো মানুষের সঙ্গে করি না।
আবার নিজে কষ্ট দিয়ে ফেললেও সহজে ক্ষমা চাইতে পারি না। কখনো কখনো তথাকথিত আত্মসম্মানবোধ আমাদের বাধা দেয়। আবার কখনো কখনো আপন ভেবেই আপনজনের কষ্টটাকে গুরুত্ব দিতে চাই না; কিন্তু কাছের বা দূরের যেই–ই হোক না কেন, প্রয়োজনের সময় অনুভূতি প্রকাশ করতে না পারা আমাদের যোগাযোগ দক্ষতার ঘাটতি ও মানসিক অপরিপক্বতার লক্ষণ। আমাদের শৈশবের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাদীক্ষায় লুকিয়ে আছে যার শিকড়।
প্রয়োজনে আবেগ–অনুভূতি প্রকাশ করতে পারা, নিজে ভুল করলে ক্ষমা চাওয়া, অন্যে ভুল করলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান আমাদের আত্মসম্মান কমায় না; বরং মানসিক পরিপক্বতাই প্রকাশ করে।
এতে করে আমাদের সম্পর্কগুলোও সুস্থ ও সুন্দর থাকে। আর নিজের যে কোনো অনুভুতি প্রকাশের এই শিক্ষা শিশুকে ছোটবেলা থেকেই চর্চা করাতে হবে। তাহলে অনুতাপ বা ভালোবাসা প্রকাশে বড় বেলাতেও অকপট থাকা যায়।
রাউফুন নাহার, সহকারী অধ্যাপক ও কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট, এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়