আলফা প্রজন্ম কি সম্পর্কের ব্যাপারে উদাসীন

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বদলে যায় বহু কিছু। পারিপার্শ্বিকতার এক বিরাট অবদান থাকে সেসব পরিবর্তনে। আলফা প্রজন্ম, অর্থাৎ যাঁদের জন্ম ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের ভেতরে, তাঁদের বয়স এখনো নিতান্তই কম। পরিণত বয়সে পৌঁছে তারা ঠিক কেমন মানুষ হয়ে উঠবে, সে প্রশ্নের উত্তর তো সময়ই দেবে। তবে এই বয়সের স্বাভাবিক সম্পর্কগুলোতে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন জাগছে কারও কারও মনে। আলফা প্রজন্ম কি একটু বেশিই আত্মকেন্দ্রিক? সম্পর্কের ব্যাপারে তারা কি একটু উদাসীন?

আলফা প্রজন্ম কি একটু বেশিই আত্মকেন্দ্রিক?
ছবি: প্রথম অলো

আলফা প্রজন্ম এই পৃথিবীকে ভালোভাবে বুঝে ওঠার আগেই পৃথিবী করোনা অতিমারিতে বিপর্যস্ত হয়েছে। সেই সময়ের ছোট্ট শিশুরা স্কুলের আনন্দটা ভালোভাবে উপভোগ করার আগেই অনলাইন ক্লাসের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। পরিবারে তাদের ভাইবোনের সংখ্যাও কম। আগের অনেক প্রজন্ম তাদের শৈশবে যে ধরনের পারিবারিক পরিবেশ পেয়েছে, আলফা প্রজন্ম ঠিক তেমনটা পায় না। এমন বহুবিধ ভিন্নতার কারণেই তাদের অনেক আচরণ আগের দিনের শিশুদের মতো নয়। আলফা প্রজন্ম সম্পর্কে এমনটাই বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী ও পিএইচডি গবেষক হাজেরা খাতুন।

আরও পড়ুন

পারিবারিক ধারায় বদল

আগের অনেক প্রজন্ম তাদের শৈশবে যে ধরনের পারিবারিক পরিবেশ পেয়েছে, আলফা প্রজন্ম ঠিক তেমনটা পায়নি
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

একটা সময় ছিল, যখন কাছাকাছি বয়সের ভাইবোন কিংবা পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের সঙ্গে খোলামেলাভাবে কথা বলতে পারত শিশুরা। প্রতিবেশী শিশুদের সঙ্গে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় কাটানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু আলফা প্রজন্মের এমন সুযোগ কম, বিশেষত শহুরে জীবনে। মনের কথা যদি বাড়িতে কাউকে বলতে হয়, তাহলে সরাসরি মা-বাবাকে বলা ছাড়া গতি নেই। এমনকি তা যদি কারও প্রতি অসম্মানসূচক শব্দও হয়, তারা সেটিই বলে ফেলে মা-বাবার সামনে। এই সোজাসাপটা কথার ধরনটাই তাদের জন্য স্বাভাবিক। অবশ্য একটা প্রজন্মের প্রত্যেকেই একেবারে একই ছাঁচে গড়া নয়। ব্যক্তিত্বের ভিন্নতা তো থাকবেই। তাই আলফা প্রজন্মের সবাই যে একেবারে একই রকম আচরণ করে, ব্যাপারটা তেমনও নয়।

আরও পড়ুন

প্রযুক্তির ভালোমন্দ

আলফা প্রজন্ম প্রযুক্তির প্রতি বেশ নির্ভরশীল
ছবি: খালেদ সরকার

অতিমারির দিন পেরিয়ে এসেও আলফা প্রজন্ম প্রযুক্তির প্রতি বেশ নির্ভরশীল। তাদের শিক্ষা ও বিনোদন অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর। প্রযুক্তির কল্যাণে তারা অনেক কিছু জানতেও পারছে অবাধে। বহু সংবেদনশীল বিষয় তারা খুব সহজভাবে গ্রহণ করে। এসব বিষয় নিয়ে সহজভাবে আলাপ করে। মনের অনুভূতি প্রকাশ করে ফেলে অবলীলায়। অবশ্য অনেকে তাদের এই সহজাত প্রকাশটা ‘বেয়াদবি’ ভেবে বসতে পারেন। আবার প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে ওঠা শিশু কম কথা বলছে, এমনটাও দেখা যায়। ডিজিটাল ডিভাইসে ভিডিও গেমিং হোক কিংবা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ‘গেমিং’—সবটাতেই কিন্তু দ্রুত সাফল্য, সন্তুষ্টি বা জয়ের একটা অনুভূতি পাওয়া যায়। এ ধরনের প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত অনেকেরই তাই সহিষ্ণুতা কম হতে পারে। পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এসব বিষয় কিছুটা নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আলফা প্রজন্ম আবার সরাসরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সাবলীল।

আরও পড়ুন

শেষ কথা

তাহলে কি আলফা প্রজন্ম সম্পর্কের ব্যাপারে উদাসীন? একদমই নয়। পারিবারিক সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব তাদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন আলফা প্রজন্মের সদস্য সানায়া ফারজানা তার অসুস্থ মায়ের কী খাওয়া উচিত আর কী খাওয়া বারণ, সেই তালিকা মনে রেখেছে ঠিকঠাক। গেল জুলাই-আগস্টে মা-বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শামিল হওয়া আলফা প্রজন্মের এক শিশুকে নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে হাজেরা খাতুনের। কেবল ‘আমিও তো ছাত্র’ এই বোধই শিশুটিকে আন্দোলন পর্যন্ত নিয়ে গেছে সে সময়! শিশুটির বন্ধুরাও একইভাবে অনুভব করেছে আন্দোলনের দিনগুলোকে। ২০২৪ সালের বন্যাদুর্গত মানুষের জন্যও নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছে আলফা প্রজন্মের সদস্যরা।

বন্ধুত্ব তাদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ
মডেল: রুকাইয়া রহমান ও পদ্মহেম পাবন, ছবি: কবির হোসেন

সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন আসাই প্রকৃতির নিয়ম। তবে সব পরিবর্তন পেরিয়েও টিকে থাকে মানবিক অনুভূতি। সম্পর্কগুলোও টিকে থাকে ভালোবাসা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। আগামী দিন যাদের হাতে, সেই আলফা প্রজন্মও তাদের মতো করেই টিকিয়ে রেখেছে সেই ভিত্তিকে।

আরও পড়ুন