দীর্ঘস্থায়ী দাম্পত্য জীবনের মূলমন্ত্র কী? জানালেন ৮৪ বছর ধরে একসঙ্গে থাকা এই দম্পতি

বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী দাম্পত্য জীবন কাটানো দম্পতি হিসেবে ভূষিত হয়েছেন এলেনর গিটেনস ও লাইল গিটেনসছবি: গার্ডিয়ান

গাঁটছড়া বাঁধতে না বাঁধতেই ছিঁড়ে যায় সম্পর্কের সুতা। তুমুল প্রেম, বিশ্বাস আর স্বপ্ন নিয়ে শুরু করা সংসার মাস বা বছর না ঘুরতেই ভেঙে যায়। এত সব ভাঙন ও বিচ্ছেদের গল্পের বিপরীতে আমৃত্যু বেঁচে থাকে অনেক সম্পর্ক। একসঙ্গে বুড়ো হয় কত কত দম্পতি। আসলে দীর্ঘ দাম্পত্যের মূল সূত্রটা কী? কোনো গোপন সূত্র বা অদৃশ্য রহস্য কি আছে? আছে বৈকি। সেই সূত্র বা রহস্যের সন্ধান গড়পড়তা দম্পতিরা দিতে পারবেন নিশ্চয়ই। তবে সবচেয়ে সেরা ও যথার্থ উত্তরটা বোধ হয় দিতে পারবেন বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী দাম্পত্য জীবন কাটানো দম্পতি হিসেবে ভূষিত হওয়া এলেনর গিটেনস ও লাইল গিটেনস।
এলেনর গিটেনসের বয়স এখন ১০৭ বছর এবং তাঁর স্বামী লাইল গিটেনসের বয়স ১০৮ বছর। যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামি অঙ্গরাজ্যের এই জুটি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন ১৯৪২ সালের ৪ জুন। অর্থাৎ ৮৩ বছর পেরিয়ে ৮৪ বছর চলছে তাঁদের দাম্পত্য জীবন। বিশ্বযুদ্ধ, অবস্থানগত দূরত্ব আর সময়ের কঠিন পরীক্ষা পেরিয়ে আজও তাঁরা একসঙ্গে আছেন।

যেদিন দেখা হয়েছিল

একদিন ক্লার্ক আটলান্টা ইউনিভার্সিটিতে বাস্কেটবল খেলা দেখতে গিয়েছিলেন এলেনর। সময়টা ১৯৪১ সালের কোনো এক সন্ধ্যা পেরোনো ক্ষণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলতে নেমেছিলেন লাইল। সেই রাতে খেলায় কে জিতেছিল, এলেনর তা বেমালুম ভুলে গেছেন। কিন্তু ভুলতে পারেননি তরুণ অ্যাথলেট লাইলের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সেই মুহূর্ত।

বিয়ের আয়োজনে এলেনর গিটেনস ও লাইল গিটেনস
ছবি: ফক্স নিউজ

অতঃপর প্রেম, প্রশিক্ষণ ও বিয়ে

খেলার মাঠে দেখা সেই মুখ কেমন এক অদ্ভুত মুগ্ধতায় গেঁথে গিয়েছিল এলেনরের বুকে। ধীরে ধীরে পরিচয়, বাড়তে থাকে যোগাযোগ। যথানিয়মে প্রেমে গড়ায় সম্পর্ক। এরই মধ্যে বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের ডাক আসে। সেনাবাহিনীতে যোগ দেন লাইল। জর্জিয়ার সেনাঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। অস্ত্রচালনা কিংবা নিখুঁত নিশানা নির্ণয়ের মৌলিক দক্ষতা অর্জনের উদয়াস্ত প্রশিক্ষণ চলে। কিন্তু যতটা অস্ত্রের ডগায়, তার চেয়ে বেশি এলেনরের কাছে মন পড়ে থাকে লাইলের। না, এভাবে হবে না। প্রশিক্ষণ থেকে তিন দিনের সংক্ষিপ্ত ছুটি নিয়ে লাইল আসেন এলেনরের কাছে। হাতে সময় কম। কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। কোনো রকমে বিয়েটা সেরেই ফিরতে হবে ঘাঁটিতে। দিনটা ৪ জুন, ১৯৪২ সাল। লাইল ও এলেনর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

যুদ্ধের দিনগুলো

বিয়ের পরপরই যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনীর ৯২তম পদাতিক ডিভিশনের সঙ্গে লাইলকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইতালি। বিশ্বব্যাপী সে এক মাতাল সময়। এলেনর তখন প্রতিমুহূর্ত কাটাচ্ছেন তুমুল উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা আর অসহায়ত্বে। ইতিমধ্যে তিনি সন্তানসম্ভবা। এ সময় চলে যান নিউইয়র্ক সিটিতে। এখানেই প্রথমবারের মতো লাইলের পরিবারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সেখানে একটি উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ নেন। নিজের জীবন নির্বাহের পাশাপাশি লাইলের পরিবারকেও আর্থিকভাবে সহায়তা করতে থাকেন। ওয়েবসাইট গেজেটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একবার বলেছিলেন, লাইলকে কখনো আবার জীবিত দেখতে পাবেন, এটি তিনি ভাবতেও পারেননি। এক দিকে ভৌগোলিক দূরত্ব, অন্য দিকে যোগাযোগও সীমিত। যোগাযোগ বলতে চিঠি। তা–ও আবার অতি সংক্ষিপ্ত। উপরন্তু, সেনাবাহিনী সেসব চিঠি সেন্সর করে অধিকাংশ বক্তব্যই ঝাপসা করে দিত বা মুছে দিত। এলেনর একবার মজা করে বলেছিলেন, লাইলের চিঠিতে শব্দের চেয়ে কালো কালির আঁচড়ই থাকত বেশি। কিন্তু ভালোবাসায় মাখা সেই সংক্ষিপ্ত লাইনগুলোই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।

আবার হলো দেখা

অবশেষে যুদ্ধ শেষ হলো। ফিরে এলেন লাইল। নিউইয়র্ক সিটিতে দেখা হলো দুজনের। নতুন করে যৌথ জীবন শুরু করলেন। দুজনেই নিউইয়র্কের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হলেন। সরকারি চাকরিতে যোগদান করলেন। সুখী ও ব্যস্ত জীবন। তবে পেশাগত ব্যস্ততাকে তাঁরা থোড়াই কেয়ার করেছেন সব সময়। সময়-সুযোগ পেলেই দুজন মিলে বেরিয়ে পড়তেন ভ্রমণে। বিশেষ করে এলেনরের প্রিয় জায়গা ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের গুয়াদেলুপেতে বেশি যেতেন।

একসঙ্গে কত কিছু!

আদর্শ দম্পতি বলতে যা বোঝায়, ঠিক তা–ই। বয়স বাড়ছে, কিন্তু তাঁদের নতুন কিছু শেখার প্রতি অনীহা জন্মায়নি। অলস সময় কাটানোর মতো মানসিকতা তাঁদের নেই। এলেনরের যখন ৬৯ বছর বয়স, তখন তিনি আরবান এডুকেশনের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন ফোর্ডহ্যাম ইউনিভার্সিটি থেকে। দুজনেই ক্লার্ক আটলান্টা ইউনিভার্সিটির সক্রিয় সদস্য। দ্য গার্ডিয়ানের তথ্যানুসারে, তাঁরা এখন মায়ামিতে মেয়ে অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে থাকেন।

তবে কী সেই দীর্ঘ দাম্পত্যের সূত্র?

এবার আসা যাক সেই মৌলিক প্রশ্নে। না, তেমন কিছু গভীরতর শক্ত সূত্র নয়। একেবারেই সরল, সাদামাটা-নীরব ও সুদৃঢ় ভালোবাসার শক্তি। লাইল বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে সময় কাটাই। একসঙ্গে আমরা অনেক কিছু করেছি।’
তাঁদের মতে, দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকার পেছনে বড় কোনো গোপন সূত্র নেই; বরং একে-অপরকে ভালোবাসা, ধৈর্য এবং একসঙ্গে থাকার ইচ্ছা।
এলেনরের ভাষায়, ‘আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি।’
লাইলের কণ্ঠেও একই প্রতিধ্বনি, ‘আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি।’

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস

আরও পড়ুন