একা আছি তো কী হয়েছে...

>

বিয়ে না করা মানেই একা থাকা নয়, থাকা যায় পরিবারের সঙ্গে আনন্দে
বিয়ে না করা মানেই একা থাকা নয়, থাকা যায় পরিবারের সঙ্গে আনন্দে

একজন মানুষ নানা কারণেই বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটা তার একান্ত নিজের ইচ্ছে বা অনিচ্ছার ব্যাপার। কিন্তু বিয়ে না করা মানেই একা থাকা, বিবাগি হয়ে জাগতিক সব দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে দূরে সরে থাকা বিষয়টি সত্যি নয়

এই বেশ ভালো আছি। মডেল: শাওন, ছবি: সুমন ইউসুফ
এই বেশ ভালো আছি। মডেল: শাওন, ছবি: সুমন ইউসুফ

আসলে বয়স একটা বিষয়। যে বয়সের যে রীতি। বয়সভেদে উৎসুক মানুষের প্রশ্নের ধরনও ভিন্ন। এই আমার কথাই ধরুন, খুব ছোটবেলা থেকে মানুষের মুখে একটাই প্রশ্ন, ‘তুমি এত মোটা কেন? প্রতিদিন সকালে দৌড়াও না কেন?’ সেই সময়ে আমার স্বাস্থ্যচিন্তা নিয়ে আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে আশপাশের সবার ঘুম যেন হারাম হয়ে গিয়েছিল। অন্তত তাদের প্রশ্নবাণে আমার সে রকমই মনে হতো। এরপর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোর পর একটাই প্রশ্ন, চাকরিবাকরি কিছু হলো?

স্রষ্টার অসীম কৃপায় এসব বৈতরণি যখন পার হলাম, টিভিতেও যখন এক-আধবার মুখ দেখানো শুরু হলো, তখন প্রশ্নের ধরন পাল্টে এক জায়গাতেই গাঁট হয়েছে—‘বিয়ে করছ না কেন?’ ‘আর কত দিন একা থাকবে?’ এই প্রশ্ন শুধু আমাকে না, আমার পরিবারের সব সদস্যকেই আলাদা আলাদা তরিকায় শুনতে হয়। বাবা-মাকে ‘ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন না কেন?’ ভাইবোনদের শুনতে হয়, ‘ওকে ধরে একটা বিয়ে করিয়ে দাও।’

আমার জোর বরাত, আমি মেয়ে নই। মেয়ে হলে এই প্রশ্নটা খুব খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করা হতো—‘বিয়ে হচ্ছে না কেন?’ উঠতে-বসতে পরিবার-পরিজন সব জায়গাতেই একই প্রশ্ন শুনতে হতো। আমাকেও যে শুনতে হচ্ছে না, এমনটা নয়। টিভিতে হালকা মুখ দেখাদেখির একটা ব্যাপার আছে তো, তাই কেউ সরাসরি জিজ্ঞেস করে না। আড়ালে-আবডালে চলে কথার চালাচালি।

বিয়ে একটা দারুণ ব্যাপার। মানুষের জীবনচক্রের অংশ। তবে এটা করাও যায়, আবার ছাড়াও যায়। না করেও থাকা যায়। বিয়েতে আমার কোনো আপত্তিও নেই। আমি বিশ্বাস করি, সময়, সুযোগ, যোগ্যতা ও ইচ্ছে—সব এক হলেই বিয়ে করা উচিত, অন্যথায় নয়। অনেকেই হয়তো বিষয়টি মাথায় রাখেন না। তবে আমার বিশ্বাসে বিশ্বাসীও এ দুনিয়াজোড়া অনেক আছেন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের তালিকায় এ সংখ্যা নেহাত কম নয়, যাঁরা অকৃতদার ছিলেন বা আছেন।

যেমন ধরুন টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটা, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও পরমাণুবিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালাম, রাজনীতিবিদ অটল বিহারি বাজপেয়ি, রাজীব গান্ধীর পুত্র রাহুল গান্ধী অথবা হালের ক্রেজ মুম্বাই ফিল্মের নায়ক সালমান খান। বাংলাদেশেও এ তালিকা ছোট নয়। রাজনীতিবিদ নির্মল সেন, শিক্ষাবিদ মনিরুজ্জমান মিয়া, আলোকচিত্রী সাইদা খানম। যাঁদের নাম বললাম, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল ও শ্রদ্ধেয়। বিয়ে না করার পেছনে প্রত্যেকের নিজস্ব যুক্তিও রয়েছে। কেউ হয়তো মনের মতো সঙ্গী খুঁজে পাননি। আবার কেউবা মনে করেছেন বিয়ে করলে তাঁর জীবনের যে লক্ষ্য, তা পূরণ করতে পারবেন না।

একজন মানুষ নানা কারণেই বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটা তার একান্ত নিজের ইচ্ছে বা অনিচ্ছার ব্যাপার। কিন্তু বিয়ে না করা মানেই একা থাকা, বিবাগি হয়ে জাগতিক সব দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে দূরে সরে থাকা বিষয়টি সত্যি নয়। উদাহরণ দিয়ে বলি, আমি নিজে আমার পরিবারের সঙ্গে থাকি। সকালবেলা প্রতিদিন নিয়ম করে মাকে নিয়ে হাঁটতে বের হই, মাসের বাজার করে দিই। এককথায় পরিবারের প্রতিটি দায়িত্বই আমি খুব আগ্রহ নিয়ে করি। এমনকি দূরাত্মীয়ের পুত্রের সুন্নতে খাতনার অনুষ্ঠানেও আমাকে পরিবারের দায়িত্ববোধের কারণেই হাসিমুখে উপস্থিত থাকতে হয়।

একবার এক সন্ধ্যায়, আমাদের খুব কাছের এক বন্ধু ভয়ানক অসুস্থ হয়ে গেল। তার পরিবার-পরিজন কেউ ঢাকায় থাকে না। বন্ধুরাই হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। রাত বাড়তেই একে একে সব বন্ধুই উপযুক্ত কারণে চলে গেলেন। কারও বউ বাসায় একা, কারও-বা বাচ্চা খানিকটা অসুস্থ। এমন না যে এরা স্বার্থপর গোছের কেউ। কিন্তু সংগত কারণেই হাসপাতালে থাকতে পারেনি। আমি একাই রইলাম সারা রাত। আমি বলছি না, বিয়ে করলে এসব দায়িত্ব পালন করা যায় না। অবশ্যই যায়। অনেকেই করছেন কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেকে এতটা দক্ষ মনে করি না।

অনেককে বলতে শুনি, বংশ রক্ষার জন্য হলেও বিয়েটা করো। আমার পরিচিত অনেক দম্পতিই আছেন নিঃসন্তান। সারা দেশে পথেঘাটে অসংখ্য অনাথ শিশু রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। অনেকেই এতিম। অনেক নবজাতককে খুঁজে পাওয়া যায় ডাস্টবিনে। বহু মানুষ চিকিৎসার অভাবে কষ্টে ধুঁকছেন। তাঁদের দায়িত্ব নেওয়ার জন্যও তো কিছু মানুষের থাকা প্রয়োজন, নাকি বলেন? সংসারধর্মে মন দিলে অনেক ক্ষেত্রেই এদের কথা আমাদের একরকম বাধ্য হয়েই ভুলে যেতে হয়।

একজন নারী বা পুরুষ একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারে। তার ভালো-মন্দ দেখভাল নিজেই করতে পারে। তাই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তার হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। এ নিয়ে অন্যদের অতি উৎসাহ শুধু বিরক্তিকর নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। বিশেষ করে নারীদের অবস্থা তো এ ক্ষেত্রে শোচনীয় পর্যায়ে। কোনো নারী যদি সিদ্ধান্ত নেন, তিনি কোনো সঙ্গী ছাড়া জীবন পার করবেন, তাহলে এ সমাজে তার বেঁচে থাকাটাই দায়। পুরুষদের ক্ষেত্রে বিষয়টি এতটা করুণ না হলেও প্রশ্নবাণের ভিড়ে টিকে থাকাটাও কঠিন। কী অদ্ভুত, কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না, জীবনটা আমার। তাই সাজানোর সিদ্ধান্তটাও আমারই হওয়া উচিত।

আজ গল্পের নেশায় পেয়েছে। আরেকটা গল্প বলি, সূচি-টুটুল দম্পতি দুজনেই আমার খুব ভালো বন্ধু (সংগত কারণেই ছদ্মনাম)। প্রতিদিনই এই স্বামী-স্ত্রী আলাদা করে আমাকে ফোন দেন। তাঁদের ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের খবর বন্ধু হিসেবে আমাকে জানান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা কোনো অনুষ্ঠানে যখন তাঁরা দুজনে চওড়া হাসি টেনে ছবি তোলেন, তখন আমি দূর থেকে তাঁদের দেখি আর ভাবি, চরম অসুখী দুজন মানুষ কী নিদারুণ অভিনয় করে তাঁদের পুরোটা জীবন টেনে নিয়ে চলেছেন। এর ব্যতিক্রম চিত্রও আছে। পরিবার-পরিজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নিয়ে খুব সুখে-শান্তিতে কালাতিপাত করছেন অনেকে।

আমার কথা একটাই, সামাজিক শিষ্টাচার মেনে একজন মানুষ যে ধরনের জীবন বেছে নিতে চান, তাঁকে সেভাবেই থাকতে দিন। অহেতুক পরামর্শসুলভ খোঁচায় তাঁর জীবন অতিষ্ঠ করে তোলার কোনো অধিকার কেউ কাউকে দেয়নি। কদিন আগে বিকেলবেলায় অফিসে বসে আছি। এ সময় বাসা থেকে আম্মার ফোন এল। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া এ সময় আম্মার ফোন দেওয়ার কথা না। ফোন ধরতেই আম্মার প্রশ্ন, আজ কি বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরবে? কেন আম্মা? এমনিই আজ সকাল সকাল বাসা থেকে বেরোলে কিনা তাই...। এর পরের প্রশ্নটা আরও অবাক করা, সুমন, তোমার মন ভালো?

কেন আম্মা?

না, সকাল থেকেই তোমার জন্য খুব খারাপ লাগছে। বারবার মনে হচ্ছে, আমার ছেলেটা কি সুখী!

আমিও গা দুলিয়ে হাসতে হাসতে বললাম, অবশ্যই আম্মা। আমি সুখী।

মাঝেমধ্যে ছোট একটা ফোনকলও আমাদের মন ভালো করে দেয়। আসলে পৃথিবীতে সুখী হতে খুব বেশি কিছু লাগে না।

লেখক: মডেল ও অভিনেতা