বদলে যাওয়া প্রেমের হাওয়া

অনলাইনে প্রেমের যুগ এখন

বসার ঘর থেকে প্রেম যখন মুঠোফোনের কল্যাণে শোবার ঘরে এল, সেই সময়েই মারিয়ার সঙ্গে নয়নের পরিচয়। রং নম্বরের অজুহাতে কথা শুরু হলেও নয়ন জানত নম্বরটা ‘রং’ নয়। কারণ, বন্ধুর দূর সম্পর্কের আত্মীয় মারিয়ার নম্বর তো বন্ধুর নোটখাতা থেকেই টুকেছিল নয়ন। এরপর ৩০০ টাকার কার্ড রিচার্জ করে কথা বলত দুজনে।

নয়ন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ দিকে, মারিয়া দেবে ভর্তি পরীক্ষা। তাই পরামর্শের নামে এই সময়ে প্রেমের বন্ধন যেন বেশি মজবুত হলো। মারিয়া চান্স পেল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সপ্তাহে দুইবার নয়ন তখন জাহাঙ্গীরনগর যেত, মারিয়াও নিউমার্কেট আসত নীলক্ষেতে বই কেনার নাম করে।

তবে মুঠোফোনে যোগাযোগ বেশি হতো তাদের। কতদিন যে ঠিক সময়ে ফোন ধরতে না পারার অজুহাতে ঝগড়া হয়েছে দুজনের। নয়ন সেই সময়ের একটি ঘটনা বললেন, ‘একবার গিয়েছিলাম একটা বিয়ের দাওয়াত খেতে। মারিয়া যে দুইবার ফোন দিয়েছে, সেটা টের পাইনি। সাড়ে ১২টার পর তাকে যখন ফোন দিলাম, সে আর ধরে না। চলতে থাকল এসএমএস। কিন্তু মারিয়ার একই কথা, আমি ওখানে অন্য কোনো মেয়েকে দেখে তার ফোন ধরিনি। ডিসেম্বরের ভরা শীতে সেই রাতে আমাকে যেতে হলো জাহাঙ্গীরনগরে। সারা রাত চেষ্টা করেও রুম থেকে বের করতে পারলাম না মারিয়াকে। আমিও জেদ করে হলের গেটে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভোরবেলা অবশ্য মারিয়া নেমেছিল। তারপর একচোট ঝগড়ার পর আবার মিটমাট।’

তৃতীয় বর্ষে বাড়ি থেকে মারিয়ার বিয়ের কথা তুললে সে জানিয়ে দেয় আমাদের সম্পর্কের কথা। মুঠোফোনে হবু শ্বশুর মশাই ডেকে পাঠালেন নয়নকে। শুরুতে নানা ঝামেলা হলেও শ্বশুর পরে মেনে নিয়েছিলেন। এখন নয়ন আর মারিয়ার ঘরে দুই সন্তান। কলেজ পেরিয়ে মেয়ে পা রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছেলে পড়ছে নবম শ্রেণিতে। নয়ন ও মারিয়া দুজনেই সরকারি চাকরি নিয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছেন।

ফেসবুকে ভুল প্রেমে পড়েছিলেন নিশা

নিশা (ছদ্মনাম) এখন ইউরোপের একটি দেশে আছেন। ঘর–সংসার আর চাকরি নিয়ে ভালোই চলছে। তবে দিনাজপুরের মেয়ে নিশা কখনো ভাবেননি এভাবে বদলে যাবে তাঁর জীবন। ২০০৮ সালে ফেসবুকে পরিচয় হয় সুদর্শন এক যুবকের সঙ্গে। ফেসবুকে প্রোফাইলের ছবি দেখে নক করেছিলেন দিশাই। ঘণ্টাখানেক পর বন্ধু হলেন তাঁরা। অনলাইনে চ্যাটিং শুরু হ্যালো দিয়ে। ছেলেটিই প্রথমে লিখেছিলেন নিশাকে। এত বছর পর এখনো নিশার মনে আছে, ‘ওর হ্যালো শব্দটি অন্য রকম এক অনুভূতি দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ছুটিতে আমি তখন গ্রামের বাড়ি। ল্যাপটপ নিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলাম। একটানা দুই ঘণ্টা সেদিন চ্যাটিং করেছিলাম আমরা। এক সপ্তাহ পরে ছেলেটি আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। আমিও রাজি হয়ে যাই।’

তবে শুধু অনলাইনে একজন মানুষকে যে চেনা যায় না, সেটা বুঝতে নিশার তিন বছরের মতো সময় লেগেছিল। ঢাকায় ফেরার পর ভয়ে ভয়ে একদিন দেখা করেন তাঁরা। প্রোফাইলে দেখা ছবির মানুষই যে সামনে, তা দেখে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। দেখা সাক্ষাৎ চলতে থাকে রোজ। একদিন ছেলেটির আবদারে নিজের কয়েটি ব্যক্তিগত ছবি পাঠান নিশা। দুই দিন পর বদলে যেতে থাকে ছেলেটির আচরণ। শুধু বলেন তাঁর বাসায় যেতে। চাপ আর ভয়ে বারকয়েক দুজনে মিলিতও হয়েছিলেন। তবে দিনের পর দিন চাপ দিতে থাকে ছেলেটি। তাই পরিবারে জানাতে বাধ্য হন নিশা। নিশা বলেন, ‘আমি অনেক ভয় নিয়ে কথাটা জানিয়েছিলাম মাকে। তবে দুই মিনিটের মধ্যে আব্বু এসে আমাকে কোলে টেনে নিয়েছিলেন। সাহস বেড়ে আমার দ্বিগুণ হয়ে যায়। এরপর তো নানা জটিলতা কাটিয়ে পরিবার আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়।’

২০১৬ সালে প্রবাসে বিয়ে করেছেন পরিবারের পছন্দে। এখন নিশা ভালো আছেন।

প্রেমের নতুন জমানায়

অনলাইনের সহজলভ্যতায় প্রেমও যেন বদলে গেছে আরেক ধাপ। নানা রকম ডেটিং অ্যাপ আছে এখন। গাঁটের টাকা দিয়ে সেখানে নিজের প্রোফাইল খুলছেন তরুণ–তরুণীরা। বিশেষ করে কিশোর বয়সীরা। তেমনই একজন ঢাকার ছেলে সোয়েব। দশম শ্রেণির ছাত্র সোয়েব চালায় ডেটিং অ্যাপ টিন্ডার। এখানেই কয়েকজন তরুণীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। তার মধ্যে একজনের সঙ্গে এখন মন দেওয়া নেওয়া চলছে তার। সোয়েব বলে, ‘ব্যাপারটার মধ্যে একটা থ্রিল আছে। কেউ কাউকে চিনি না, তাই খানিকটা সন্দেহ নিয়েই পরিচয় পর্ব শুরু হয়। কয়েকবার দেখা সাক্ষাতের পরই বুঝি আমাদের অনেক মিল আছে। তাই প্রেমের দিকে এগিয়েছি।

অনলাইনে ডেটিং অ্যাপেও প্রেম হচ্ছে আজকাল

সোয়েব জানান তাঁর বন্ধুদের অনেকেই টিন্ডারের মাধ্যমে প্রেম করছে। স্কুলে বা পাশের বাড়ি একজন মেয়েকে দেখে তার পেছনে লেগে পড়া নাকি ‘ছ্যাঁচড়ামো’ লাগে তাদের কাছে।

যুগে যুগে প্রেমের এই যে ধরন, সেটা পাল্টে যাওয়ার ভালো–মন্দ নিয়ে বিস্তর তর্ক হতে পরে। তবে কোনো সময়ের প্রেমকেই খাটো করে দেখার কী উপায় আছে! প্রেম হয়তো খাঁটি হয় সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। কেউ হয়তো বলবেন, আগে প্রেম করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। তাই সেই সময়ের প্রেম বেশি স্থায়ী ছিল। তাদের জন্য জানিয়ে রাখি এই সময়ের তরুণ প্রেমিক সোয়েবের একটি কথা, ‘আমদের প্রেমটা হয়তো ডেটিং অ্যাপের কারণে সহজে হয়েছে, কিন্তু এখনো অনেকদূর চলা বাকি। আর সেই পথে এগিয়ে যেতে তো আমাদের দুজনেরই মনের মিল থাকা চাই। দুজনের কম্প্রোমাইজের মাধ্যমে সেটা আমরা সফল করতে চাই।’