রূপকথার বাবা

লিয়াকত আলী ছিলেন লুনা পারভীনের গৃহশিক্ষক। তারপর যা হয় আরকি...! পাটিগণিতের এক ফাঁকে মনের অজান্তেই মন দিলেন ছাত্রীকে। ছাত্রীরও শিক্ষককে পছন্দ। দুজনেরই তখন বয়স কম। তবু কাজি বিয়ে পড়ালেন। ১৯৯২ সালে লুনা যখন বউয়ের শাড়ি গায়ে জড়াল, তখন তার বয়স সাড়ে পনেরো।

লিয়াকত আলী তখন চট্টগ্রামের মোংলায় চাকরি করেন। লুনা অন্তঃসত্ত্বা। বিকেলে শ্বশুরবাড়ির উঠানে খেলছিলেন। খেলতে গিয়ে একদিন পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলেন। তারপর সময়ের দুই মাস আগেই উঠল প্রসব ব্যথা। নৌকায় করে নদী পার হলে বাজার। বাজার পার হলেই হাসপাতাল। একজন দাই নিয়ে নৌকায় করে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দিলেন লুনা। পথেই জন্ম নিল বড় মেয়ে নীলা। কিছুদূর এগোতে না এগোতেই বাজারে জন্ম নিল শিলা। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই আকাশ দেখল জমজ দুই মেয়ে।

শুরু হলো যুদ্ধ। কেমন যুদ্ধ? ‘দুই মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ। স্রেফ বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ। নানান শারীরিক জটিলতা ছিল। একে তো একসঙ্গে দুইজন। তার ওপর আবার সময়ের দুই মাস আগেই স্বাভাবিক জন্ম। আর মায়েরও তো মা হওয়ার সময় হয়নি। আমি ছুটি নিয়ে ওদের তিনজনের দেখভালের দায়িত্ব নিলাম। ধীরে ধীরে জটিলতা কাটিয়ে সুস্থ হলো ওরা, বড় হয়ে উঠতে লাগল নিলা আর শিলা।’

বাবার সঙ্গে নীলা ও শিলা
ছবি: সংগৃহীত

২০০২ সালে স্ত্রী আর দুই কন্যাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন লিয়াকত আলী। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক দুর্ঘটনায় মারা যান তাঁর স্ত্রী। দুই মেয়ে নিয়ে তখন অথই সাগরে পড়লেন। প্রথম কয়েক মাস বাড়িতে এক ভাগ্নি ছিল। আর ছিল সহকারী। তাঁদের নিয়েই শুরু হলো লিয়াকত আলীর একের ভেতর দুই, বাবার ভেতর মায়ের যাত্রা। ভাগ্নির বিয়ের পর একা হাতেই সব সামলাতেন। রান্না করা, বাচ্চাদের তৈরি করা, তাদের স্কুলে দিয়ে অফিসে যাওয়া, অফিস থেকে কিছুক্ষণ পরপর ফোন করা, বাড়ি ফিরে তাদের সমস্ত দিনের ঘটনা শোনা, খাওয়ানো, গল্প করে ঘুম পাড়ানো—সব নিজেই করতেন লিয়াকত। এভাবেই বড় হতে লাগল দুই বোন নীলা আর শিলা।

স্ত্রীর মৃত্যুর পরও শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্কের হেরফের হলো না। আগে যেমন ছিল, তেমনই চলতে লাগল। নীলা–শিলার খালা, মামারা আগেও যেমন ঢাকায় এসে তাদের বাসায় উঠতেন, এখনো তা–ই। নীলা–শিলার মামা–খালা, চাচা–ফুফুরা বলতেন, ‘তোরা বড় হয়ে যাবি। মেয়েরা তো আরও আগে আগে বড় হয়। চোখের পলকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙিয়ে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবি। তোর বাবাই শেষ বয়সে একলা হয়ে যাবে। একাকীত্বে ভুগবে।’ এই দুই বোনও চাইতেন বাবাকে বিয়ে দিয়ে ‘নয়া মা’ আনতে। নিজেরা ‘যুক্তি করে’ খুঁজেছেনও। তাঁদের ভেতর দুই–একজনের ‘ইন্টারর্ভিউ’ও নিয়েছেন। কিন্তু শেষমেশ বাবা পণ্ড করে দিয়েছেন তাঁদের আইডিয়া। তিনি কিছুতেই আর বিয়ে করবেন না।

২০০০ সালে ষষ্ঠ জন্মদিনে বাবার সঙ্গে ছোট্ট নীলা আর শিলা
ছবি: সংগৃহীত

লিয়াকত আলীর কাছে জানতে চাইলাম, ১৬ বছর হয়ে গেল। কেন আর বিয়ে করলেন না? উত্তরে বললেন, ‘দরকার কী! অযথা জটিলতা বাড়ানোর! সংসারে একটা মানুষ এল। আমার দুই মেয়ের সঙ্গে যদি তার মতের মিল না হয়? মানসিকতার মিল না হয়? ওরা যদি কোনো টানাপোড়েন অনুভব করে? চাইনি। আমি তো নিজেই সব পারি। পোলাও, খিচুড়ি, বিরিয়ানি সব।’

রান্নার ইস্যুতে সহমত প্রকাশ করে মেয়েরা জানিয়েছেন, ঘটনা সত্য। তাঁদের বাবা পাকা রাধুনি। নীলা বলেন, ‘যখন বাড়িতে সহকারী থাকত না বা ছুটি নিত, ঘুম থেকে উঠে দেখতাম, সকালের নাশতা টেবিলে রেডি। দুপুরের রান্নাও শেষ। তরকারি আর গরম ভাতে ধোঁয়া উঠছে। তারপর বাবা অফিসে যেত। আর অফিস থেকে কিছুক্ষণ পর পর ফোন করত।’

স্ত্রীর সঙ্গে লিয়াকত আলী
ছবি: সংগৃহীত

নীলাই জানান, বাবা কেবল তাঁদের মা নন, বন্ধুও। বললেন, ‘আমাদের মধ্যে কোনো আড়াল নেই। আমি প্রেম শুরু করেছি, বাবাকে জানিয়েছি। বাবা বলেছে, “আরেকটু দেখ। সে রকম মনে হলে দেখা করিয়ে দিস।” আবার ব্রেকআপের পরও সবার আগে কাঁধ দিয়েছে সেই বাবাই। নীলাও তো নিজের পছন্দে বিয়ে করল। বাবা বলেই দিয়েছিল, “তোমরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজের ইচ্ছে, পছন্দমতো বিয়ে করো”।’

লিয়াকত আলীর এক বন্ধুর স্ত্রী ডাক্তার। বয়ঃসন্ধিকালে বাবা মেয়েদের বলে দিয়েছিলেন, যেকোনো সমস্যা হলে সেই আন্টিকে জানাতে। এখন দুই মেয়েই বড় হয়েছে। নিলা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে একটা আইটি ফার্মে চাকরি করেন। কিছুদিন আগে ধুমধাম করে বিয়ে হলো তাঁর। শিলা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে এখন আছেন একটি মুঠোফোন কোম্পানিতে।

নীলা আর শিলা বলেন, ‘আমাদের বাবা এই গ্রহে একজনই। তাঁর মতো আর কেউ নন।’ সবার বাবাই তা–ই, কিন্তু লিয়াকত আলী তাঁদের ভেতরও একটু যেন আলাদা। সত্যিকার জীবনের যোদ্ধা হয়েও তিনি বড় পর্দার নায়কের মতো ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ বাবা, রূপকথার গল্প, উপন্যাসের বাবা। নিলা–শিলার বাবা।