একচোট হাসাহাসির পর মুনির হাসান জানালেন, এবার পাই দিবস আয়োজন করা যায়, সেখানে পাই মুখস্থবিদদের ডাক দেওয়া হবে।

ব্যস! এভাবেই ২০০৬ সালের ১৪ মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আয়োজিত হলো পাই দিবস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ভবন থেকে একটা র‍্যালি হলো। র‍্যালি শেষে পাইয়ের ছবিওয়ালা বড় একটা কেক কাটা হলো। পাই নিয়ে পুঁথি পাঠ হলো। পাইয়ের মান বলার প্রতিযোগিতা হলো।

তত দিনে আমি ৩২৭ ঘর পর্যন্ত শিখে ফেলেছি, ওটাই ছিল সে সময়ের রেকর্ড। এখন অবশ্য আমি নিজেই কয়েকজনকে চিনি, যাঁরা দশমিকের পর কয়েক হাজার ঘর জানেন। আর সারা পৃথিবীর রেকর্ড—দশমিকের পর এক লাখের ওপরে (আকিরা হারাগুচি, জাপান, ২০১৫)!

পাই ব্যাপারটা কী?

আমি জানি, অনেকের মনের ভেতরই কিছু প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করেছে। পাই কী জিনিস, আর সেটা নিয়ে কেন মাতামাতি। এমন অযথা মুখস্থ করার কোনো মানে আছে?

পাইয়ের পরিচয়টাই আগে দিই। পাই একটা গাণিতিক ধ্রুবক। আমরা তো সবাই বৃত্ত চিনি। একটা বৃত্তের কোনো একটা বিন্দু থেকে হাঁটা শুরু করে পুরো বৃত্তটা ঘুরে যদি আবার আগের বিন্দুতে পৌঁছানো যায়, তাহলে যতটুকু পথ হাঁটা হবে, সেই দূরত্বকে বলে বৃত্তের পরিধি।

আর আমরা যদি বৃত্তের ওপরের একটা বিন্দু থেকে শুরু করে কেন্দ্র বরাবর সোজাসুজি হাঁটতে শুরু করি, আর তারপর কেন্দ্র পার হয়ে উল্টো পাশের বিন্দুটা পর্যন্ত হাঁটি, যত দূর হাঁটা হবে, সেই দূরত্বকে বলে বৃত্তের ব্যাস।

এবার একটা ব্যাপার ভাবা যাক। আমরা যদি একটা বৃত্তকে চারপাশ থেকে টেনে বড় করে আগের দুই গুণ বানিয়ে ফেলি, তাহলে এর পরিধি যেমন দুই গুণ হয়ে যাবে, ব্যাসও দুই গুণ হয়ে যাবে। আবার চেপেচুপে অর্ধেক বানালে, পরিধি আর ব্যাস দুটোই অর্ধেক হয়ে যাবে। এদের ভাগফল কিন্তু একই থাকবে। একটা বৃত্ত যত বড় বা যত ছোটই হোক না কেন, এর পরিধিকে ব্যাস দিয়ে ভাগ করলে সব সময় একই সংখ্যা পাওয়া যায়। সেই সংখ্যাটাকেই বলা হয় পাই।

কিন্তু পাইয়ের মান আসলে কত?

এখন আমরা জানি যে পাইয়ের মান ৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫৮৯৭৯৩২…এভাবে অনন্তকাল চলতে থাকবে, কখনো শেষ হবে না। আধুনিক কম্পিউটার দিয়ে কয়েক লাখ কোটি ঘর পর্যন্ত মান বের করা হয়েছে, আরও হচ্ছে। কিন্তু এ যাত্রার শুরুটা কয়েক হাজার বছর আগে। প্রাচীন মিসর আর ব্যাবিলনের মানুষদের পাই নিয়ে সামান্য ধারণা ছিল। তারা মেপে বের করেছিল এটার মান ৩-এর কাছাকাছি। কিন্তু গাণিতিকভাবে বের করার কোনো চেষ্টা জানা যায় না।

২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রাচীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ আর্কিমিডিস বৃত্তকে বহুভুজ দিয়ে অনুমান করে প্রমাণ করলেন যে পাইয়ের মান হবে ২২৩/৭১ থেকে ২২/৭ এর ভেতরে। তাঁর বলা সেই ২২/৭ এখনো পাইয়ের অনুমান হিসাবে ব্যবহৃত হয়। পাই কিন্তু আসলে ২২/৭ নয়, তার চেয়ে একটু ছোট। যা হোক, আর্কিমিডিসের কাছ থেকে দশমিকের পর দুই ঘর পর্যন্ত ঠিকঠাক মান পাওয়া গেল। তাঁর দেখানো পথ ধরে আরেকটু নিখুঁত অনুমান বের করলেন চীনা গণিতবিদেরা, ৭ ঘর পর্যন্ত মান পাওয়া গেল তখন।

খ্রিষ্টাব্দ ১৪ শতকে ভারতীয় গণিতবিদ মাধব অসীম ধারার ধারণা দেওয়ার পর পাইয়ের মান বের করার ব্যাপারটা নতুন গতি পেল। ১৬ শতকে আইজ্যাক নিউটন তাঁর ক্যালকুলাসের ধারণা ব্যবহার করে বের করলেন ১৫ ঘর পর্যন্ত। গণিতবিদেরা পাইয়ের মান আরও নিখুঁত করে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। তখনো ক্যালকুলেটর বা কম্পিউটার তৈরি হয়নি, তাই কাজটা ছিল দারুণ শ্রমসাধ্য আর সময়সাপেক্ষ। উইলিয়াম শ্যাঙ্কস জীবনের একটা বড় সময় ব্যয় করে বের করলেন ৭০৭ ঘর পর্যন্ত, কিন্তু পরে দেখা গেল ৫২৭ ঘরের পরে সবই ভুল!

আমরা যাকে ‘পাই’ বলে এখন এক নামে চিনি, সেই সংখ্যাটাকে ‘পাই’ নামে প্রথম ডেকেছিলেন উইলিয়াম জোনস, ১৭০৬ সালে। ১৭৬০ সালে ল্যাম্বার্ট প্রমাণ করলেন পাই একটা অমূলদ সংখ্যা। দুটো পূর্ণসংখ্যার ভাগফল হিসাবে এটাকে কোনো দিনও প্রকাশ করা যাবে না। দশমিকের পরে এটাকে লিখে কোনো দিনও শেষ করা যাবে না।

যদি জানিই যে এটা কখনো শেষ হবে না, তাহলে এত ঘর বের করার কারণ কী? আর এত ঘর মুখস্থ করারই-বা কী দরকার?

সত্যিটা হলো, মুখস্থ করার আসলেই কোনো মানে নেই। দশমিকের পর অনেক ঘর বলতে পারা আলাদা করে কোনো গণিত-প্রতিভা নির্দেশ করে না। এখানে যেটা আছে, সেটা হলো স্রেফ নির্দোষ আনন্দ। এর বেশি কিছু নয়। দশমিকের পর হাজার ঘরের কোনো প্রায়োগিক ব্যবহার নেই, তাই মান বের করার ভেতরেও আনন্দটাই মুখ্য ছিল এত দিন। এখন একটা কম্পিউটারের গণন-ক্ষমতা কতটা শক্তিশালী, সেটা পরীক্ষার একটা উপায় হতে পারে পাইয়ের মান বের করা।

পাই-ই কেন? কোথায় কাজে লাগে এটা

যদিও পাইয়ের শুরুটা ছিল একটা সাধারণ ধ্রুবক হিসেবে, পরে দেখা গেল সব জায়গায় অপ্রত্যাশিতভাবেই চলে আসে পাই। বৃত্ত-উপবৃত্তের ক্ষেত্রফল, অসীম ধারার যোগফল, পরিসংখ্যানের নরমাল ডিস্ট্রিবিউশন, পদার্থবিদ্যার তরঙ্গ সমীকরণ, অনিশ্চয়তা নীতি, রসায়ন, প্রকৌশল কিংবা অয়লারের অনিন্দ্য সুন্দর অভেদক (eiπ+1=0), কোথায় নেই পাই! এমন সব কারণে পাই গণিতবিদদের দারুণ আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে ছিল সব সময়ই। তাই বলে দিবস বানিয়ে ঘটা করে উদ্‌যাপন করা হবে, এ ধারণা কিন্তু বেশি আগের নয়।

১৪ মার্চ কেন পাই দিবস?

যুক্তরাষ্ট্রে তারিখ লেখার সময় আগে মাস লেখে, তারপর দিন। আগেই বলেছি, পাইয়ের মান হলো ৩.১৪১৫৯…। এর থেকে প্রথম তিন অঙ্ক নিলে পাওয়া যাবে ৩.১৪। এটাকে মার্কিনদের মতো করে ভাবা যায় মার্চের ১৪ তারিখ। ১৯৮৮ সালে মার্কিন পদার্থবিদ ল্যারি শ প্রথমবারের মতো পাই দিবস আয়োজন করলেন সানফ্রান্সিসকো শহরে। সেখানে একটা রংচঙা প্যারেড হলো, আর প্যারেড শেষে সবাই মিলে ‘পাই (pie)’ নামের মিষ্টান্ন খেল। এরপর ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীর গণিতপ্রেমী মানুষদের ভেতরে একটি জনপ্রিয় দিবস হয়ে উঠল এই পাই দিবস। অঙ্কের কোনো একটা ব্যাপার নিয়েও যে একটা দিবস হতে পারে, উৎসব হতে পারে, এটাই তো দারুণ। গণিত তখন বইয়ের পাতা থেকে এসে আমাদের আনন্দময় সংস্কৃতির অংশ হয়ে যায়। এই দিনে কেউ পাই মিছিল বের করে, কেউ ‘পাই’ খায়, কেউ গণিত নিয়ে গান বাঁধে, স্কুলে শিক্ষকেরা বাচ্চাদের সঙ্গে অঙ্ক আর সংখ্যা নিয়ে খেলেন, পাইয়ের গল্প শোনান, পোশাকের দোকানে অঙ্কের নকশাওয়ালা জামা বিক্রি হয়, পাইয়ের মান মুখস্থ বলার প্রতিযোগিতাও হয় কোথাও।

অঙ্ক নিয়ে মাতামাতি, সংখ্যার প্রতি মোহ—এসব আপাতদৃষ্টে অর্থহীন মনে হতে পারে। কিন্তু এ থেকে যে ভালোবাসা আর একাগ্রতার জন্ম হয়, সেটার ফল সুদূরপ্রসারী। পাই দিবস সংখ্যার প্রতি ভালোবাসা উদ্‌যাপনের দিন, আর তাই সংখ্যাপ্রেমী মানুষের কাছে বিশেষ আনন্দের দিন! আর এ দিনটিতেই আমাদের প্রিয় বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিন, তাই আনন্দের মাত্রাটাও দ্বিগুণ।