যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ১০ প্রশ্ন

উচ্চশিক্ষা নিতে প্রতিবছর যুক্তরাজ্য যাচ্ছেন বাংলাদেশের বহু শিক্ষার্থী। সেখানে পড়ালেখার সুযোগ বা চ্যালেঞ্জগুলো কী? যুক্তরাজ্যে পাঠরত বা পাঠ শেষ করা কয়েকজন শিক্ষার্থী, গবেষক, শিক্ষক ও পেশাজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি আমরা।

নানা দেশের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে
ছবি: সংগৃহীত

১. স্নাতকের জন্য কি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করা যায়?
স্নাতক পর্যায়ে যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রির জন্য আবেদন করা যায়। পড়ালেখা ও গবেষণায় বিশ্বমানের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাজ্যে রাসেল গ্রুপ নামে পরিচিত। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বৈশ্বিক র‌্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরে সরাসরি স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির সুযোগ কম। ফাউন্ডেশন কোর্স করে স্নাতক পর্যায়ের প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া যায়। এ লেভেল–ও লেভেলে পড়া শিক্ষার্থীরা সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করতে পারেন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

২. বৃত্তির সুযোগ কেমন?
স্নাতক পর্যায়ে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি ও আর্থিক সহযোগিতা, ফেলোশিপের সুযোগ খুবই সীমিত। তিন থেকে পাঁচ হাজার পাউন্ডের বৃত্তির জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভীষণ প্রতিযোগিতা। লন্ডন স্কুল অব লিডারশিপ, ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজির ডিরেক্টর অব এডুকেশন ড. নিয়াজ চৌধুরী বলেন, শতভাগ বৃত্তি স্নাতক পর্যায়ে নেই বললেই চলে। রাসেল গ্রুপের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা কিছু বৃত্তির সুযোগ পান। তবে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বৃত্তির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সরকারিভাবে মাস্টার্স ও পিএইচডির জন্য কমনওয়েলথ স্কলারশিপ ও শুধু মাস্টার্সের জন্য চিভনিং বৃত্তি আছে। অনেক সময় বিভিন্ন গবেষণার ক্ষেত্রে অধ্যাপকরা নিয়মিত পিএইচডির জন্য বৃত্তি দেন।

৩. সরকারি বৃত্তির জন্য কী কী যোগ্যতা লাগে?
কমনওয়েলথ বৃত্তি ও চিভনিং বৃত্তির জন্য স্নাতক পর্যায়ে ফলাফল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি নেতৃত্বের যোগ্যতা, সামাজিক বিভিন্ন কাজে সংশ্লিষ্টতা, পেশা ও গবেষণাক্ষেত্রে সংযুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটার থেকে ক্রিয়েটিভিটি, ইনোভেশন অ্যান্ড বিজনেস স্ট্র্যাটেজি বিষয়ে চিভনিং বৃত্তি নিয়ে মাস্টার্স পর্যায়ে পড়েছেন শুভাশীষ রায়। আসছে সেপ্টেম্বরে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য বৃত্তি নিয়ে পড়তে যাবেন ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটারের বিজনেস স্কুলে। তিনি বলেন, মাস্টার্স পর্যায়ে চিভনিং বৃত্তির মাধ্যমে প্রতিবছর বাংলাদেশের শিক্ষার্থী, গবেষক ও পেশাজীবীরা পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন নিয়মিত। বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা নেটওয়ার্কিং দক্ষতা বিকাশেরও সুযোগ পান। ২০২৩-২৪ সেশনের চিভনিং বৃত্তির জন্য আবেদনপত্র গ্রহণ করা হচ্ছে। বিস্তারিত: www.chevening.org/scholarship/bangladesh/

৪. আর কী কী বৃত্তি আছে?
ড. নিয়াজ চৌধুরী বলেন, ওভারসিজ স্টুডেন্ট স্কলারশিপ বলে একটা সরকারি বৃত্তি আগে চালু ছিল। রাসেল গ্রুপের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় একই ধরনের বৃত্তি চালু আছে। বৃত্তি সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা যাবে। যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান নিয়মিত বৃত্তি দেয়। এন্ড্রু কার্নেগির অনুদানে কার্নেগি-ক্যালেডোনিয়ান স্কলারশিপ দেওয়া হয় স্কটল্যান্ডে। প্রতি বছর ১৫ জন পিএইচডি গবেষক এই বৃত্তি পান। এ ছাড়া ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে নিয়মিত বেশ কিছু পিএইচডি স্কলারশিপ দেওয়া হয়।

৫. আইইএলটিএস স্কোর কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ?
ভর্তির প্রতিযোগিতায় টিকতে আইইএলটিএস একটা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। নির্দিষ্ট স্কোর অর্জন করার মাধ্যমে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। তবে এই স্কোর বৃত্তিতে ভূমিকা রাখে না। অধিকাংশ বৃত্তির আবেদন আইইএলটিএসের স্কোর ছাড়াই করা যাচ্ছে। তবে, আইইএলটিএস স্কোরকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ৬.৫ থেকে ৭.৫ স্কোর প্রয়োজন হয়।

৬. পড়াশোনার ধরন কেমন?
শুভাশীষ রায় বলেন, যুক্তরাজ্যে পড়াশোনার ধরনে ব্যবহারিক প্রয়োগ বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাস্তব জীবনের নানা সমস্যা ও পরিস্থিতি, গ্রুপওয়ার্ক, ওয়ার্ক সিমুলশনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রস্তুত করা হয়। ড. নিয়াজ চৌধুরী বলেন, মধ্যম মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন বেশ ভালো করছে। ডিগ্রি অর্জনের পর শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে নানা মাত্রায় সহযোগিতা করছে তাঁরা। ইউরোপের অন্য দেশের চেয়ে যুক্তরাজ্যের পড়াশোনার কাঠামো আন্তর্জাতিক মানের ও আধুনিক। ইউনিভার্সিটি অব দ্য ওয়েস্ট অব স্কটল্যান্ড থেকে ডক্টরেট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিগ্রিধারী ড. সাদিয়া টুম্পা জানান, পড়ার সুযোগ অন্যান্য ইউরোপের দেশের চেয়ে যুক্তরাজ্যে বেশি। গবেষণার সুযোগ বেশি।

৭. জীবনযাত্রার মান ও খরচ কেমন?
বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে খরচ ভিন্ন। রাসেল গ্রুপে সংযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যয় বেশি, সুযোগ-সুবিধাও আন্তর্জাতিক মানের অবশ্য। এমনিতে জীবনযাত্রার মান যুক্তরাজ্যের সব জায়গায় প্রায় একই রকম। দক্ষিণে ব্যয় একটু বেশি। লন্ডনের সঙ্গে ম্যানচেস্টারে একই ধরনের বাড়ির ভাড়ার পার্থক্যটা চোখে পড়ার মতো। সুযোগ-সুবিধার পার্থক্য খুব বেশি নেই। লন্ডনে চাকরির সুযোগ বেশি, কিন্তু চাকরির অবেদনকারীর সংখ্যাও অনেক বেশি। উত্তরের শহর ম্যানচেস্টার, লিডস, লিভারপুল বা শেফিল্ডে খরচ কম, কিন্তু বেতন কাঠামো একই।

৮. বৃত্তি ছাড়া পড়তে চাইলে খরচ কেমন?
আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি ছাড়া পড়ার খরচ অনেক বেশি। লিভারপুল জন মুরস বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনসে মাস্টার্সে পড়ছেন রামেন্দ্র সুখন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে মাস্টার্স শ্রেণিতে বৃত্তি ছাড়া পড়তে বছরে ১০ থেকে ১৬ হাজার পাউন্ডের মতো খরচ পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে টিউশন ফিতে পার্থক্য আছে। রাসেল গ্রুপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিউশন ফি প্রায় ২৫ থেকে ৩৫ হাজার পাউন্ড। মধ্যম মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি ১৪ থেকে ১৮ হাজার পাউন্ড। থাকা-খাওয়ায় মাসে আটশো থেকে হাজার পাউন্ড লেগে যায়।

৯. পড়ালেখার পাশাপাশি কাজ করার সুযোগ আছে?
যুক্তরাজ্যে একজন শিক্ষার্থী পড়ালেখার পাশাপাশি সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজ করার অনুমতি পাচ্ছেন। সরাসরি ব্যবসা, ফ্রিল্যান্সিং করার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আছে। রামেন্দ্র সুখন বলেন, অনেক শিক্ষার্থী স্থানীয় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করা যায়।

১০. পড়ালেখা করে যুক্তরাজ্যে চাকরির সুযোগ কেমন?
ইউরোপের একটি উন্নত দেশ হিসেবে পড়াশোনার পর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের গবেষণার যেমন সুযোগ থাকে, তেমনি চাকরির অনেক সুযোগ আছে। ড. সাদিয়া টুম্পা জানান, মেধাবী শিক্ষার্থীদের যুক্তরাজ্যের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ আছে। অনেক শিক্ষার্থীই এখানে উচ্চশিক্ষা শেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন ফ্রান্স, স্পেনে চাকরির সুযোগ পায়। ব্রেক্সিটের পরে যুক্তরাজ্যে কাজের সুযোগ বাড়ছে। ড. নিয়াজ চৌধুরী বলেন, উচ্চশিক্ষিত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের এখানে অনেক সুযোগ আছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য ‘স্কিলড ওয়ার্কার ভিসা’ চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা গ্র্যাজুয়েট ভিসার মাধ্যমে স্নাতক-মাস্টার্সের পরে দুই বছর, পিএইচডির পরে তিন বছর কাজের অনুমতি পাচ্ছে। যদি কেউ চান, তাহলে কাজ করার সময়েই স্কিলড ওয়ার্কার ভিসায় আবেদন করতে পারেন। কোভিড মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট পেশার জন্য বিশেষ কাজের স্কিম চালু করা হয়েছে। মেডিকেল ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে পড়ুয়াদের চাকরির অনেক সুযোগ আছে।