গবেষণা করতে গিয়ে কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা

ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিংবা দলবেঁধে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন শিক্ষার্থীরা। গবেষণা করার জন্য গড়ে উঠেছে ক্লাবও। কীভাবে তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন? কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন? কী নিয়ে চলছে গবেষণা?

নবীন গবেষকদের জন্য তহবিলের সুযোগ কম

নাসরিন জেবিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় আমার গবেষণায় হাতেখড়ি। বিভাগের এক সিনিয়র আপুর কাছে শুনেছিলাম, গবেষণা প্রকাশিত হলে সম্মানজনক বৃত্তি নিয়ে বিদেশে পড়তে যাওয়া সহজ হয়। এর পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদে যোগ দিই। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি ‘রিসার্চ ক্লাব’। ক্লাবের বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গবেষণার সঙ্গে পরিচিত হতে থাকি। আগে পত্রিকার সম্পাদকীয়তে দু-একটি লেখা লিখেছি। ‘রিসার্চ মেথডলজি’ (গবেষণা পদ্ধতি) সম্পর্কে জানার পর একাডেমিক লেখালেখির প্রতিও আগ্রহ তৈরি হয়।

নাসরিন জেবিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

গবেষণায় ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে প্রচুর পড়ার মানসিকতা থাকতে হয়। আর পড়াশোনা করতে আমার ভালোই লাগে। শুরুর দিকে নিজ বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরি থেকে রিসার্চ মেথডলজির বই নিয়ে পড়তাম। তারপর বিভিন্ন জার্নালের ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি গবেষণা নিবন্ধ ডাউনলোড করে পড়তাম। এভাবে ধীরে ধীরে গবেষণা নিবন্ধ লেখার পদ্ধতি শিখতে থাকি। স্নাতকোত্তরে পড়ার সময় আমার প্রথম ‘একাডেমিক পাবলিকেশন’ বের হয়। জার্নালে প্রকাশিত আর্টিকেল, সম্পাদিত বই, বইয়ের অধ্যায়, সম্মেলনে পঠিত পেপার ইত্যাদিসহ আমার মোট প্রকাশনা ২৩টি। আমার গবেষণার ক্ষেত্র হলো—প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও অধিকার, এবং নিউ মিডিয়া।

একজন ভারতীয় অধ্যাপকের সঙ্গে একটি বইয়ের প্রকল্পে কাজের সুযোগ পেয়েছিলাম। তারপরই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ অর্থায়নে একটা গবেষণা প্রকল্পে কাজ করি, যেখানে আমিই ছিলাম মূল ইনভেস্টিগেটর।

তথ্য সংগ্রহের টুল, তথ্য বিশ্লেষণের সফটওয়্যার এসপিএসএস, রেফারেন্সিং ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার—এসবের কাজ নিজের তাগিদেই শিখেছি। তবে নবীন গবেষক হিসেবে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও হতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল তহবিল। গবেষণার জন্য কীভাবে তহবিল পাওয়া যায়, কীভাবে ‘আর্থিক প্রস্তাবনা’ লিখতে হয়—এসব বিষয়ে ততটা ভালো ধারণা ছিল না। তা ছাড়া তরুণদের জন্য দেশে গবেষণা তহবিলের সুযোগ খুব একটা নেই। ভালো একটি জার্নালে গবেষণা প্রকাশ করাও বড় চ্যালেঞ্জ। সঠিক নির্দেশনা পাওয়া, পেশাদার সম্পাদনা, স্কলার প্রোফাইল, নিবন্ধ প্রকাশের খরচ—সবকিছু সামাল দেওয়া কঠিন।

দীর্ঘ একটা সময় শুধু সিনিয়রদের কাজ দেখেছি

শামস নাফিসা আলী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়টা তুলনামূলক নতুন। আন্তবিভাগীয় বিষয় হিসেবে এর গবেষণার ক্ষেত্র অনেক বড়। ব্যক্তিগতভাবে সব সময়ই আমি জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার অনুরাগী। তাই স্নাতক পর্যায়ে প্রথম বর্ষ থেকেই স্বপ্রণোদিত হয়ে বিভাগের বিভিন্ন গবেষণামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হতে চেষ্টা করেছি। একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ল্যাবে শুধু সিনিয়রদের কাজ দেখতাম, শিখতাম, তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করতাম। এই অভিজ্ঞতার আলোকে পরে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে সেলুলোজভিত্তিক বায়োম্যাটেরিয়ালের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপ্লিকেশনের ওপর একটি নিবন্ধ লিখি। কাজের সময় দেখেছি, বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুব আন্তরিকভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করে। তবে বাইরের দেশে যেসব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়, দেশে সেগুলো আমরা পাই না। অনেক নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিদেশে পাঠাতে হয়। এতে শুধু গবেষণার গতিই শ্লথ হয়ে যায় না, শিক্ষার্থীরাও সেই অত্যাধুনিক যন্ত্র ব্যবহারের অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়।

শামস নাফিসা আলী

দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষে বায়োফ্লুইড ডায়নামিকস এবং হিট ট্রান্সফারের ওপর কিছু কোর্সে কম্পিউটার সিমুলেশনভিত্তিক বিশ্লেষণ ও গবেষণা সম্পর্কে জানতে পারি। আমাদের সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন—বৃহস্পতি ও শুক্রবার। তাই প্রত্যেক বুধবার রাতে অল্প অল্প করে এ নিয়ে একটু পড়াশোনা শুরু করি। ফলে সিমুলেশনভিত্তিক কিছু কাজের ভাবনাও মাথায় আসে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে ভাবনাটা জানালে তিনিও সহায়তা করেন। টার্ম বিরতি বা মিড ব্রেকের ছুটিতে বন্ধুদের নিয়ে কাজ শুরু করি। এই কাজের ভিত্তিতে ২০২০ ও ২০২১ সালে চারটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করতে পেরেছি। করোনাকালীন স্থবিরতার সময়েও নিজ উদ্যোগে আমরা তিন বন্ধু হৃৎপিণ্ড ও শ্বাসযন্ত্রের শব্দ থেকে রোগ শনাক্তকরণের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম। কয়েক মাসের প্রচেষ্টায় দুটি ‘নভেল নিউরাল নেটওয়ার্ক মডেল’ বানাতে সক্ষম হই। শিক্ষকদের সহায়তায় এই কাজটিও খুব ভালো জার্নালে স্থান পেয়েছে।