রিমালের তাণ্ডবের মধ্যে গহিন সুন্দরবনে আমরা যেভাবে ছিলাম

ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবের মধ্যেও সুন্দরবনের গহিনে বন বিভাগের লোকদের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। দুর্গম টহল ফাঁড়ি শাকবাড়িয়ার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের কাছে ঝড়ের সময়ের গল্প শুনেছেন ইমতিয়াজ উদ্দীন

শাকবাড়িয়া টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম
ছবি: ইমতিয়াজ উদ্দীন

২৬ মে। ভোর থেকেই থেমে থেমে দমকা হাওয়া আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। দুপুরের জোয়ারে আমাদের থাকার ঘরটির পাটাতন ছুঁই ছুঁই পানি উঠে আসে। কাঠের পাটাতনের ওপর টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরটিতে আমরা ছয়জন বনরক্ষী থাকি। সুন্দরবনের অধিকাংশ টহল ফাঁড়ি পাকা হলেও আমাদের শাকবাড়িয়া ফাঁড়ির ভবনের কাজ এখনো শেষ হয়নি।

দুপুরের জোয়ারেই রান্নাঘর ও শৌচাগার তলিয়ে গেল। বিকেলে ভাটার টানে পানি নেমে যাওয়ার কথা, কিন্তু নামল না। ঘরের মালামাল গুছিয়ে খাটের ওপর রেখে দিলাম।

বিকেলে চারদিক অন্ধকার হয়ে এল। বাতাসের বেগও বাড়তে থাকল। তীব্র ঝোড়ো বাতাস আর ভারী বৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল আমাদের ঘরটিই উড়ে যাবে। এরই মধ্যে ঘরের পাটাতনের ওপর দেখি একটি কালকেউটে সাপ গোল হয়ে পেঁচিয়ে পড়ে আছে। ভয়ে শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। কিন্তু নিজের ভয় অন্যদের বুঝতে দিলাম না।

আরও পড়ুন

দেখতে দেখতে রাত নেমে এল। চারপাশ অন্ধকার হয়ে এল। বদলে যেতে থাকল প্রকৃতি। রাত আটটার দিকে প্রবল দমকা হাওয়ার সঙ্গে শুরু হলো টানা বৃষ্টি। ঝোড়ো বাতাসে গাছের ডাল ভাঙার মটমট শব্দে হৃৎপিণ্ড ধকধক করতে থাকে। বাতাসে কাঠের তৈরি ঘরটি দুলতে থাকে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট উঁচুতে ওঠে। পানি পাটাতনের ওপর উঠে আসে। সবাই গুটিসুটি খাটের ওপর উঠে বসি। বনের সবখানে পানি, ঘরের মধ্যেও পানি। ভয় হচ্ছিল বিছানায় না উঠে আসে সাপ।

মনের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল নানা দুশ্চিন্তা। পানি যেভাবে বাড়ছে, খাটের ওপরে উঠে গেলে কোথায় যাব। তার ওপর দাপ্তরিক কাগজপত্র সংরক্ষণ করা জরুরি। ভেবে রেখেছিলাম যদি খাটও ডুবে যায়, তাহলে কাগজপত্র বস্তায় ভরে নিয়ে নৌকায় উঠে পড়ব।

আরও পড়ুন
ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবের মধ্যেও সুন্দরবনের গহিনে বন বিভাগের লোকদের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

বাড়ির কথা মনে হচ্ছিল খুব। মা-বাবা স্বজনদের চেহারা মনের মধ্যে ভেসে উঠছিল। সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকায় মোবাইলের নেটওয়ার্ক থাকে না। তবে আমার ফাঁড়ি থেকে কথা বলা যায়। বাড়ি থেকে বারবার ফোন দিয়ে খোঁজ নিচ্ছিল। টিভিতে তাঁরা দেখছিলেন ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবনের ওপর দিয়ে অতিক্রম করছে। ভেতরের ভয় আর শঙ্কার কথা আমি কাউকে বলিনি। বলেছি আমাদের এখানে ঝড় কম, বনের অন্যদিকে ঝড় হচ্ছে। দূরে থেকে কেউ যাতে দুশ্চিন্তা না করে।

পরদিন সকালে বৃষ্টি আর ঝড়ের তাণ্ডব আরও বাড়ে। চারপাশ ডুবে থাকায় রান্না হয়নি, খাওয়াদাওয়াও বন্ধ। দুপুরের পর কমতে থাকে বাতাস। জোয়ারের পানি অল্প অল্প করে নামতে শুরু করে। জেগে ওঠে রান্নাঘর। কোনো রকমে ডাল-ভাত রান্না করে খেতে বসি।