হাঙ্গেরিতে আমার পড়া-ঘোরা-ওড়া

হাঙ্গেরির ইউনিভার্সিটি অব দেব্রেসেনে ‘প্রফেশনাল পাইলট’ বিষয়ে কোর্স করেছেন শাহীন আলম। হাঙ্গেরিতে কেমন কেটেছে তাঁর ছাত্রজীবন, ভিনদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সে দেশে সুযোগ-সুবিধাইবা কেমন, জানালেন এই নবীন পাইলট

নবীন পাইলট শাহীন আলম
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

মনে হয় এই তো সেদিন এলাম। দেখতে দেখতেই তিন বছরের বেশি সময় পার করে ফেললাম। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এরই মধ্যে পাইলট প্রশিক্ষণের ২০০ ঘণ্টার বেশি উড্ডয়ন শেষ করে ইউরোপিয়ান পাইলট লাইসেন্সও হাতে এসে গেছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের ইতি টানতে হবে। তাই মনে হলো, প্রবাসে আমার ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতাটা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিই।  

কেমন ছিল ছাত্রজীবন

ছোটবেলা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়জীবন নিয়ে যেমন স্বপ্ন দেখে একজন শিক্ষার্থী, আমার হাঙ্গেরির সময়টা তেমনই ছিল। অত্যাধুনিক ক্লাসরুম, দক্ষ শিক্ষক—সবই পেয়েছি। তবে হ্যাঁ, ক্লাসগুলোর দৈর্ঘ্য তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। নিয়মিত ক্লাসে যাওয়ার জন্য গণপরিবহনের ব্যবস্থা আছে। ১৫ থেকে ২০টি দেশের শিক্ষার্থী একসঙ্গে বসে ক্লাস করে, তাই মজা হয় অনেক। নানা দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়। এ ছাড়া ছুটির দিনগুলোতে বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে চা-কফির আড্ডা তো আছেই। বিদেশে পড়তে যাওয়া ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে মা–বাবার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা হলো নিরাপত্তা। হাঙ্গেরিতে অপরাধ কর্মকাণ্ড, সড়ক দুর্ঘটনা ইত্যাদি নেই বললেই চলে। নারীদের জন্য এখানকার শহর বেশ নিরাপদ। একঘেয়েমি কাটানোর জন্য সপ্তাহ শেষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। যেহেতু পরিবার ছেড়ে থাকতে হয়, তাই শিক্ষার্থীরা যেন মানসিক অবসাদে না ভোগে, তার জন্য নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করে কর্তৃপক্ষ।

হাঙ্গেরি শেনজেনভুক্ত দেশ হওয়ায় চাইলেই ইউরোপের যেকোনো দেশে ঘুরতে যাওয়া যায়। হাঙ্গেরিয়ান স্টাডি পারমিটের অধীনে ইউরোপের যেকোনো দেশে ভিসা ছাড়া ঘোরার সুযোগ আছে। আর হাঙ্গেরিতেই এত সুন্দর সব দর্শনীয় জায়গা আছে যে ছুটি পেলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। 

হাঙ্গেরির অনেক শহরে ঘুরেছি। রাজধানী বুদাপেস্ট তার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এখানকার পার্লামেন্ট ভবন বিশ্বের সুন্দরতম স্থাপনাগুলোর একটি। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়ার জন্য আছে বাস, ট্রেন ও আকাশপথ। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে ইউরোপের মোটামুটি সাতটি দেশ—হাঙ্গেরি, জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম, রোমানিয়া, ডেনমার্ক ও অস্ট্রিয়া দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আর পাইলট প্রশিক্ষণের সময় বিমান চালিয়ে স্লোভাকিয়া, রোমানিয়া ঘুরে এসেছি। এককথায় পুরো বিশ্ববিদ্যালয়জীবনটাই একধরনের রোমাঞ্চের মধ্য দিয়ে কেটেছে।

হাঙ্গেরিতেই কেন উচ্চশিক্ষা

হাঙ্গেরির শিক্ষার মান বেশ ভালো। বিশ্বের যেকোনো দেশে হাঙ্গেরির ডিগ্রি গ্রহণযোগ্য। হাঙ্গেরির কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে অনেক ওপরের কাতারে আছে। আমার বিশ্ববিদ্যালয় তার মধ্যে অন্যতম। এখানে ব্যাচেলর, মাস্টার্স, পিএইচডি ও বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদি কোর্স করার সুযোগ আছে। ব্যাচেলর কোর্স সাধারণত তিন থেকে চার বছরের হয়। মাস্টার্স এক থেকে দুই বছর। পিএইচডি/ডক্টরাল কোর্সগুলো তিন-পাঁচ বছরের। বেশির ভাগ স্নাতকের কোর্স হাঙ্গেরিয়ান ও ইংরেজি, দুই ভাষাতেই পড়ানো হয়। স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামগুলোতেও ইংরেজি মাধ্যম রয়েছে।  হাঙ্গেরিতে বহু বিষয়ে পড়ার সুযোগ আছে। সহজেই আপনার পছন্দের বিষয় বা বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে নিতে পারেন। পছন্দের বিষয় অনুযায়ী পড়াশোনার জন্য বছরে ছয় থেকে সাত লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হয়। হাঙ্গেরির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের বৃত্তির সুযোগ দেয়। তার মধ্যে স্টিপেন্ডিয়াম হাঙ্গেরিকাম স্কলারশিপ খুবই জনপ্রিয়, যেটির অধীনে প্রতিবছর ১৩০ জন বাংলাদেশি হাঙ্গেরি আসার সুযোগ পান। আবেদনের জন্য আইইএলটিএসে ভালো স্কোর থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিস্তারিত জানার জন্য দেখতে পারেন এই দুটি ওয়েবসাইট:

studyinhungary.hu ও stipendiumhungaricum.hu

খণ্ডকালীন চাকরি ও খরচ

ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় হাঙ্গেরিতে থাকা-খাওয়া খরচ একটু কম। সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টা কাজের অনুমতিও আছে। খণ্ডকালীন চাকরি করে টিউশন ফি দেওয়া সম্ভব না হলেও থাকা–খাওয়ার খরচের অনেকটাই উঠে যায়। তবে শহরভেদে কাজের সুযোগ কমবেশি হতে পারে। আর কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই হাঙ্গেরিয়ান ভাষা জানাটা খুব কাজে দেয়।

স্থায়ী বসবাসের সুযোগ কি আছে

হাঙ্গেরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই অতিরিক্ত নয় মাসের ভিসা দেওয়া হয়, যেটিকে বলে ‘জব সার্চ ভিসা’। এই সময়ের মধ্যে একজন শিক্ষার্থীকে তার পছন্দের চাকরি খুঁজে নিতে হয়। চাকরি পেয়ে গেলে সে ‘ফুলটাইম ওয়ার্ক পারমিট’–এর আবেদন করতে পারে। কিছু শিক্ষার্থী শেষ বর্ষে থাকাকালে পূর্ণকালীন চাকরির প্রস্তাব পেয়ে যায়। অনেককেই দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে হাঙ্গেরির বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, যেমন নকিয়া, এরিকসন, স্যামসাং, হুয়াওয়েতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। এ ছাড়া আরও অনেক কোম্পানি হাঙ্গেরির বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সরাসরি কাজ করার সুযোগ দেয়, যদি তাদের যথাযথ ভাষাদক্ষতা থাকে। এরপর আইনত পাঁচ বছর থাকলে হাঙ্গেরিতে স্থায়ী বসবাসের জন্য আবেদন করা যায়।