অর্থনীতিতে দ্বিতীয়বারের মতো এল পুরস্কার
বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, সিনিয়র-জুনিয়র থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সবার একই প্রশ্ন, ‘সামি, তোমার পেপার কোথায়?’ একদিকে সেমিস্টার ফাইনালের চাপ, অন্যদিকে ল্যাপটপে তিন হাজার লাইনের কোড রান করার চাপ। তার ওপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোড রান করেও সামান্য ভুল হলেই আবার প্রথম থেকে শুরু করার যন্ত্রণা। এত চাপে দিশাহারা হয়ে পেপার, অর্থাৎ গবেষণাপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমাই পার করে ফেলছিলেন সামি মোহাম্মদ। রাতভর কাজ করে শেষমেশ কোনোমতে গবেষণাপত্র জমা দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন তিনি। তবে ভাবতেও পারেননি, ১৯তম সাউথ এশিয়ান ইকোনমিকস স্টুডেন্টস মিট-এ পেয়ে যাবেন ‘সেন-হক বেস্ট অব দ্য বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড’! তাঁর কল্যাণে দ্বিতীয়বারের মতো এই পুরস্কার এল বাংলাদেশের ঘরে।
প্রতিবছর এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত হয় সাউথ এশিয়ান ইকোনমিকস স্টুডেন্টস মিট, সংক্ষেপে সেসেম। সেসেমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীদের সম্মেলনের পাশাপাশি তাঁদের জন্য থাকে নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন। এ বছর ২১ জানুয়ারি থেকে ২৭ জানুয়ারি সেসেম অনুষ্ঠিত হলো শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে। গবেষণাপত্র প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতা, পলিসি প্রেজেন্টেশন এবং ‘বাডিং ইকোনমিস্ট’ নামে দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা অর্থনীতির শিক্ষার্থী খুঁজে নেওয়ার প্রতিযোগিতা দিয়ে সাজানো এই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ—গবেষণাপত্র উপস্থাপন।
প্রতিবছর ১০টি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে নির্বাচিত শিক্ষার্থীরা গবেষণাপত্র প্রস্তুত ও উপস্থাপন করেন এই সম্মেলনে। এরপর ১০টি বিষয়ের প্রতিটি থেকে সেরা গবেষণাপত্রটিকে দেওয়া হয় ‘বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড’। এবং ১০টি বেস্ট পেপারের মধ্যে ‘বেস্ট অব দ্য বেস্ট’, অর্থাৎ সেরার সেরাটি পায় ‘সেন-হক অ্যাওয়ার্ড’। প্রখ্যাত ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হকের সম্মানে এই পুরস্কারের নামকরণ করা হয়েছে। এ বছর পুরো দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৭০টি গবেষণাপত্রের মধ্য থেকে সেন-হক অ্যাওয়ার্ডটি জিতেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী সামি মোহাম্মদ। এর আগে বাংলাদেশ থেকে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই হাসিবুল হাসান।
এ বছর সেসেমে গবেষণাপত্র লেখার মূল বিষয়বস্তু ছিল জলবায়ু পরিবর্তন। দেশে অভ্যন্তরীণ অভিবাসন কীভাবে বন্যাজনিত ক্ষয়ক্ষতির কারণে প্রভাবিত হয়, কীভাবে অভিবাসীদের আয় ও জীবনমান কমে গিয়ে তাঁদের দারিদ্রের দুষ্টচক্রে বন্দী রাখে, তা-ই গবেষণার জন্য অনুসন্ধান করতে চান সামি। কিন্তু এর পেছনে যেসব তথ্য-উপাত্ত ও কোডিং দরকার, সেদিক থেকে সামি ছিলেন একেবারেই আনাড়ি! কিন্তু তাই বলে তো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায় না! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইকোনমিকস স্টাডি সেন্টার (ইএসসি) ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক সামি। সেই সুবাদে ক্লাব থেকেই আয়োজন করে ফেলেন গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় ‘সার্ভে ডাটা প্রসেসিং’ এর ওপর একটি কর্মশালা। নিজে শেখার পাশাপাশি অন্যদেরও শেখার সুযোগ করে দেন তিনি। নেমে পড়েন কাজে।
১০টি বিষয়ের ওপর বাংলাদেশের ১০ জন স্নাতকের শিক্ষার্থীর গবেষণাপত্র নির্বাচিত হয় সম্মেলনের জন্য। প্রত্যেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী। সামির অর্জন ছাড়াও বাংলাদেশের ঘরে এসেছে বেশ কয়েকটি স্বীকৃতি। সুদীপ্ত রায়ের একটি গবেষণাপত্র পেয়েছে বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড। কুইজোনমিকস নামক কুইজ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দল হয়েছে সেকেন্ড রানার্স আপ। এ ছাড়া ‘বাডিং ইকোনমিস্ট’ প্রতিযোগিতায় চূড়ান্ত পর্ব পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন বাংলাদেশের সাদমান সাকিব রহমান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সেসেমে বাংলাদেশ দলের সমন্বয়ক সায়েমা হক বলেন, ‘গত ২০ বছরে সেসেমের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা গবেষণার বিভিন্ন পদ্ধতি শিখেছে। আশা করব, ভবিষ্যতে তারা আরও ভালো করবে। দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিতে পারবে। এতে আমাদের অর্থনৈতিক অনেক সমস্যা পদ্ধতিগতভাবে ও ব্যবহারিক তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব হবে।’