জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে: নর্থ সাউথের উপাচার্য
গত ২৪ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ ক্রোড়পত্রে লিখেছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য আতিকুল ইসলাম
বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য যা সবচেয়ে জরুরি, তা হলো ভালো শিক্ষক এবং ভালো একাডেমিক প্রশাসক। একাডেমিক প্রশাসক হতে হলে তাঁর একটা লক্ষ্য থাকা দরকার। পাঁচ বছর পর আমি আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কোথায় দেখতে চাই, ১০ বছর পর কোথায় দেখতে চাই, এ লক্ষ্য যদি না থাকে, তাহলে আমি কীভাবে আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নেব?
একটা কথা আমি প্রায়ই বলি, শিক্ষাব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি চাইলে সবার আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কেন? কারণ, কলেজ থেকে যাঁরা বিএ, এমএ পাস করেন, তাঁরাই কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক হন।
আমাদের দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ১৭০টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আপনি যদি শুধু ১৭০ জন উপাচার্য, সহ-উপাচার্য নিয়োগ দিতে চান, তাহলেও আপনার পিএইচডি ডিগ্রিধারী ৩৪০ জন ভালো শিক্ষক ও প্রশাসক লাগবে। এতজন মানসম্পন্ন শিক্ষক-প্রশাসক-গবেষক কি আমাদের আছে? কিংবা ভবিষ্যতের জন্যও কি আমরা তৈরি করছি? ভালো শিক্ষক না পেলে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে হবে? ভালো শিক্ষকদের দিকনির্দেশনাতেই তো আমরা ভালো ছাত্র পাব।
সব বিশ্ববিদ্যালয় কার্যকর কি না, সেটাও ভেবে দেখা দরকার। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগ ছাত্র পাচ্ছে না। ধরুন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের জন্য ৮ থেকে ১০ জন শিক্ষক দরকার। কতজন ছাত্র হলে আপনি ৮ থেকে ১০ জন শিক্ষক রাখতে পারবেন? প্রয়োজনের চেয়ে কমসংখ্যক শিক্ষক দিয়ে যদি আপনি একটি বিভাগ পরিচালনা করেন, তাহলে পাঠদান কিংবা গবেষণা—কোনোটাই ঠিকমতো হবে না। ছাত্র ও শিক্ষকের অনুপাতের সামঞ্জস্য থাকাটা খুব দরকার। আমরা যেমন এখন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীসংখ্যা কমিয়ে ফেলছি। এখন প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষার্থী আছে। আমরা এই সংখ্যা কমিয়ে ২২ থেকে ২৩ হাজারে নিতে চাই। সংখ্যা নয়, মানই হওয়া উচিত প্রধান বিবেচ্য।
ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্বটাও আমাদের বুঝতে হবে। এই যোগাযোগটা হতে পারে দুভাবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ইন্টার্নশিপ করবে, শিখবে। আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবে, শিক্ষার্থীদের জানাবে—বাইরের দুনিয়ায় আসলে কী ঘটছে। আমরা তো চাই, আমাদের শিক্ষার্থীরা পাস করার সঙ্গে সঙ্গে চাকরি পেয়ে যাক। কিংবা চাকরি পাওয়ার পর তাদের খুব বেশি প্রশিক্ষণ দিতে না হোক।
পেশাজীবনে যাঁরা সফল, যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে, তাঁদের নিয়ে এসে ক্লাস পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া দরকার, যেন শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আছেন, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আছেন, সরকারের সচিবরা আছেন, তাঁদের ক্লাসরুমে নিয়ে আসতে হবে। তাঁদের কাছ থেকে শুনতে হবে।
নর্থ সাউথের শিক্ষার্থীদের যেমন ইন্টার্নশিপের অংশ হিসেবে অন্তত ১২ সপ্তাহ ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে হয়; বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যে যেখানে ইন্টার্নশিপ করে, সেখানে চাকরিও পেয়ে যায়। কারণ, চাকরিদাতারা বোঝেন—এই ছেলে বা মেয়েটির আগ্রহ আছে। সে আগ্রহ নিয়ে শিখছে। যেকোনো প্রতিষ্ঠানই নতুন করে কাউকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়ার চেয়ে একজন তৈরি কর্মী চায়। ইন্টার্নশিপ হলো এই তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া।
আমি মনে করি, সিলেবাস তৈরি করার সময়ও ইন্ডাস্ট্রির মানুষের পরামর্শ নেওয়া দরকার। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের কথা ধরা যাক। আমি যদি এখন চারটি ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে বসি, পাঠ্যক্রমে কী থাকলে তাঁদের সুবিধা হবে, সেটা তাঁদের কাছ থেকেই শুনি—তাহলে কিন্তু পাস করার পর ছাত্রদের আর বেকার থাকতে হবে না। এভাবে একাডেমি ও ইন্ডাস্ট্রির সমন্বয়ে পাঠ্যক্রম তৈরি করাটা যেকোনো বিভাগের ক্ষেত্রেই হতে পারে। স্নাতক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের গবেষণার কৌশল ও নিয়মকানুন শেখাতে হবে। তারা বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক প্রকল্প হয়, যেখানে শিক্ষকদের নির্দেশনায় শিক্ষার্থীরা কাজ করে। এসব প্রকল্প থেকে উঠে আসা গবেষণাপত্র বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিতও হয়েছে, হচ্ছে।
স্কুল–কলেজ পেরিয়ে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ভিতটা ভালো না হলে আমাদের কিন্তু আবার নতুন করে অনেক কিছু শেখাতে হয়। এই জায়গায়ও নজর দেওয়া দরকার। স্কুল-কলেজে যা শেখার কথা, সেই শেখাটা যদি যথোপযোগী হয়, তাহলেই তো আমরা শিক্ষার্থীকে আরও এগিয়ে নিতে পারব। ভালো বাংলা লিখতে জানে না, ইংরেজি লিখতে জানে না, বাংলাদেশের ইতিহাস বা সংস্কৃতি সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা নেই—এমন অনেক শিক্ষার্থীও আমরা পাই। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়।
দেশপ্রেম, ধর্মনিরপেক্ষতা—এসবের শিক্ষা শুরু হতে হবে প্রাথমিক স্কুল থেকে, প্রয়োজনে কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে। যেন তাঁরা ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে সবার সঙ্গে মিলে কাজ করতে পারে, সবার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকে।
ভালো শিক্ষক ছাড়া ভালো শিক্ষা সম্ভব নয়। আমাদের ভালো শিক্ষক দরকার। একটা কথা আমি প্রায়ই বলি, শিক্ষাব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি চাইলে সবার আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কেন? কারণ, কলেজ থেকে যাঁরা বিএ, এমএ পাস করেন, তাঁরাই কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক হন। অতএব কলেজের শিক্ষার মান যদি ভালো হয়, কলেজ থেকে উন্নত মানের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হবে। নিয়োগকর্তারাও ভালো মানের কর্মী পাবেন।