কর্মী থেকে নিজেই এখন শতাধিক রেস্তোরাঁর মালিক শামীম, যেখানে কাজ করেন দুই হাজারের বেশি মানুষ
অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে শুরুতে রেস্তোরাঁতেই কাজ করতেন। তারপর নিজেই হয়েছেন উদ্যোক্তা। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ফাস্টফুড চেইন রেস্তোরাঁ ‘সাবওয়ে’র শতাধিক আউটলেট পরিচালনা করেন। এগুলোতে কাজ করেন দুই হাজারের বেশি মানুষ। মোহাম্মদ শামীমের জীবনের গল্প শোনাচ্ছেন কাউসার খান
মেলবোর্নে থাকেন মোহাম্মদ শামীম। সেখান থেকে গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছেন প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরের ব্রিসবেনে। পথে যেতে যেতে ক্যানবেরা আর সিডনির ৪০টি সাবওয়ে আউটলেট পরিদর্শন করছেন। সে কাজ করতে করতেই সিডনিতে যাত্রাবিরতি নিয়েছেন। ১৫ মে সকালে দক্ষিণ সিডনির ক্যাম্পবেল টাউনের একটি ক্যাফেতে তাঁর মুখোমুখি হলাম। পরনে সাদামাটা পোশাক। চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি। আলাপচারিতায় ফুটে উঠল বিনয় আর সংযম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র ছিলেন শামীম। স্নাতক শেষ করার পর থেকেই অস্ট্রেলিয়ায় আসার চেষ্টা করছিলেন। ২০০৭ সালে সেই সুযোগ পেলেন। তত দিনে স্নাতকোত্তর শেষ। অস্ট্রেলিয়ার ডেকিন ইউনিভার্সিটিতে আবার স্নাতকোত্তরেই ভর্তি হলেন, তবে বিভাগ আলাদা—অ্যাকাউন্টিং ও ফাইন্যান্স। পড়াশোনার পাশাপাশি মেলবোর্নেই সাবওয়ের একটি দোকানে খণ্ডকালীন কাজ নেন।
‘সাবওয়ে’ বহুজাতিক ফাস্টফুড চেইন রেস্তোরাঁ। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এটি একটি সাধারণ স্যান্ডউইচের দোকান হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। ‘ইট ফ্রেশ, ফিল গুড’ স্লোগান নিয়ে সাবওয়ে এখন শতাধিক দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। তবে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড অঞ্চলে এটি এখন সবচেয়ে বড় কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ ব্র্যান্ড। যা পরিচালিত হয় ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের মাধ্যমে।
এমনই একজন ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানাধীন আউটলেটে ‘স্যান্ডউইচ আর্টিস্ট’ হিসেবে গ্রাহকের অর্ডার নেওয়া, টেবিল মোছা, মেঝে পরিষ্কারসহ নানা কাজ করতেন শামীম। কয়েক মাস যেতেই মালিকের আস্থা অর্জন করেন তিনি। বললেন, ‘দোকানের মালিক একদিন আমাকে পুরো দায়িত্ব দিয়ে বাইরে গিয়েছিলেন। সব দিক সামাল দিতে গিয়ে মনে হয়েছিল, কাজটা তো আমি পারি।’
সে বিশ্বাস থেকেই সাবওয়ে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। যে মালিকের অধীন কাজ নিয়েছিলেন, তাঁর বেশ কয়েকটি সাবওয়ে দোকানের ফ্র্যাঞ্চাইজি ছিল। দিনে দিনে স্টোর ম্যানেজার হলেন শামীম, তারপর এরিয়া ম্যানেজার। তাঁর কাঁধে তখন বেশ কয়েকটি দোকান পরিচালনার দায়িত্ব।
ঋণ করে শুরু
ডেকিন ইউনিভার্সিটির সহপাঠীদের মধ্যে চীনের ইয়ানান ঝাওয়ের সঙ্গে শামীমের বন্ধুত্বটা একটু বেশিই ছিল। একসময় প্রেমে গড়াল সেই বন্ধুত্ব। ২০০৯ সালে তাঁদের স্নাতকোত্তর শেষ হয়। দূর প্রবাসে দুজনই থিতু হওয়ার চেষ্টায় পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এর মধ্যেই ২০১০ সালে দুজনে বিয়ে করেন।
এর মধ্যে ২০১১ সালে একটি সুযোগ এলো। মেলবোর্নের গ্র্যান্ড হ্যান্ডলিতে সাবওয়ের একটি দোকান বিক্রি হবে। মোহাম্মদ শামীমকেই সেটি কেনার প্রস্তাব দিল সাবওয়ে; কিন্তু এত টাকা শামীম কোথায় পাবেন? স্ত্রী আর বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে আউটলেটটি কেনার সিদ্ধান্ত নিলেন শামীম। তিনি বলেন, ‘তিন লাখ ডলারের বেশি। ব্যাংক থেকে ৭০ শতাংশ ঋণ নিয়েছিলাম। বাকি ৩০ শতাংশ নগদ জোগাড় করতেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পড়েছিলাম। সেটুকু পরিবারের সহায়তা, বন্ধুদের ঋণ ছাড়াও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে উচ্চ সুদে অর্থ জোগাড় করি।’
চাকরি ছেড়ে নিজের আউটলেট গুছিয়ে তোলায় মনোযোগী হলেন শামীম। পাশে থাকলেন স্ত্রী ইয়ানান ঝাও। মাথায় ঋণের বোঝা, দোকান খরচ ছাড়াও আছে সংসারের খরচ। কর্মীর বেতন বাঁচাতে দুজন একাধিক কাজ করে যেতে থাকলেন। দিন–রাত পরিশ্রম করে ফলও পেলেন। আট মাস পর আরেকটি আউটলেট কিনে ফেলেন তাঁরা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হলো না। তিন, চার, পাঁচ করে বাড়তে থাকল আউটলেটের সংখ্যা।
মোহাম্মদ শামীম জানান, তিনি যে মালিকের অধীন পরিচালিত দোকানে কাজ করতেন, তিনি অবসরে গেলে তাঁর ১০টি শাখাও কিনে নেন।
এক বছরেই সেঞ্চুরি
করোনা শুরুর সময় মোহাম্মদ শামীম ২২টি সাবওয়ে আউটলেটের মালিক। তারই একটি ছিল সিডনির গোলবার্নে। কর্মীরা কোভিডে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর এই আউটলেট সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। তার আগেই দোকানটা সংস্কারের পরিকল্পনা করেছিলেন। এই সুযোগে সেই কাজেই হাত দিতে গেলেন; কিন্তু সে সময় জরুরি সেবার গাড়ি ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। ড্রাইভিং লাইসেন্স আগে থেকেই ছিল। সিডনিতে যাবেন বলে নিজেই কয়েক দিনের মধ্যে ট্রাক চালানো শিখে পণ্যবাহী ট্রাক চালানোর লাইসেন্স নিলেন, ‘এরপর প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে নিজেই রওনা দিই।’ সিডনিতে এসে স্থানীয় কর্মী দিয়ে দোকান ঠিকঠাক করলেন। আবার চালু হলো সেই দোকান।
একসময় কারোনাকাল কেটে গেল। অনেকেই তখন সাবওয়ের আউটলেটের মালিকানা ছাড়ছেন। শামীমের ব্যবসার পালে জোর হাওয়া লাগল। সুনামের কারণে ব্যাংকগুলোও ঋণের প্রস্তাব নিয়ে তাঁর কাছে হাজির হলো। একের পর এক আউটলেট কিনতে থাকলেন শামীম। ২০২৪ সালেই আউটলেটের সেঞ্চুরি করেন। এর মধ্যে একবারেই কেনেন ৪২টি আউটলেট। এখন অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে তাঁর মালিকানাধীন ১০৮টি সাবওয়ে আউটলেট। যেখানে কাজ করেন দুই হাজারের বেশি মানুষ। যাঁদের মধ্যে বাংলাদেশি কর্মীও আছেন।
বর্তমানে মোহাম্মদ শামীমের ব্যবসার বার্ষিক টার্নওভার বা লেনদেন ১৫০ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার; যা প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার সমান। সাবওয়ে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড অঞ্চলের ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি অব দ্য ইয়ার ২০২৩’ খেতাব অর্জন করেছেন তিনি।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের স্বপ্ন
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় শামীমের শিকড়। তাঁর মা রহমতুন্নেসা ছিলেন গৃহিণী আর বাবা আবদুস সালাম স্কুলশিক্ষক। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি সপ্তম। পরিবারের প্রায় সবাই দেশেই থাকেন। তাই দুই সন্তান আর স্ত্রী কাছে থাকলেও পরিবারের অন্যদের জন্য মন পড়ে থাকে বাংলাদেশে। তাই বছরে পাঁচ-ছয়বার দেশে আসেন।
গত মাসেও ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবসায়ী দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। বিনিয়োগ সম্ভাবনা দেখতে গেছেন চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের নানা জায়গায়। নিজের দেশকে তাঁর সাপ্লাই চেইনে যুক্ত করতে চান শামাীম। তিনি জানান, প্রতিবছর কন্ডিমেন্ট (খাবার সুস্বাদু করার নানা উপকরণ), রেস্তোরাঁর কাঁচামাল, পোশাক, প্যাকেজিংয়ে তাঁর তিন কোটি ডলার ব্যয় হয়। যা এখন তিনি চীন থেকে সংগ্রহ করেন। বাংলাদেশ থেকেই যা তিনি নিতে পারেন। ইতিমধ্যেই দেশের কিছু সরবরাহকারীর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন শামীম।
নানা বিষয়ে আলাপচারিতায় কখন ঘণ্টা তিনেক পেরিয়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি। এবার বিদায় নেওয়ার পালা। উঠতে উঠতে নিজের মুঠোফোন দেখিয়ে শামীম বললেন, ‘আপনি কি খেয়াল করেছেন, এই দীর্ঘ সময়ে আমার মোবাইলে কোনো কল আসেনি।’
তাই তো, এতগুলো আউটলেট আর কর্মী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যিনি যুক্ত, তাঁর তো হরদম কল আসার কথা! কেন এল না? প্রশ্ন করার আগেই নিজে থেকেই বললেন, ‘আসলে আমি কাজই করি, আমাকে যেন কাজ না করতে হয়, সেটি নিশ্চিত করতে।’
মোহাম্মদ শামীমের মুখজুড়ে সরলতার হাসি।