ব্যাগ বিক্রি করেই কালিন্দীর মাসে আয় আট লাখ টাকা
কারখানা ও উৎপাদন ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের কাশিপুরে কালিন্দীর কারখানা। শুরুতে শুধু বেঁচে যাওয়া পাট ব্যবহার করে ব্যাগ বানাত ব্র্যান্ডটি। বর্তমানে কালিন্দীর প্রতিটি ব্যাগই প্রায় ৭৫ শতাংশ বেঁচে যাওয়া উপাদান ব্যবহার করে তৈরি হয়। ১৩ জন শ্রমিকের হাতের দক্ষতায় তৈরি হয় ব্যাগগুলো। চাহিদা অনুযায়ী মাসে প্রায় ১ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ব্যাগ তৈরি করে কালিন্দী।
২০১৮ সাল থেকে পাটের ব্যাগ বিদেশে রপ্তানি করে আসছে অপরাজেয় লিমিটেড। কারখানায় ব্যাগ তৈরির সময় অব্যবহৃত থেকে যায় অনেক উপকরণ। সেগুলো কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. মনির হোসেন ও তাঁর স্ত্রী মুনিয়া জামান।
সেই ভাবনা থেকেই ২০২১ সালে দেশীয় ব্যাগের ব্র্যান্ড কালিন্দী প্রতিষ্ঠা করেন মুনিয়া জামান। শুরু থেকেই অপরাজেয় লিমিটেডের সহায়ক সংস্থা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে কালিন্দী। বর্তমানে শুধু ব্যাগ বিক্রি করেই প্রতিষ্ঠানটির মাসিক আয় আট লাখ টাকা।
শুরুটা যেমন ছিল
‘পাটের ব্যাগ’ শুনলে সাধারণ মাথায় আসে ঝোলা ব্যাগের কথা। এ ধারণাটাই পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন মুনিয়া। তিনি খেয়াল করে দেখেন, বাংলাদেশের এই সোনালি আঁশ দিয়ে তৈরি খুব সাধারণ ব্যাগগুলোই লুফে নিচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।
বিদেশিরা তাদের নিজস্ব নকশায় তৈরি করে নিচ্ছে পাটের ব্যাগগুলো। অথচ দেশের আঙিনায় পাটের ব্যাগের ক্রেতা নেই। এর একটি বড় কারণ আধুনিকায়নের অভাব এবং একঘেয়ে নকশা।
মুনিয়া বলেন, ‘কী ধরনের পণ্য তৈরি করা দরকার, ক্রেতারা কী চায়, মূল্য নির্ধারণ, পণ্যের মান—এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে এগোলে ক্রেতারা কেনার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করবে।’
নদীর নামে নাম
পাট ও নদী একে অপরের প্রাণ। প্রবাহমান নদীর অববাহিকায় জমে থাকা উর্বর পলি বা দো-আঁশ মাটিতে পাটগাছ চাষ করেন কৃষকেরা। নদীর পানিতে জাগ দেওয়া হয় (পঁচানো) পাটগাছ। তা থেকেই বেড়িয়ে আসে সোনালি আঁশ।
নদীর সঙ্গে পাটের এই নিবিড় সম্পর্কের কারণেই নদীর নামে ব্র্যান্ডের নাম রেখেছেন মুনিয়া। বাংলাদেশ-ভারতের আন্তসীমান্ত একটি নদী কালিন্দী। ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত ঘেঁষে প্রবাহিত হয়েছে।
কালিন্দীর সব ব্যাগের নামও দেশের বিভিন্ন নদ ও নদীর নামে রেখেছেন মুনিয়া। হালদা, আর্চি, চিত্রা, বাউলাই, ইছামতী, লোহালিয়া, রূপসা, ভৈরব, ভদ্রা—এমন আরও অনেক নদীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় কালিন্দীর ব্যাগগুলো।
ব্র্যান্ডটির ওয়েবসাইটে প্রতিটি ব্যাগের ছবি, নাম ও বিস্তারিত বর্ণনার সঙ্গে নদীর বৃত্তান্ত লেখা আছে, জানান মুনিয়া। তিনি বলেন, একটা নতুন নকশার ব্যাগের সঙ্গে যুক্ত হয় একটি করে নদী। অর্থাৎ আমরা যখন ১০০টি নকশা অতিক্রম করব, তখন ওয়েবসাইটে জানা–অজানা ১০০ নদীর বর্ণনা পাওয়া যাবে।
আধুনিকতা
শুরু থেকেই ক্রেতাদের রুচির কথা মাথায় রেখেছেন মুনিয়া। পাটের ব্যাগে এনেছেন আধুনিক নানা নকশা ও রং। ক্রেতাদের চাহিদা ও পরামর্শে নতুন নতুন ডিজাইন আনেন ব্যাগে।
সব বয়সী মানুষের জন্য আনুষ্ঠানিক, ক্যাজুয়াল, পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে এবং ট্রেন্ড অনুযায়ী তৈরি করা হয় নতুন নকশার ব্যাগ। নারীদের জন্য পার্স, হাতব্যাগ ইত্যাদি থেকে শুরু করে পুরুষদের কাঁধের ব্যাগ, মানিব্যাগ এবং সবার জন্য ল্যাপটপ ব্যাগ, ব্যাকপ্যাক আছে কালিন্দীর সংগ্রহে। দেশের বাজারে পাটের ব্যাগের বৈচিত্র্য কম, এমনটাই মনে হয়েছিল মুনিয়ার।
‘পাটের ব্যাগ অল্পস্বল্প যা আছে, তার দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতাদের আগ্রহ কম। মনে হয়েছে, বেঁচে যাওয়া পাট ব্যবহার করে ব্যাগ তৈরি করলে উৎপাদন খরচ কমে আসবে। ভালো মানের উপকরণ দিয়ে তৈরি ব্যাগও তুলনামূলক কম দামে বিক্রি করা যাবে। দেশের বাজারে পাটের ব্যাগের প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরি করতে কিছুটা ফ্যাশনেবল এবং সহজলভ্য করে পাটের ব্যাগ আনতে চেয়েছি। অবশ্য আমরা এখন পাটের ব্যাগের পাশাপাশি চামড়ার ব্যাগও তৈরি করছি’, বলেন মুনিয়া।
২০১৮ সাল থেকে পাটের ব্যাগ বিদেশে রপ্তানি করে আসছে অপরাজেয় লিমিটেড। কারখানায় ব্যাগ তৈরির সময় অব্যবহৃত থেকে যায় অনেক উপকরণ। সেগুলো কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. মনির হোসেন ও তাঁর স্ত্রী মুনিয়া জামান।
সেই ভাবনা থেকেই ২০২১ সালে দেশীয় ব্যাগের ব্র্যান্ড কালিন্দী প্রতিষ্ঠা করেন মুনিয়া জামান। শুরু থেকেই অপরাজেয় লিমিটেডের সহায়ক সংস্থা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে কালিন্দী। বর্তমানে শুধু ব্যাগ বিক্রি করেই প্রতিষ্ঠানটির মাসিক আয় আট লাখ টাকা।
সাফল্য
সম্পূর্ণ দেশি কাঁচামালে তৈরি হওয়ায় কালিন্দীর ব্যাগগুলোর দাম ক্রেতাদের হাতের নাগালে। অল্প দিনেই ক্রেতাদের ভালো সাড়া পেয়েছেন মুনিয়া। তিনি জানান, বর্তমানে কালিন্দীর মাসিক আয় প্রায় আট লাখ টাকা। প্রথমে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিয়ে শুরু করে বর্তমানে নিজস্ব একটি ওয়েবসাইট রয়েছে ব্র্যান্ডটির।
নিজস্ব নকশার ব্যাগের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিশেষ ফরমাশের ব্যাগও তৈরি করে কালিন্দী।
২০২২ সালে ‘যাত্রা’র সঙ্গে সমন্বয় করে কালিন্দী। রাজধানীর বনানীর ‘যাত্রা’র আউটলেট থেকে কালিন্দীর প্রায় সব প্রোডাক্টই দেখে কেনার সুযোগ রয়েছে। মুনিয়া বলেন, ‘শুরুর দিকে ক্রেতারা মান যাচাই করার জন্য দেখে কিনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। এখন অবশ্য অনলাইন–অফলাইন সবভাবেই ক্রেতাদের আস্থার জায়গা তৈরি করতে পেরেছে কালিন্দী।
অনেকেই মনে করেন, দেশি পণ্যের প্রতি আমাদের দেশের মানুষের আগ্রহ কম। উদ্যোক্তা হিসেবে এমনটা কখনোই মনে হয়নি মুনিয়ার। তিনি বলেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুনভাবে কাজ করা গেলে দেশি উপকরণে তৈরি পণ্যকেও জনপ্রিয় করে তোলা সম্ভব। এখন লক্ষ্য একটাই, কালিন্দীর ব্যাগকে ছড়িয়ে দিতে চান দেশের বাইরের ক্রেতাদের হাতেও।