বাজেটের মধ্যে ক্রোকারিজ কিনতে চাইলে যে বাজারে যাবেন
অফিস শেষে সহকর্মী রবিউল ইসলামের বাইকে চেপে ট্রেন ধরব বলে আগারগাঁও মেট্রোরেল স্টেশনের দিকে ছুটছি। উদ্দেশ্য উত্তরা উত্তর স্টেশন হয়ে টঙ্গীর চেরাগ আলী মার্কেট দেশের সবচেয়ে বড় খুচরা ও পাইকারি সিরামিকের তৈরি ক্রোকারিজ পণ্যের বাজার আছে।
মেট্রোরেলে চেপে উত্তরা উত্তর স্টেশন, সেখান থেকে হাউস বিল্ডিং, হাউস বিল্ডিং থেকে চেরাগ আলী মার্কেট। কিন্তু বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব বলে জ্যামের কবলে পড়ে বাস। অগত্যা বাস থেকে নেমে অটোরিকশায় করে জ্যাম এড়িয়ে ভেতরের অলিগলি ধরে ঠিকই পৌঁছে গেলাম চেরাগ আলী মার্কেটে।
চলতি পথের গলিতেই সিরামিকের দোকান দেখে মনে হবে এই বুঝি এসে গেলাম বাজারে। কিন্তু না, মূল বাজার আরও ভেতরে। প্রধান সড়ক থেকে সাহাজ উদ্দিন সরকার আদর্শ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নামফলক টানানো গলি ধরে কয়েক কদম হাঁটলেই হাতের বাঁয়ে ‘আকতার গিফট কর্নার’। এর পরেই পড়বে কাঙ্ক্ষিত বাজারের ১০ নম্বর ফটক।
বাজারের ভেতর বাজার! চেরাগ আলী বাজারের ভেতর আরেক বাজার, নাম ‘শের-ই-বাংলা সিরামিক মার্কেট’। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বাজারের দোকানসংখ্যা এখন পাঁচ শতাধিক।
বাজারের ফটক গলে প্রবেশ করতেই দিশাহারা হওয়ার দশা! সিরামিক পণ্যের এত এত দোকানপাট, আর এত এত ক্রোকারিজ সামগ্রী—এ যেন সিরামিকের রাজ্যে প্রবেশ করেছি!
কেউ বাজার ঘুরে পণ্য কেনায় ব্যস্ত, কেউ পরে নেবেন বলে অগ্রিম ফরমাশ দিয়ে যাচ্ছেন, কেউবা কেনা পণ্য ভালোভাবে প্যাকেটবন্দী করে নিচ্ছেন, কেউবা আবার কেনা পণ্য নিয়ে ফেরার জন্য গাড়ির অপেক্ষায়। গাড়ির অপেক্ষায় থাকা তেমনই কজন নারী বসে বসে পান চিবোতে চিবোতে নিজেদের মধ্যে গল্প করায় ব্যস্ত। মায়া রানী, মিনারা বেগম, রানু, মোমিনাসহ মোট ১৭ জন নারী সদস্যের এই দল এসেছে কুমিল্লার চান্দিনা থেকে। প্রায় ৩৫ বছর ধরে এই বাজার থেকে সিরামিকের পণ্য নিয়ে যান কুমিল্লায়। মূলত গ্রামে বাড়ি বাড়ি হেঁটে ফেরি করে বেড়ান। কেনা পণ্য বিক্রি করা শেষ হলে আবারও দল বেঁধে ঢাকার পথ ধরেন।
কেমন লাভ? এ প্রশ্নের ঝটপট উত্তর, ‘লাব তেমন নাই। কোনরম খাইয়া বাইচ্চা হমান হমান!’
বড় বড় কাগুজে বাক্স—বাক্সের মধ্যে খড় বিছিয়ে অতি যত্নসহকারে পণ্য প্যাকেজিং করা হয়, যাতে পরিবহনের সময় ঝাঁকুনিতে ভেঙে না যায়। এমন পরিপাটি প্যাকেজ নিয়ে ১৭ সদস্যের নারী দলটি পিকআপ ভ্যানে করে কুমিল্লার উদ্দেশে রওনা হলে।
সামনে মক্কা ক্রোকারিজ সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পণ্য কিনতে কালীগঞ্জ সরকারি কলেজের ক্রীড়া শিক্ষক জুবায়ের ইকবাল। খেলায় বিজয়ীদের জন্য পুরস্কার হিসেবে নিলেন পোলাও পরিবেশনের প্লেট, ভাতের প্লেট আর নাশতার প্লেট।
এমনি করে ক্রেতা-বিক্রেতায় থাকে প্রতিটি দোকান। দোকানে ঘুরে ঘুরে পছন্দসই পণ্য বেছে নেওয়ার জন্য একচিলতে জায়গা ছাড়া পুরো দোকানটাই আছে ক্রোকারিজের দখলে। মেঝেতে স্তরে স্তরে স্তূপাকারে যেমন রাখা আছে, আছে চারপাশের দেয়াল ঘেঁষে তাকে তাকে সাজানো সব সিরামিক পণ্য।
নানা রঙে রঙিন
নানা ফুল–পাতার নকশায় ছাওয়া পণ্যে সাদা রঙের আধিক্যটাই যেন চোখে পড়ে বেশি। সাদা রঙের প্রাধান্য যেমন আছে, আছে পাল্লা দিয়ে অন্যান্য রঙে রঙিন সব তৈজসপত্রও। আকাশি নীল, লাল, কালো, হলুদ, বাদামি, খয়েরি, সবুজ ও ধূসরের মতো এক রঙে রাঙা পণ্যগুলোও আপনার নজর কাড়বে। আছে একই পণ্যে অনেক রঙের মিশেলে চমৎকার নকশার উপস্থাপনা।
যা যা মিলছে
এটা না বলে বরং বলা চলে কী নেই এই বাজারে! সবচেয়ে কমন চায়ের কাপ-পিরিচ থেকে শুরু করে পানির মগ, কফি মগ, জগ, ভাত কিংবা পোলাও পরিবেশনের প্লেট, নাশতা পরিবেশনের হাফ প্লেট, তরকারির বাটি, নুডলসের বাটি, ফিরনি, পায়েস, মিষ্টি, দই পরিবেশনের বাটি, সসের বাটি, স্যুপের বাটি, পিৎজা পরিবেশনের জন্য পিৎজা প্লেট, স্যান্ডউইচ পরিবেশনের জন্য স্যান্ডউইচ প্লেট, চা-কফির কেটলি, লিকার রাখার পট, দুধ রাখার পট, চিনি রাখার পট, ট্রে, আছে লবণদানিও।
আকার–আকৃতিতেও আছে বৈচিত্র্য—গোলাকার সিরামিক পণ্য যেমন আছে, আছে বর্গাকার, আয়তাকার, কিনারা ঘেঁষে খাঁজকাটা প্লেটও। আছে বিভিন্ন মাছের আদলে, ফুল ও পাতার আদলে বানানো বাটি, পিৎজা পরিবেশনের জন্য পিৎজা আকৃতির প্লেট, স্যান্ডউইচ পরিবেশনের জন্য স্যান্ডউইচ আকৃতির প্লেট, হাঁড়ি আকৃতির তরকারির বাটি, জগ আকৃতির ফুলের টবসহ অনেক কিছুই। ২৭, ৩১, ৩২ ও ৫২ পণ্যের সমন্বয়ে আছে ডিনার সেট। খাবার টেবিলে যা যা দরকার, সবই থাকে এখানে।
ফেসবুকে পোস্ট-কমেন্ট-রিপ্লাইতে যেসব ইমোজি ব্যবহৃত হয়, আছে সেসবের আদলে বানানো পণ্যও। সিরামিকের বাইরে অল্পবিস্তর কাচের পণ্যও চোখে পড়ে।
যেমন দামে মিলছে
প্রতিটি চায়ের কাপ ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা, ৬টি হিসাবে প্রতি চায়ের কাপ-পিরিচের সেট মিলবে ৬০০ টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। পানির মগ, কফি মগ ১৩০ থেকে ২৫০ টাকা। পানির জগ ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা। জুস পরিবেশনের চ্যাপ্টা জগ ১ হাজার ২০০ টাকা।
ভাত পরিবেশনের প্লেট প্রতি ডজন ২ হাজার ১০০ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা। পোলাও পরিবেশনের প্লেট ৬০০ থেকে ১ হাজার টাকা। পোলাও, রোস্ট, মাংস বা স্যুপ রাখার ঢাকনাসহ বড় পাত্র কেসারল ১ হাজার ৫০০ টাকা। সালাদ, পেঁয়াজ, মরিচ, লেবু বা স্রেফ নাশতা পরিবেশনের হাফ প্লেট প্রতি ডজন ১ হাজার ৪৪০ টাকা ২ হাজার ১০০ টাকা। ৭, ৮ ও ৯ ইঞ্চি ব্যাসের ৩টি বাটির সেট ৬০০ টাকা, ৬টি ছোট ও ১টি বড় মিলে ৭ পিসের তরকারির বাটির সেট ১ হাজার ১৫০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা। ৯ ইঞ্চি ব্যাসের বাটি প্রতিটি ৪০০-৯০০ টাকা। হাঁড়ি–পাতিলের আদলে বানানো তরকারির বাটির সেট ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। ঢেউখেলানো চ্যাপ্টা বাটি ৩০০ থেকে ৯০০ টাকা। ৪টি ছোট ও ১টি বড় মিলে ৫ পিসের ফিরনি, পায়েস, মিষ্টি, দই, নুডলস বা স্যুপের বাটির সেট ১ হাজার ২৫০ টাকা। পিৎজা প্লেট ৮০০ টাকা, স্যান্ডউইচ প্লেট ১৭৫ টাকা। ৩টি সসের বাটির সেট ৫৫০ টাকা। চা-কফি পরিবেশনের কেটলি, দুধ রাখার পট ও চিনি রাখার পট মিলে সেটের দাম ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৮৫০ টাকা।
ফরমাশে সিরামিকের পণ্য
মক্কা ক্রোকারিজের বিক্রেতা মারুফ ইসলাম দেখাচ্ছিলেন দোকানের এক পাশে থাকা ফরমাশে বানানো উপহারসামগ্রী। মারুফ ইসলাম জানান, ব্যক্তিপর্যায়ে জন্মদিন বা তেমন বিশেষ দিন উপলক্ষে, স্কুল–কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার হিসেবে, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে, বছরের প্রথম দিনে বা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে উপহার দেওয়ার জন্য ফরমাশ আসে এখানে। পছন্দসই মগ বা স্মারক প্লেট নির্বাচন করে দিলে তাতে ওঠে স্মারক কথামালা, ছবি কিংবা প্রতিষ্ঠানের লোগো। যত বেশিসংখ্যক বানানো যাবে, তত খরচের হার কমে আসবে। সাধারণত ৫০টির কম ফরমাশ নেওয়া হয় না। নির্বাচিত মগ বা প্লেটের দামের সঙ্গে রং, নকশা, লেখা ও লোগোর আকার বিবেচনায় আরও যোগ হয় ২৫ থেকে ৫০ টাকা।
আলাদিনের চেরাগের আদলে গড়া দুধ রাখার পট ৪৫০ টাকা, চিনি রাখার পট ৩০০ টাকা, কেটলি ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা। খাবার পরিবেশনের ছোট ট্রে ২০০ টাকা, হাতলসহ সিরামিকের বড় ট্রে ১ হাজার ২৫০ টাকা।
রুই ও রুপচাঁদা মাছের আদলে বানানো বড় বাটি ৮৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা, সূর্যমুখী ফুলের আদলে বানানো বাটি ৪৫০ টাকা, পিৎজা আকৃতির প্লেট ৮০০ টাকা, স্যান্ডউইচ আকৃতির ত্রিভুজাকার প্লেট ১৫০ টাকা। ফুলের টব ছোট ৮০ থেকে ২৫০ টাকা। কাপড় বা প্লাস্টিকের ফুলসহ ফুলের টব বড় ৪৭০ টাকা আর ফুল ছাড়া ৩২০ টাকা।
ডিনার সেটের দাম জানাচ্ছিলেন মেসার্স সেলিম ক্রোকারিজ স্টোরের বিক্রেতা মো. সাগর। সাগর ও তাঁর পরিবার প্রায় ২৫ বছর ধরে ব্যবসা করছেন এখানে।
২৭ আইটেমের ডিনার সেট ৩ হাজার ৫০০ টাকা থেকে শুরু, ৩১ আইটেমের ডিনার সেট ৫ হাজার ৫০০ টাকা থেকে শুরু, ৩২ আইটেমের ডিনার সেট ৬ হাজার ৫০০ থেকে ১৭ হাজার ৫০০ টাকা, ৫২ পণ্যের ডিনার সেট মিলবে ৮ হাজার ৫০০ থেকে ৪০ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে।