বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা কেমন আছেন এই শীতে

বঙ্গবাজারে শীত মৌসুম এলেই জমজমাট হতো বেচাকেনা
ছবি : সাবিনা ইয়াসমিন

‘আমরা অনেক ভালা আছি। বেজ্ঞুনে আমরা ভালা আছি। আমগো আর খবর নিয়া কী হইব? এত মানুষের কোটি কোটি টাকা পুইড়া ছাই হইছে, আমার পুড়ছে ৩ কোটি টাকা! কেউ ১ টাকাও অনুদান দেয় নাই, সাহায্য করে নাই। এহন এই বাঁশ আর তেরপালের নিচে সব পুঁজি শ্যাষ কইরা কোনোমতে প্যাট চালাইতাছি।’ এভাবেই মনের ক্ষোভ ঝেড়ে নিজের অসহায়ত্বের কথা বলছিলেন বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ী মতিন মিয়া। ১২ বছর ধরে তিনি এই এলাকায় ব্যবসা করছেন।

পাইকারি ও খুচরা—দুই ধরনের কেনাবেচা চলে এখানে
ছবি : সাবিনা ইয়াসমিন

প্রতিবছর শীত মৌসুম এলেই বেচাকেনায় জমজমাট হয়ে ওঠে বঙ্গবাজার। পাইকারি ও খুচরা—দুই ধরনের কেনাবেচা চলে এখানে। গত বছর ৪ এপ্রিল পবিত্র রমজান মাসে আগুনে পুড়েছে গোটা বঙ্গবাজার। তখন ঈদ উপলক্ষে অনেক ব্যবসায়ী আগুন লাগার আগের দিন নতুন পোশাক তুলেছিলেন দোকানে। তবে কে জানত, পরদিন সকাল থেকে তাঁদের জীবনচিত্র এভাবে পাল্টে যাবে!

নিত্যকার খরচ ওঠানোর আশায় শীতকালীন নতুন নতুন পোশাক তুলেছেন দোকানিরা
ছবি : সাবিনা ইয়াসমিন

বঙ্গবাজারের মালিহা ট্রেডার্সের মুজিবর রহমান বললেন, ‘বাড়ি নদীর ওপার, আগুন লাগার খবর পেয়ে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে আসতে আসতে সকাল সাড়ে সাতটা। রাতে ঈদ উপলক্ষে সাড়ে চার লাখ টাকার নতুন মালামালের গাদাগুলো দোকানেই তালা মেরে রেখে গেলাম, সকালে এসে তালা খুলে দেখি, সব পুড়ে একাকার! ক্যাশ কাউন্টারের বান্ডিলের টাকাগুলা তেমনই ছিল, ধরতে গিয়ে সব ছাই পাইলাম!’ সাত সদস্যের পরিবারে উপার্জনক্ষম শুধু তিনি। কলেজপড়ুয়া ছেলের সাহায্যে ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু এখন শোচনীয় এই অবস্থায় পড়ে ছেলের পড়াশোনাও বন্ধ। স্ত্রী, সন্তান আর মাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন গ্রামের বাড়ি। কেননা এই অল্প আয়ে পরিবারসহ ঢাকায় থেকে খরচ কুলাতে পারছেন না।

বঙ্গবাজারের দোকানগুলোর ওপর এখন প্লাস্টিকের ছাদ
ছবি : সাবিনা ইয়াসমিন

ঢাকার বিখ্যাত বঙ্গবাজার আট মাস আগের ঘটে যাওয়া বিশাল অগ্নিকাণ্ডের ছাপ বয়ে বেড়াচ্ছে এখনো। একসময়ের সাজানো-গোছানো পরিপাটি দোকানগুলোর ওপর এখন প্লাস্টিকের ছাদ আর নিচে চৌকি পাতা, সীমানাটা বাঁশ দিয়ে ঘেরা, তার মধ্যখানে একটা আসন! এবারের শীত মৌসুমে বঙ্গবাজারে বরাবরের মতো রমরমা আয়োজন না থাকলেও নিত্যকার খরচ ওঠানোর আশায় শীতকালীন নতুন নতুন পোশাক তুলেছেন দোকানিরা। চৌকির ওপরই থরে থরে সাজিয়েছেন শীতের নতুন পোশাক। দাম হাঁকছেন পাইকারি কিংবা খুচরা হিসাবে। তবু প্রতিকূলতার যেন শেষ নেই। শীতের আগের কয়েক দফা ঘূর্ণিঝড় আর বৃষ্টিময় আবহাওয়ার কারণে এখন শুধু ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে আর হচ্ছে না। কখনো চলতি পথে বা কখনো সাজানো মালামালের ওপরেই ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে বৃষ্টি।

ত্রিপল টাঙিয়ে অস্থায়ী দোকান বানিয়ে এখন ব্যবসা চলছে।
ছবি : শুভ্র কান্তি দাশ

১৮৪৫-৪৬ নম্বর দোকানের বিল্লাল হোসেন ১৩ কোটি টাকার ব্যাগ আর প্রসাধনসামগ্রী দিয়ে পরিপূর্ণ করেছিলেন দোকান। দুজন কর্মী আর ভাইসহ দোকান চালাচ্ছিলেন বেশ। তবে অগ্নিকাণ্ডের পর কয়েকটি ব্যাগ ছাড়া আর কিছুই বাঁচাতে পারেননি। এখন কর্মী ছাঁটাই করে শেষ সম্বল দিয়ে আবার মালামাল কিনে আগের জায়গাতেই গড়ে তুলেছেন বাঁশ-চৌকির নতুন দোকান। নিজেই খেটে চলছেন কখনো মালিক হিসেবে কখনো-বা কর্মীরূপে।
সর্বস্ব হারিয়ে যেখানে অনেক ব্যবসায়ী জীবিকা নির্বাহে ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন, সেখানে অনেকে আবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে হওয়া সংঘর্ষে মামলায় জড়িয়ে খাটছেন জেল। আর যাঁরা আবার স্বল্প পুঁজিতে দোকান খুলেছেন, নতুন মালামাল তুলেছেন ভালো বিক্রির আশায়, সেখানেও লাগাতার হরতাল-অবরোধের কারণে বেচাকেনা হচ্ছে মোটামুটি। রাজধানীর আশপাশের জেলার পাইকারি ক্রেতারা ঢাকায় আসতে পারছেন না বলেই এমন পরিস্থিতি।
যেখানে প্রতিবছর শীতে দেশি-বিদেশি ক্রেতার আনাগোনায় মুখর হয়ে উঠত বঙ্গবাজার, সেখানে এবার দোকানিদের রোজকার খরচ ওঠানোই যেন দায় হয়ে গেছে!