মাতৃভাষার বিলুপ্তি ঠেকাতে সাদরিতে বই লিখেছেন যোগেন্দ্রনাথ

যোগেন্দ্রনাথ সরকার ওঁরাও জনগোষ্ঠীর মানুষ। কলেজে শিক্ষকতা করেন। মাতৃভাষার বিলুপ্তি ঠেকাতে সাদরিতে লিখেছেন বই। বিপদে–আপদে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ ও তাড়াশ উপজেলার অন্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরাও তাঁকে পাশে পান। যোগেন্দ্রনাথের আরও গল্প জানেন সাজেদুল আলম

নিজের লেখা বই হাতে যোগেন্দ্রনাথ সরকার (বাঁয়ে)
ছবি: সংগৃহীত

১৯৯১ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে একটা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় যোগ দেন যোগেন্দ্রনাথ সরকার। কর্মস্থল সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ ও তাড়াশ উপজেলা। দায়িত্ব পান ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জীবনমান উন্নয়নের। কাজ শুরু করে সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিবিড়ভাবে দেখেন। নিজে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। মূলধারায় মিশেছেন বলে নিজেকে এগিয়ে নিয়েছেন অনেকটা। কিন্তু রায়গঞ্জ ও তাড়াশের চিত্র ভিন্ন। এখানকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ কালে কালে আরও পিছিয়েছে। নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলেছে। তরুণ যোগেন্দ্রনাথকে বিষয়টা খুব ব্যথিত করে। বুঝতে পারেন, সমস্যার সমাধানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। ভাবেন, শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হতে পারলে জনগোষ্ঠীর মানুষদের এগিয়ে নেওয়ার কাজটি ভালোভাবে করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো আটকে আছেন চাকরিতে।

পেশাবদল

যোগেন্দ্রনাথ সরকারের প্রথম চাকরিটা ছিল সিরাজগঞ্জ জেলা আদিবাসী বহুমুখী উন্নয়ন সংস্থায়। এরপর যোগ দেন ব্র্যাকে। প্রতিষ্ঠান ও পদ পরিবর্তন হলেও কাজের ধরন ও দায়িত্ব অনেকটা একই—ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের অবস্থার উন্নয়ন। কিন্তু ধরাবাঁধা চাকরি করে মানুষকে কতটুকু সহযোগিতা করা যায়! সিদ্ধান্ত নিলেন চাকরি ছেড়ে দেবেন।

১৯৯৫ সাল। স্থানীয়দের উদ্যোগে রায়গঞ্জে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলো। খবরটা কানে যেতেই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন যোগেন্দ্রনাথ। কলেজ কমিটিও তাঁর মতো একজনকেই চাচ্ছিল। বেসরকারি সংস্থার চাকরি ছেড়ে দিলেন যোগেন্দ্রনাথ। অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে যোগ দিলেন নিমগাছি কলেজে। শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজ সম্প্রদায়ের অনগ্রসর মানুষের জন্য সেবামূলক কাজেও যুক্ত হন। জড়িয়ে পড়েন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায়।

ওঁরাও শিক্ষার্থীরা এখন মাতৃভাষায় বই পড়ার সুযোগ পেয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

‘হামার বই হাম মায়কের ভাষানে পাড়বেই’

ওঁরাও জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার নাম ‘সাদরি’। বর্ণমালা না থাকলেও নিজেদের রোজকার কথাবার্তায় সাদরি ব্যবহার করেন ওঁরাও মানুষেরা। তবে নতুন প্রজন্ম নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি ভুলতে বসেছে। যোগেন্দ্রনাথ সরকারের মনে দুশ্চিন্তা, ‘আমাদের ভাষা এভাবে হারিয়ে যাবে?’

যোগেন্দ্রনাথ সরকারের সঙ্গে যুক্ত হলেন ওঁরাও জনগোষ্ঠীর আরও কয়েকজন সমমনা মানুষ। নিজেরা বসলেন, কী করা যায়, সলাপরামর্শ করলেন। সিদ্ধান্ত হলো ওঁরাওদের এগিয়ে নিতে বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। তাই হলেন তিনি। এসব সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার প্রসারে কাজ শুরু করলেন।

২০০৪ সাল নিজেও প্রতিষ্ঠা করলেন একটি সংগঠন, নাম ‘ওঁরাও ফাউন্ডেশন’। সংগঠনের কাজ রায়গঞ্জ এবং তাড়াশ উপজেলার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের পাশাপাশি অনগ্রসর পরিবারের উন্নয়ন, ওঁরাও জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা। সংগঠন থেকে ‘আদিবাসী শিক্ষানিকেতন’ নামে একটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করলেন। রাতের বেলায় স্কুলশিক্ষার্থীদের সেখানে মাতৃভাষায় পাঠ্যবই পড়ানো হয়।

যোগেন্দ্রনাথসহ কয়েকজনের প্যানেল মাতৃভাষায় বইও লিখলেন। বেসরকারি সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’–এর সহযোগিতায় ২০১০ সালে প্রাক্–প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথম বই প্রকাশ করেছেন তাঁরা। ‘হামার বই হাম মায়কের ভাষানে পাড়বেই’ (আমার বই আমি মায়ের ভাষায় পড়ব) স্লোগানে আন্দোলনও চালিয়েছেন। সে সময় প্রাক্‌–প্রাথমিকের চারটি ও প্রাথমিকের জন্য ১২টি বই বের করেন তাঁরা। ২০১২ সালে সরকারিভাবেই সাদরি ভাষায় বই সরবরাহ করা হয়। সাদরি ভাষার লেখক হিসেবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) যুক্ত আছেন যোগেন্দ্রনাথ সরকার। সরকারি বইগুলো তাড়াশ ও রায়গঞ্জের ১২টি গ্রামের ১৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবে এ উদ্যোগ ফলপ্রসূ হচ্ছে না।

যোগেন্দ্রনাথ সরকার
ছবি: সংগৃহীত

পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও সাদরি ভাষায় বই লিখেছেন যোগেন্দ্রনাথ। ২০১৭ সালে প্রকাশ করেছেন ওঁরাও লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি নামের গবেষণামূলক একটি বই। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ, তাঁর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ তিনি সাদরি ভাষায় অনুবাদ করেছেন।

বই রচনার পাশাপাশি জনগোষ্ঠীর মেধাবীদের এগিয়ে নিতেও কাজ করছেন। তাঁর মাধ্যমে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের অনেকে মেডিকেল কলেজসহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। অনেকে কর্মজীবনেও প্রবেশ করেছেন। এসব সহায়তার কাজে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তা পেয়েছেন।

কৈগ্রামের মানুষ

চলনবিলের গাঘেঁষা এলাকা কৈগ্রাম। একসময় প্রচুর কই মাছ পাওয়া যেত বলেই এমন নাম। নাটোরের সিংড়া উপজেলার এই গ্রামেই যোগেন্দ্রনাথ সরকারদের বাড়ি। এখানে ওঁরাও জনগোষ্ঠীর কয়েক ঘর মানুষের বাস। তাঁদের কেউ কৃষিজীবী, কেউ দিনমজুর। যোগেন্দ্রনাথের বাবা বীরেন্দ্রনাথ সরকার সমাজসচেতন মানুষ ছিলেন। পার্শ্ববর্তী জমিদারবাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তাঁর। যোগেন্দ্রনাথদের ভাইবোনদের ওপরও পড়েছিল সেই প্রভাব। সমবয়সী ওঁরাও শিশুরা যখন মাঠেঘাটে কাজ শুরু করে, যোগেন্দ্রনাথ তখন বই হাতে ছোটেন বিদ্যালয়ে। অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকার এই মনোভাব তাঁকে পড়াশোনায় উৎসাহিত করে। ফলও পান। ১৯৮০ সালে এসএসসি ও ১৯৮২ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন অর্থনীতি বিষয়ে।

রায়গঞ্জ-তাড়াশে এসেছিলেন চাকরিসূত্রে। দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় কাজ করছেন। অনেকে তাঁকে এখানকার মানুষ মনে করে। যোগেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, ‘বিষয়টা আমি উপভোগ করি। এ এলাকায় নিজের জনগোষ্ঠীসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি। কতটুকু করতে পারছি, জানি না। তবে কাজ করে নিজে আনন্দ পাই।’