শিক্ষকের পর এবার সেরার স্বীকৃতি আনলেন ছাত্র

বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন শোভন সাহা
ছবি: সংগৃহীত

গত ২১ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে হয়ে গেল টেকসই উন্নয়নে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিবিষয়ক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে অগ্রগতির মাধ্যমে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গঠন’। সম্মেলনে ১৬টি দেশ থেকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যবসা, কৃষি, শিল্প এবং আধুনিক নগরায়ণ বিষয়ে ২৮৭টি গবেষণা প্রবন্ধ জমা পড়ে। তার মধ্যে সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয় ১০০টি প্রবন্ধ। সেরা হিসেবে ‘বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেছে ‘সিমুলেশন অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্ট ডেটা মাইনিং ফর মলিকুলার ট্রান্সপোর্ট থ্রু মাল্টিপোল ন্যানোপোরস ইন অ্যান ইলেকট্রোপোরেটেড জায়ান্ট ইউনিলামেলার ভেসিকেল’।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খোরশেদ আলম ও বাংলাদেশ প্রকৌশলপ্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু সায়েমের তত্ত্বাবধায়নে গবেষণাটি পরিচালনা করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শোভন সাহা। গবেষণাটির সঙ্গে আরও যুক্ত ছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইফ ইশতিয়াক।

এই গবেষণায় যা আছে

শোভন সাহার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এ গবেষণায় কী আছে? তিনি বলেন, ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইলেকট্রোপোরেশন উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। স্বাস্থ্যসেবা এবং বায়োমেডিসিনের বিভিন্ন দিকে এটি বিপ্লব নিয়ে এসেছে। জেনেটিক ব্যাধি, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া রোগ এবং নির্দিষ্ট ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য নতুন পথ খুলে দিয়েছে। ক্যানসার কোষকে নির্মূল করার জন্য ইলেকট্রোপোরেশনের মাধ্যমে ইমিউন কোষের (যেমন টি কোষ) পরিবর্তন এবং পুনর্প্রোগ্রামিং করা সম্ভব। ইলেকট্রোপোরেশনের মাধ্যমে ইলেকট্রিক শক দিয়ে ক্যানসার বা অনিয়ন্ত্রিত কোষকে অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে ধ্বংস কিংবা ছিদ্র করে দেওয়া হয়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বায়োটেকনোলোজি এবং ফার্মাসিউটিক্যালসের ওষুধ ডেলিভারি সিস্টেম আরও কার্যকর এবং সুলভ করা সম্ভব হবে। জিনথেরাপি করে সম্ভাব্য ক্যানসার চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া ইলেকট্রোপোরেশনকে একত্র করে, টিউমারের চিকিৎসায় কিছু ওষুধের কার্যকারিতা বাড়ানো সম্ভব হবে। আমরা কী হারে এই মলিকিউল বাইরে থেকে ভেতরে যাবে, ক্লিনিক্যালি কত সময় পর্যন্ত থেরাপি দিতে হবে, কত সময় পর সিস্টেম সম্পৃক্ত হয়ে যাবে—এসব ১০ দশমিক ০০৮ মাইক্রোমিটার ব্যাসের একটা কোষের জন্য সিমুলেশন করেছি। এই একটা কোষে আমরা ২০ ন্যানোমিটারের ৮টি ছিদ্র নিয়ে কাজ করেছি। সিস্টেম ডিজাইনের জন্য আমরা অটোক্যাড ২০২৪, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কমসোল মাল্টিফিজিকস ৬ দশমিক ১ এবং উপাত্ত বিশ্লেষণ করার জন্য অরিজিন প্রো ও অরেঞ্জ ইত্যাদি সফটওয়্যার ব্যবহার করেছি।’

শোভন সাহা বলছিলেন, ‘বরাবর আমি ব্যাকবেঞ্চার ছিলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়জীবন রংধনুর মতো সাত রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে। এর একমাত্র কারণ বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে এমন একজন শিক্ষককে কাছে পেয়েছি, যিনি আমাকে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সবকিছু শিখিয়েছেন। প্রচণ্ড ব্যস্ততা সত্ত্বেও আমি ও আমাদের টিমকে অনুপ্রেরণা দেওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজ সফলভাবে করার জন্য সব দায়িত্ব অকপটে নিজেই পালন করেছেন। এ জন্য ব্যর্থতা আমাদের ছুঁতে পর্যন্ত পারেনি। সেই ব্যক্তিটি হলেন, আমাদের প্রিয় শিক্ষক খোরশেদ আলম। এই অর্জন তাঁকেই আমরা উৎসর্গ করতে চাই। আমি জানি আমাদের স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে, তবে এখন আমরা আত্মবিশ্বাসী যে জার্নিটা আমরা সফলভাবে চালু রাখতে পারব।’

শিক্ষকের পর এবার ছাত্র

২০২১ সালে বায়োমেমব্রেন নিয়ে গবেষণা করে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বেস্ট পোস্টার অ্যাওয়ার্ড জেতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল। নেতৃত্বে ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খোরশেদ আলম। এবারও তাঁর তত্ত্বাবধানে আরেকটি গবেষণা প্রবন্ধ বেস্ট পেপারের স্বীকৃতি পেল। প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমি মনে করি, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে গবেষণাকর্ম। কলেজে শুধু তাত্ত্বিক বিষয় পড়ানো হয়, আর বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাই মুখ্য। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার গড়ে ওঠেনি। তবে চেষ্টা অব্যাহত আছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। আশা করি, অচিরেই এই বিশ্ববিদ্যালয় নানা ক্ষেত্রে নতুন নতুন গবেষণার দ্বার উন্মোচন করবে।’

এর আগে ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে গবেষণায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ইলিয়াস মাহমুদ। তিনি আধা পাকা টয়লেট থেকে ভূগর্ভস্থ পানিদূষণ কীভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করেন। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি (এসিএস) থেকে প্রকাশিত গবেষণা পত্রিকা এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি-তে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রবন্ধ। গবেষণাকর্মটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক একাডেমিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা ‘নেচার’ পরিচালিত ‘নেচার ইনডেক্স ২০২০’-এ স্থান পায়। ৮২টি গবেষণাপত্রের মধ্যে সেরা বিবেচ্য হয় গবেষণাপত্রটি।

আরও পড়ুন

এসব অর্জনকে অভূতপূর্ব উল্লেখ করে খোরশেদ আলম বললেন, ‘নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কিছু করার চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। আমার টিমের সদস্য ও ছাত্র শোভন সাহার প্রচণ্ড আগ্রহ ও আত্মবিশ্বাসের কারণেই এত বড় ফোরামে দেশ-বিদেশের শতাধিক পেপারের মধ্যে বেস্ট পেপারের স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা আমাদের অনুপ্রাণিত করবে এবং আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে।’

প্রতিষ্ঠার পর এক যুগ পার হলেও এখনো বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আশানুরূপ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়নি। এরপরও দক্ষিণের এই নবীন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিজস্ব আগ্রহে কয়েকটি গবেষণা দেশ এবং দেশের বাইরে সাড়া ফেলেছে। এনেছে স্বীকৃতি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক যুগ পার করেছে কীর্তনখোলার তীরে গড়ে ওঠা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। এই ১২ বছরে নানা চড়াই-উতরাই আর সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যায়ের ক্যাম্পাসটি মনোমুগ্ধকর হলেও এখনো পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। এসবের মধ্যেই পড়াশোনা চালিয়ে নিতে হচ্ছে। বেশি ভোগাচ্ছে আবাসন, ক্লাসরুম, শিক্ষক, পরিবহন ও গ্রন্থাগারে বইয়ের সংকট। পাশাপাশি গবেষণা কার্যক্রমও সীমিত। যা-ও হচ্ছে তা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-আগ্রহে। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ১৬ দেশের ১০০ প্রবন্ধের সেরা হওয়ার স্বীকৃতিকে তাই দারুণ ইতিবাচক ঘটনা মনে করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

আরও পড়ুন