দলেবলে গ্রামীণ আবহে এই বাড়িতে কাটাতে পারেন সারা দিন
‘বৃষ্টিতে অন্য রূপ দেখতে পাবেন।’ আমিনা হকের এ কথায় আর পরিকল্পনা বদলাইনি। গত ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে টানা বৃষ্টি আর মাঝেমধ্যে ঝোড়ো বাতাস। এরই মধ্যে আমরা পাঁচজনের একটি দল রওনা হলাম। ঢাকা থেকে এক ঘণ্টারও কম সময়ে পৌঁছে গেলাম।
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার কোলা ইউনিয়নের নন্দনকোনা গ্রামের শীলবাড়ির হেঁশেলের সামনে যখন পৌঁছালাম, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। একদমই গ্রামীণ আবহ। গাছগাছালিতে ছাওয়া একটি বাড়ি। ঢোকার মুখেই কৃষ্ণচূড়া। কংক্রিটের স্লাব ফেলা পথ ধরে গিয়ে উঠলাম শীলবাড়ির হেঁশেলের বৈঠকখানায়। ছোট্ট পুকুরের পাড়ে টিনের চালে ছাওয়া কাঠের ঘর। বড় জানালা, কোথাও আবার কাচের দেয়াল। বিক্রমপুর অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি ঘরখানা।
হাসিমুখে স্বাগত জানালেন শীলবাড়ির হেঁশেলের উদ্যোক্তা আমিনা হক। কাঠের মেঝে। ইতিউতি বেঞ্চ, সোফা আর বড় বড় কুশনে বসার জায়গা। ঘরের নানা কোণে, টেবিলে ফুলদানি, মাটি বা কাঁসার বড় বড় পাত্রে জলে ভাসা ফুল—গাঁদা, গোলাপ, জারবারা। বড় কয়েকটা মোমের আলো তৈরি করেছে মায়াবী পরিবেশ। একে একে খাবার নিয়ে এলেন হেঁশেলের কর্মীরা। কাঁসার থালার ওপর কলাপাতা বিছিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে খাবার। এল পাটশাকের বড়া, পাটিসাপটা পিঠা, আনারস, পেয়ারা আর মুন্সিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ছিটা রুটি, সঙ্গে দেশি মুরগির তরকারি। আমিনা হক জানিয়ে দিলেন, পাটশাক নিজেদের জমিতে চাষ করা, মুরগি গ্রামের, রান্না হয়েছে মাটির চুলায়। বৈঠকখানার ছোট্ট বারান্দায় দুটি কাঠের বেঞ্চ। নিচেই পুকুরের পানি। এদিকে টিনের চাল বেয়ে ঝরছে বৃষ্টির জল।
শীলবাড়ির হেঁশেল আসলে কী? রিসোর্ট? নাকি রেস্তোরাঁ? কারণ হেঁশেল মানে তো রান্নাঘর। তাহলে কি এটা রেস্তোরাঁ? উত্তরটা হলো দল বেঁধে একটা দিন, তিনবেলা কাটানোর গন্তব্য শীলবাড়ি। আমিনা হক চান, ‘বাড়িটা সবার আনন্দের কারণ হোক।’ ১০৫ কাঠা জমির ওপর গড়ে ওঠা শীলবাড়ির হেঁশেলে দাদার বাড়ি, নানার বাড়িতে যাওয়ার অনুভূতি নিয়ে পুরো একটা দিন কাটানোর ব্যবস্থা রয়েছে। আমিনা হক বললেন, ‘গোছানো সুন্দর সময় কাটাতে একটা বাগানবাড়ির শখ অনেকেরই থাকে। গ্রামের বাড়ির অনুভূতি সবাইকে দেওয়া, সবাই যাতে পুরোনো আমলের গ্রামের ছোঁয়া পান—এমন ভাবনা থেকেই শীলবাড়ি তৈরি হয়েছে।’
নন্দনকোনা গ্রামেই আমিনা হকের নানাবাড়ি। নব্বইয়ের দশক থেকে একটু একটু করে এই এলাকায় জমি কিনেছেন। এখানে আগে শীল সম্প্রদায়ের মানুষদের বাড়ি ছিল। তাঁদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন, তবে বাড়ির নামটি বদলাননি। তাই এর নাম ‘শীলবাড়ির হেঁশেল’। আমিনা বলেন, ‘২০০৭ সাল থেকে বাড়িটি গোছানো শুরু করি। পুকুর কাটা হয়, তৈরি হয় শানবাঁধানো ঘাট। পুকুরপাড়ে মাচা তৈরি হয়। সেখানে বসলে গায়ে লাগে খোলা হাওয়া। শুরুতে নিজেরা বন্ধুবান্ধবসহ মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসতাম। দেখলাম অনেকেই পছন্দ করছেন জায়গাটা। আগে কিছু গাছ ছিল, নতুন অনেক গাছ লাগালাম।’
আমিনা হকের সঙ্গে বেড়াতে আসা গণমাধ্যমকর্মী, নাট্যকার করভী মিজান একবার তাঁকে বললেন, ‘এটা বাণিজ্যিকভাবে শুরু করতে পারো।’ আমিনা বলেন, ‘এখানকার খাবারের প্রথম অর্ডার দেন করভী মিজান। প্রথম গ্রুপ নিয়েও তিনি আসেন। সেই শুরু। ফুল কীভাবে সাজানো হবে, দেখিয়ে দেন বন্ধু লিপি খন্দকার (ফ্যাশন হাউস বিবিয়ানার স্বত্বাধিকারী) ।’ শীলবাড়ির হেঁশেলের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয় ২০২২ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে।
বৃষ্টিমুখর সময় কেটে যাচ্ছিল দ্রুত। রাত বাড়তে থাকে। রাতের খাবারের ব্যবস্থা পাশের বড় এক ঘরে। এ ঘরের বারান্দার পাশেই ঝুলে আছে আম। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। এটিও টিনের চাল ছাওয়া মুন্সিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ঘর। এটাই খাবার ঘর। কারুকাজ করা কাঠের বিশাল দরজার একটা কক্ষও রয়েছে। বিছানা দেখে বোঝা গেল, কেউ চাইলে এখানে একটু গড়িয়ে বা ঘুমিয়েও নিতে পারবেন। পুরোনো আমলের আসবাব, বড় বড় আয়না, বেশ কিছু বইও রয়েছে অবসরে আনন্দ দিতে। এমনিতে শীলবাড়ির হেঁশেলে রাতে থাকা বা খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। আমরা যেহেতু শেষ বিকেলে গিয়েছি, তাই রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সব দেশি খাবার। ভাত, পোলাও, নিজেদের পুকুরের মাছ ভাজি, করলা ভাজি, ধুন্দুল দিয়ে শুঁটকি মাছ, খাসির মাংস, পায়েস, তিতা পাটশাক, কাঁকরোল ভাজি, পায়েস—এই ছিল আয়োজন। প্রতিটি খাবার দেশি ও সুস্বাদু। আমিনা হক জানালেন, গ্রামের নারীরা রান্না করেন। রান্নার সব উপকরণ স্থানীয়। এই হেঁশেল পরিচালনা করে স্থানীয় তরুণেরা, যাঁদের সবাই কলেজের ছাত্র।
গত ২৯ মে শীলবাড়ির হেঁশেল ঘুরে এসেছেন সংবাদ উপস্থাপক ও বাচিকশিল্পী ফারজানা করিম। নিজের ফেসবুকে ফারজানা লিখেছেন-
‘অবারিত মাঠ গগন ললাট চুমে তব পদধূলি
ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।
আহা!
এই বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য শীলবাড়ি আসতেই হবে।
আইফোন বলো আর ডিএসএলআর এই সৌন্দর্য ধারণ করা সম্ভব না।’
আগেও বেশ কয়বার গিয়েছেন। ফারজানা বললেন, ‘একটু প্রত্যন্ত গ্রাম বলতে, ঢাকা থেকে বেশ দূরে। শীলবাড়ির হেঁশেল ঢাকার কাছেই। এক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায়। এদের খাবার বেশ সুস্বাদু। আরেকটা বিষয় খুব ভালো লেগেছে, সেটা হলো স্থানীয় অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এখানে হয়েছে।’
শীলবাড়ির হেঁশেলে যেতে হয় দল বেঁধে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ১৫ থেকে ৫০ জনের দল আর অন্যদিন ন্যূনতম ১০ জনের দল নিয়ে যেতে হবে। সময়সীমা হলো সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল ৫টা। এক দিনে শুধু একটি দলেরই বুকিং নেওয়া হয় জানালেন আমিনা হক, ‘আমরা অতিথিদের প্রাইভেসি দিতে চাই। তাঁরা যাতে নিজেরা নিজেদের মতো করে সময় কাটাতে পারেন। তাই এক দিনে একটা গ্রুপই যেতে পারে শীলবাড়ির হেঁশেলে।’
শীলবাড়ির হেঁশেল-১ থেকে কিছুটা দূরে গত ১২ এপ্রিল থেকে চালু হয়েছে শীলবাড়ির হেঁশেল-২। সেটি আরও বড়, পরিবেশও অনেক খোলামেলা। আমিনা জানালেন, সেখানে ২০০ জনের দলের আপ্যায়নের ব্যবস্থা রয়েছে। সহজেই বড় প্রতিষ্ঠানের দিনব্যাপী কোনো আয়োজন করা যায়। শীলবাড়ির হেঁশেল-২-এ বেশ বড় বড় পুকুর, শস্যখেত রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে দ্বিতীয় শাখায় সেদিন আর যাওয়া গেল না। বৃষ্টি আর সে রাতে থামেনি। রাতের খাবার খেয়ে বৃষ্টিস্নাত গ্রাম, প্রকৃতি পেছনে ফেলে আন্তরিক আপ্যায়নের অনুভূতি নিয়ে আবার ঢাকায় ফিরে আসা।
তিনবেলার খাবারদাবার
শীলবাড়ির হেঁশেলে বেড়ানোর প্যাকেজে তিনবেলার খাবার রয়েছে। সকালের খাবারের থাকে বিক্রমপুরের ঐতিহ্যবাহী খুদের ভাত, তিন রকম ভর্তা, ছিটা পিঠা, মুরগির মাংস, ডিম ভাজি ও মৌসুমি ফল। দুপুরের খাবার ভাত/পোলাও, আলু গরুর মাংসের ঝোল তরকারি, মুরগির কোর্মা, সবজি, ছোট মাছের তরকারি বা মাছ ভাজি। বিকেলের খাবার হিসেবে দেওয়া হয় পাটিসাপটা পিঠা ও চা। এর বাইরে কাঁচা আম ভর্তা, জাম্বুরা ভর্তা বা তালের শাঁসের মতো মৌসুমি ফলও থাকে। দলের সদস্যসংখ্যা যা-ই হোক, শীলবাড়ির হেঁশেলে তিনবেলা সময় কাটাতে খাবারসহ খরচ পড়বে জনপ্রতি ২ হাজার টাকা।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে শীলবাড়ির হেঁশেলের দূরত্ব ২৮ কিলোমিটার। যেতে হবে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক ধরে। বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতু, কেরানীগঞ্জ পার হওয়ার পর আবদুল্লাহপুরে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বেরিয়ে বাঁ পাশের সড়ক ধরে যেতে হবে। ধলেশ্বরীর দুটি সেতু পার হয়ে নিমতলা বাজার পেরিয়ে বাঁয়ে বীরতারার রাস্তা ধরতে হবে। বেশ কিছু দূর পর কাউকে জিজ্ঞেস করলে নন্দনকোনা বাজারের পথ দেখিয়ে দেবে। এখানেই শীলবাড়ির হেঁশেল। আগে থেকে বুকিং দিয়ে যেতে হয় শীলবাড়ির হেঁশেলে। ফোন: ০১৮১৬৪০৩৭৯১।