স্নিগ্ধ কনের সাজে চমক ৫০ বছরের মহুয়া মৈত্রের

ভারতের রাজনীতিতে অতি পরিচিত নাম মহুয়া মৈত্র। কথার বাণে সরকারি দলকে কাবু করতে তাঁর জুড়ি মেলা যেমন ভার, তেমনি স্টাইল–ফ্যাশনেও একেবারে আলাদা। ৫০ বছর বয়সে স্নিগ্ধ কনের সাজে তৃণমূল কংগ্রেসের এই সংসদ সদস্য দেখিয়ে দিলেন, বয়স কেবলই একটি সংখ্যা।

বিয়েতে মহুয়া মৈত্র সেজেছিলেন দুধে আলতা রঙের বেনারসি শাড়িতেছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

মহুয়ার বিয়ের খবর প্রকাশ্যে এসেছে সম্প্রতি। পাত্র ৬৫ বছর বয়সী পিনাকী মিশ্রও রাজনীতিবিদ। ওডিশার বিজু জনতা দলের নেতা। পুরী থেকে লোকসভার কয়েকবারের সাবেক এই সংসদ সদস্য সফল আইনজীবীও। ঘনিষ্ঠদের নিয়ে একান্ত আয়োজনে তাঁরা বিয়েটা সারলেন জার্মানির বার্লিনে।

বিয়েতে মহুয়া মৈত্র সেজেছিলেন দুধে আলতা রঙের বেনারসি শাড়িতে। সেই রং তাঁর রুচি–ব্যক্তিত্বের আভা ছড়িয়েছে। সঙ্গে ছিল পুরোনো বাঙালি নকশার চোকার ধরনের সোনার হার, মেলানো কানের দুল ও টিকলি। হালকা মেকআপ আর মাথায় সাদা ফুলের মালায় মিনিমাল লুকের এই কনে ফ্যাশনপ্রেমীদের কাছে আলোচনার প্রসঙ্গ তুলে দিয়েছেন।

বিয়েটা ঠিক কত তারিখে হয়েছে, সেটা জানা না গেলেও বিশেষ দিনে কাদের শাড়ি বেছে নিয়েছিলেন মহুয়া, তা অবশ‍্য জানা গেছে। বেনারসিটা ফ্যাশন হাউস ‘র ম্যাংগো’র। বলিউড অভিনেত্রীদের প্রিয় একটি ব্র্যান্ড। এ বছরও অদিতি রাও হায়দারি, হুমা কুরেশিরা তাঁদের পোশাকে কান মাতিয়ে এসেছেন। কাজল, বিদ্যা বালান, দীপিকা পাড়ুকোন থেকে শুরু করে হালের অনন্যা পান্ডে—আস্থা রাখেন এই ব্র্যান্ডে। মহুয়ার বিয়ের খবর প্রকাশ্যে আসার পর শুক্রবার ‘র ম্যাংগো’ তাদের ইনস্টাগ্রামে তিনটি ছবি পোস্ট করে। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে ছবিগুলো।

মহুয়া মৈত্রর স্বামী ৬৫ বছর বয়সী পিনাকী মিশ্রও রাজনীতিবিদ
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

‘র ম্যাংগো’ মহুয়ার জন্য বানানো শাড়ির বিবরণও দিয়েছে। তাদের বর্ণনায়, কনে পরেছিলেন বিশেষভাবে তৈরি ‘পরিগুল’ শাড়ি। শাড়িটি নরম ফিকে গোলাপি রঙের বেনারসি সিল্কের সঙ্গে মিহি জরি ও রানি গোলাপি মিনার সূক্ষ্ম বুননে বানানো। বেনারসির অনেক পুরোনো ঘরনার নকশায় এটি বোনা। সঙ্গে ছিল ম্যাচিং ‘গুলশেরা’ ব্লাউজ। শাড়ির দাম পড়েছে লাখ টাকার বেশি।

শাড়ির প্রতি আলাদা রকমের ভালোবাসা আছে পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরের সংসদ সদস্য মহুয়া মৈত্রর। জন্ম, বেড়ে ওঠাও হয়তো এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে। আসামের এক বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৯৭৪ সালে মহুয়ার জন্ম। স্কুলজীবন কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। পরে তিনি চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে পড়াশোনা করেন অর্থনীতি ও গণিত নিয়ে। চাকরি করেন বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যানের উচ্চ পদে।

সাজানো–গোছানো জীবন ছেড়ে ২০০৯ সালে মহুয়া মৈত্র ফিরে আসেন ভারতে। পা রাখেন রাজনীতির অনিশ্চিত পথে। স্বাধীনচেতা ও উদারপন্থী মহুয়া প্রথমে যোগ দেন ভারতের ঐতিহ্যবাহী দল কংগ্রেসে। তবে বেশি দিন থাকেননি। যান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসে। ২০১৬ সালে হন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার বিধায়ক। বছর তিনেক পর কৃষ্ণনগর থেকে লোকসভার সংসদ সদস্য হন।

মিনিমাল লুকের কনে মহুয়া মৈত্র ফ্যাশনপ্রেমীদের কাছে আলোচনার প্রসঙ্গ তুলে দিয়েছেন
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

তাঁতের শাড়ি পরে প্রথমবারের মতো লোকসভায় কথা বলতে গিয়ে সাড়া ফেলে দেন মহুয়া মৈত্র। নরেন্দ্র মোদির সরকারকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলেন। ফ্যাসিবাদের সাত লক্ষণ তুলে ধরে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, কেন মোদির সরকার ‘ফ্যাসিবাদী’। মোদি সরকারের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ভাষায় এমন কথার বাণ ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়, রাতারাতি তিনি সবার নজরে আসেন।

মহুয়ার থেকে নজর ফেরানো যায়নি তাঁর ফ্যাশনবোধের কারণেও। তিনি যে আসনের সংসদ সদস্য, সেই কৃষ্ণনগর তাঁত ও মৃৎশিল্পের জন্য সুপরিচিত। কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্যবাহী শান্তিপুরি, ফুলিয়া ও নকশিকাঁথা বুননের শাড়িতে নিয়মিত দেখা যায় তাঁকে। শিকড়কে শিখরে তুলে ধরার সচেতন চেষ্টা যেন।

ফ্যাশনসচেতন হওয়ার মূল্যও মাঝেমধ্যে চুকাতে হয় এই রাজনীতিবিদকে। দেশি শাড়ির সঙ্গে বিদেশি হ্যান্ডব্যাগ মহুয়ার স্টাইল স্টেটমেন্ট। আর এ করতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির কটাক্ষের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। তাঁর হাতে বিখ্যাত ফরাসি ব্র্যান্ড লুই ভুতোঁর দামি ব্যাগ দেখে নানা প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁরা। ভারতীয় শিল্পপতি গৌতম আদানিকে মোদি সরকারের দেওয়া বিশেষ সুবিধার ব্যাপারে লোকসভায় সব সময়ই প্রতিবাদ জারি রেখেছিলেন মহুয়া। এর মূল্যও চোকাতে হয়েছে। বিধিভঙ্গের অভিযোগে ২০২৩ সালে তাঁর সংসদ সদস্য পদ খারিজ করে দেওয়া হয়। পরের বছরই তিনি আরও বেশি ভোটে নির্বাচিত হয়ে লোকসভায় ফেরেন।

বিয়ের অনুষ্ঠানে থিম কেক কেটেছেন মহুয়া-পিনাকী
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

মহুয়া ও পিনাকী—দুজনেরই এটি দ্বিতীয় বিয়ে। জীবনের বহু পথ পেরিয়ে এই দুজন যখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন তাঁরা উৎসবের বাহারের চেয়ে নিজেদের আনন্দটাকে যে বেশি গুরুত্ব দিলেন; সেটা তাঁদের আয়োজন–পোশাকে স্পষ্ট।

পোশাকের দায়িত্বটা মহুয়া যাঁর হাতে তুলে দিলেন, তিনি সঞ্জয় গার্গ। ‘র ম্যাংগো’র প্রতিষ্ঠাতা। তিনি মনে করেন, ‘জীবন, উপলব্ধি ও অস্তিত্বের’ জানান দেয় পোশাক। পোশাক মানুষের দ্বিতীয় চামড়া। মানুষ নিজেকে কীভাবে দেখাতে চান, তার প্রতিচ্ছবি হচ্ছে তাঁর পোশাক। মহুয়া যে সেটা খুব ভালোভাবেই করতে পেরেছেন, নেট দুনিয়ায় ঢুঁ মারলেই টের পাওয়া যাচ্ছে।

‘পরিগুল’ বেনারসি আর ম্যাচিং ‘গুলশেরা’ ব্লাউজে আভা ছড়িয়েছেন মহুয়া মৈত্র
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

বিয়ের অনুষ্ঠানে থিম কেক কেটেছেন মহুয়া–পিনাকী। সেখানেও নিজেদেরই প্রকাশ করেছেন তাঁরা। কেকে ছিল মহুয়ার পছন্দের হ্যান্ডব্যাগের রেপ্লিকা, পিনাকীর আইন পেশার প্রতীক হিসেবে হাতুড়ি। নিজেরা গেয়েছেন, নেচেছেন, আনন্দ করেছেন। পাছে লোকে কী বলবে, তার তোয়াক্কা না করেই জীবনের জয়গানের সারথি হয়েছেন।

আরও পড়ুন