স্টাইলে, ফ্যাশনেও সাদা শাঁখা
কাশ যে সাদা, ধেনু সাদা আর সাদা খেয়ার পাল
সাদা যে ওই স্বপ্নমাখা রাজহংসের পাখা
তার চেয়েও সাদা কন্যা তোমার হাতের শাঁখা।
সব সাদার চেয়ে বেশি শুভ্র নারীর হাতের শাঁখা, সেটা নরম অক্ষরে নিরুপম উপমায় লিখে গেছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। এই শাঁখা কালে কালে অধিকার করে আছে নারীর হাতে, রীতিনীতিতে। শাঁখা মূলত বানানো হয় সামুদ্রিক শঙ্খ থেকেই। সাধারণত বাঙালি হিন্দু বিবাহিত নারীদের বিবাহিত জীবনের চিহ্ন এই শাঁখা। স্বামীর মঙ্গলের জন্য হাতে এই অলংকার পরে থাকেন। এর সঙ্গে তাঁরা আরও পরেন নোয়া ও পলা। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, শাঁখা, পলা ও সিঁদুর ছাড়া বিয়ে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অনেক প্রাচীন যুগ থেকে শুরু হলেও এখন পর্যন্ত এই রীতি অনুসরণ করা হয়।
শাঁখা পরার রীতি এল কোথা থেকে
বেশ কিছু বিচিত্র গল্প আছে শাঁখা নামক এই গয়নার প্রেক্ষাপটে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতে, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মহাভারতের সময়কাল থেকে শাঁখার ব্যবহার শুরু হয়। সে সময় ত্রিভুবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে শঙ্খাসুর নামের এক অসুরের তাণ্ডবে। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্বর্গের দেবতারা শরণাপন্ন হন বিষ্ণুর। বিষ্ণু এই অসুরকে বধ করে দেবতাদের রক্ষা করেন। তখন নারায়ণের কাছে স্বামীকে ফেরত পাওয়ার জন্য ধ্যান শুরু করেন শঙ্খাসুরের ধর্মপরায়ণ স্ত্রী তুলসী। নারায়ণ তুলসীর প্রার্থনায় সাড়া দিলেও শঙ্খাসুরকে ফিরিয়ে দিতে পারেন না। পরিবর্তে শঙ্খাসুরের প্রতীক হিসেবে তাঁরই হাড় দিয়ে তৈরি করেন শাঁখা এবং তুলে দেন তুলসীর হাতে। সেই থেকেই স্বামীর মঙ্গল কামনায় শাঁখা পরার চল শুরু হয় বিবাহিত নারীদের মধ্যে।
শাঁখা কীভাবে বানায়
শাঁখা তৈরির প্রক্রিয়া বর্ণনা করতে গিয়ে ঢাকার শাঁখারীবাজারের শঙ্খশিল্পী স্বপন নন্দী জানান, প্রথমে শঙ্খগুলোর মুখ ভেঙে দিতে হয় হাতুড়ির ঘায়ে। ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হয়। এর পরের ধাপে শঙ্খ কাটতে হয়। বিশেষ ধরনের করাত দিয়ে শঙ্খকে গোলাকার করে কেটে বিভিন্ন আকারের বলয় তৈরি করা হয়। এরপর সেটিকে শিল দিয়ে ঘষে মসৃণ করা হয় এবং বিভিন্ন নকশা করা হয়। প্রতিটি শাঁখার জোড়া অংশ নিখুঁতভাবে লাগিয়ে তাতে ফুল, লতা, মাছ, পাখি, আলপনাসহ নকশা তোলা হয়। মোটা শঙ্খ থেকে দুটি, অর্থাৎ এক জোড়া শাঁখা তৈরি হয়। সরু শঙ্খ থেকে চারটি শাঁখা পাওয়া যায়।
শাঁখা কারা বানায়
বাংলাদেশে শাঁখা বানানোর সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী জায়গা হলো রাজধানীর পুরান ঢাকার ইসলামপুর ও নবাবপুরের রোডের সংযোগস্থলে অবস্থিত শাঁখারীবাজার। এখানে অসংখ্য একক ও পারিবারিক কারিগর রয়েছেন, যাঁরা বংশপরম্পরায় বছরের পর বছর ধরে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। যেমন শাঁখারীবাজারের লক্ষ্মী নারায়ণ শঙ্খভান্ডারের অধিকারী কাশীনাথ সুরের পরিবার। তাঁর পরিবার ১০০ বছর ধরে শাঁখা নির্মাণ ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে ব্যবসার দেখভাল করেন তিনি নিজে, তাঁর স্ত্রী উমা সুর ও ছেলে শুভজিৎ সুর। এ ছাড়া পিরোজপুর শহরে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী শাঁখাশিল্প। পিরোজপুরের শাঁখাশিল্পের রয়েছে ৪০০ বছরের ঐতিহ্য। পিরোজপুর শহরের রাজারহাট এলাকার শিবনারায়ণ দত্তের (৭৮) পরিবারের সদস্যরা বংশপরম্পরায় শাঁখা তৈরি করে আসছেন। তাঁর পরিবারের আরও দুই সদস্য এ পেশায় রয়েছেন। নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগরেও রয়েছে শাঁখারিপল্লি। একসময় এখানে প্রায় ২০০ পরিবার শাঁখা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করত। নাটোরের এই শাঁখারিপল্লি থেকে প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ জোড়া শাঁখা তৈরি হয়। শাঁখারীবাজারের শঙ্খ-শিল্প কারিগর সমিতি সূত্রে জানা যায়, শাঁখাশিল্পের প্রধান উপকরণ সমুদ্রের বিশেষ কয়েক প্রজাতির শঙ্খ আসে শ্রীলঙ্কা থেকে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনার ব্যবসায়ীরা এই শঙ্খ আমদানি করে থাকেন। ঢাকার শাঁখারীবাজার, খুলনার ধর্মসভা সড়ক ও দোলখোলার শঙ্খের মোকাম থেকে শঙ্খ কিনে এনে নিজস্ব কারখানায় শঙ্খের পণ্য তৈরি করেন শিল্পীরা। ঢাকার শাঁখারীবাজার শঙ্খের পণ্য কেনাবেচার প্রধান কেন্দ্র হলেও চট্টগ্রাম, খুলনা ও ঝালকাঠিতে শঙ্খ ব্যবসার প্রচলন আছে।
ফ্যাশনে শাঁখার রকমসকম
হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ে ও পূজা-পার্বণ উপলক্ষে শাঁখার অলংকার ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদল এসেছে অনেক প্রচলিত রীতিনীতিতেও। এখন আর বিবাহিত নারীদের অনেকে আগের মতো দৈনন্দিন জীবনে শাঁখা-পলা পরেন না। পরলেও সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে। অন্যদিকে অনেকেই আবার এই শাঁখা-পলাকে ফ্যাশনের অন্তর্গত করেছেন। হিন্দুধর্মাবলম্বী নারীদের বাইরেও অন্যদের আজকাল শাঁখা পরতে দেখা যাচ্ছে হরহামেশাই। আগে নারীরা দুই হাতে দুটি শাঁখা পরতেন। এখন ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে এ ধারারও। এক হাতে একাধিক শাঁখা এবং আরেক হাত সম্পূর্ণ খালি রাখার চলও চোখে পড়ছে আজকাল। হাল আমলে প্রচলিত বিভিন্ন শাঁখার মধ্যে কোনগুলো বেশি জনপ্রিয়, চলুন জেনে নেওয়া যাক।
মোটা শাঁখা
একটা সময় সরু শাঁখার চল ছিল প্রচুর। বর্তমানে শুরু হয়েছে মোটা শাঁখার ফ্যাশন। এ ধরনের শাঁখা পরা যায় পলার সঙ্গে, আবার পলা ছাড়াই পরা যায়। সঙ্গে থাকতে পারে অন্য কোনো বালা বা কয়েক গাছা সরু চুড়ি।
প্লাস্টিকের শাঁখা
যাঁরা বাঁধানো শাঁখা পরতে পছন্দ করেন, কিন্তু শাঁখা ভেঙে যাওয়ায় ভয়ে সব সময় পরেন না, তাঁদের জন্য একটা ভালো বিকল্প হতে পারে প্লাস্টিকের শাঁখা। বাজারে এ ধরনের শাখার ব্যাপক বেচাকেনা হয়। কিছু শাঁখা শুধুই সাদা প্লাস্টিকের ওপর নকশা করা, আবার কিছু সোনালি প্লাস্টিক বা হালকা কোনো ধাতু দিয়ে সাজানো। অনেক সময় দেখলে বোঝাও যায় না যে এটি খাঁটি সোনায় বাঁধানো নয়। এ ধরনের শাঁখার রং চট করে উঠে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
হস্তীমুখী, মকরমুখী বা ময়ূরমুখী নকশার শাঁখা
সনাতনী সাজের সঙ্গে এসব ধরনের নকশার শাঁখা বেশ মানানসই। নিজের পছন্দমতো নকশা দিয়ে বানাতে পারেন বা পছন্দ হলে দোকান থেকে কিনেও নিতে পারেন। সোনার পানি করা বা সম্পূর্ণ সোনার তৈরি—দুই ধরনের শাঁখাই বাজারে সহজলভ্য। শাঁখার নকশায়ও মিলবে ভিন্নতা। নামও বাহারি—বেকি, কঙ্কন, বেণি, শঙ্খপাতা, ধানছড়া, দড়িবান, বাজগিট্টু, চিত্তরঞ্জন, পানবোট, সতীলক্ষ্মী, জলফাঁস, হাইসাদার, দানাদার, লতাবলা, তারপেঁচ, মোটালতা, নাগরী বয়লা—আরও কত-কী। তবে হাতে নকশা করার কারিগরির বদলে এখনকার শাঁখায় আধিপত্য চলছে মেশিনের। কিন্তু দেখতে ঝকঝকে হলেও স্থায়িত্ব কম এগুলোর। তবে শ্রীলঙ্কান শঙ্খের তৈরি শাঁখা কেনার চেষ্টা করবেন। এসব শাঁখা টেকসই ও উজ্জ্বল হয়। পুডিং দেওয়া ভারতীয় শাঁখার দাম ও স্থায়িত্ব কম। এ ছাড়া এগুলো অল্প দিনের মধ্যেই লাল হয়ে যায়।
শাঁখার দরদাম কেমন
শাঁখারীবাজারের আদি ঢাকেশ্বরী শঙ্খভান্ডারের অধিকারীরা জানান, সাধারণ নকশার শাঁখার দাম তুলনামূলকভাবে কম। বড় আকারের একটি শঙ্খ থেকে দুই বা তিন জোড়া শাঁখা তৈরি হয়। এসব শাঁখা প্রতি জোড়া ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। পাশাপাশি গলার হার ৪ হাজার এবং আংটি ৫০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে মূলত নকশার ওপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয় শাঁখার দাম। মা জুয়েলারি ওয়ার্কশপের অধিকারী আশীষ মণ্ডল জানান, গোল্ড প্লেটেড শাখা চাইলে গুনতে হবে ন্যূনতম হাজার টাকা। মিলবে খাঁটি সোনায় বাঁধানো শাঁখাও। ৪ হাজার থেকে শুরু করে দাম ওঠে ১০ হাজার পর্যন্ত। শাঁখার দোকান থেকে বিশেষ ধরনের ঘর করে কাটা নকশাবিহীন শাঁখা কিনে স্বর্ণকারের কাছ থেকে সোনা দিয়ে বাঁধাই করতে দেন অনেকেই। সে ক্ষেত্রে সোনার পরিমাণ, নকশা ও কারিগরের মজুরির ওপর নির্ভর করবে এক জোড়া শাঁখার খরচ। এ ছাড়া পুঁতি বসানো শাঁখাও পাওয়া যায় বাজারে। এগুলোর দাম ৬০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। তবে প্লাস্টিকের তৈরি শাখার দাম শুরু হয় ১২০ টাকা থেকে।
কোথায় পাওয়া যাবে
ঢাকার শাঁখারীবাজার, স্বামীবাগ, রমনা কালীমন্দির, ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দিরের সামনের স্টেশনারি দোকানগুলোয় শঙ্খের তৈরি শাঁখা পাওয়া যায়। প্লাস্টিক বা অন্যান্য উপাদানের তৈরি শাঁখা মিলবে ঢাকার গাউছিয়া, চাঁদনী চক, দেশের সব ছোট-বড় শপিং মল, মার্কেট, স্টেশনারি ও গয়নার দোকানে।